শান্তিনিকেতনে দেওয়া একটি ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: "জাতীয়তাকে আমরা পরম পদার্থ বলে পূজা করি নে এইটেই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তা,
রবীন্দ্রনাথ ১৬০ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠ
আবার এই কোভিড বিভৎসতার মধ্যেই ২৫শে বৈশাখ, এসে গেল। আজ থেকে ১৬০ বছর আগে এই মহামানব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীতে এসেছিলেন। ১৬০ তো কম সময় নয়। বহু পুরোনো হয়ে যাওয়া কিছু ধারনা। রবীন্দ্রনাথ বাদে বাকি বেশিরভাগ বিষয় এখন বাতিলের খাতায়। কিন্তু তিনি এখনো নতুন কেন ? আজকের ভারতে কবিগুরুর প্রাসঙ্গিকতা কতটা বেড়েছে বা কমেছে, তা বিশ্লেষন জরুরি হয়ে পড়ে।
বর্তমান সময়ে ভারতে যখন উগ্র-জাতীয়তাবাদের জিগির ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, তথাকথিত উদারপন্থীদের প্রায় আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে রবীন্রনাথের জীবনদর্শনের কথা আরও একবার মনে করা বিশেষ প্রয়োজন । ভারতের দ্বিতীয়বার লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের শুরু থেকেই জাতীয়তাবাদী জিগির আরও উগ্র হয়ে উঠেছে। এবং দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষার উপরে নেমে আসছে তরবারির আঘাত, বিশেষ করে ভারতীয় সংবিধানকে অস্বীকারের একটা আবহ তৈরি হচ্ছে । এর মধ্যে দেশজুড়ে নগ্ন হয়েছে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা । লজ্জাজনক ভাবে কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত এই ব্যবস্থায় জনগনের অসহায়তা লক্ষণীয় । উগ্র জাতীয়তাবাদ নির্মাণ করার প্রক্রিয়া কিন্তু চলছে।
আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক, জন্মের দেড়শো বছরের উপর পার করেও। তাঁর জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে দেওয়া একটি ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: "জাতীয়তাকে আমরা পরম পদার্থ বলে পূজা করি নে এইটেই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তা, ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি, ভূমাত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ--এইটিই হচ্ছে আমাদের জাতীয়তার মন্ত্র।"
কথাটির গভীরতা আজকের। উগ্র-জাতীয়তাবাদের কারবারিরা কতটা বুঝবেন জানা নেই কিন্তু ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের আত্মাকে বোঝার মূল চাবিকাঠি যে এই কথাগুলির মধ্যেই নিহিত, তা অনস্বীকার্য।
বিশ্বকবি তাঁর ভাষণে আরও বলেছিলেন যে ভারতের কতগুলি বিশেষ সংস্কার ও লোকাচারের মধ্যে স্বজাত্যের অভিমানকে সীমাবদ্ধ ও অত্যুগ্র করে তোলার পন্থাকে তিনি ন্যাশনাল শিক্ষা বলে স্বীকার করতে রাজি নন। উৎকট ব্যায়াম করলেই যোগসাধনা হয় না; আজকের ফ্যাশনেবল যোগসাধনাকারীরা কি জানেন?
প্রাচীন ভারতের তপোবনের মহাসাধনার কথা এবং চতুর্প্রান্তে তার ডালপালা বিকাশের কথাকে উল্লেখ করে রবি ঠাকুর বলেন যোগসাধনার কথা। তিনি বলেন যে সেই সাধনা আসলে যোগসাধনা এবং মনে করিয়ে দেন যে যোগসাধনা কোনও "উৎকট শারীরিক মানসিক ব্যায়ামচর্চা নয়"।
রবীন্দ্রনাথের তার শান্তিনিকেতন শিক্ষা প্রসঙ্গে বলতেন: "যোগসাধনা মানে সমস্ত জীবনকে এমনভাবে চালনা করা যাতে স্বাতন্ত্রের দ্বারা বিক্রমশালী হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য না হয়, মিলনের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠাকেই আমরা চরম পরিণাম বলে মানি, ঐশ্বর্যকে সঞ্চিত করে তোলা নয়, আত্মাকে সত্যে উপলব্ধি করাই আমরা সফলতা বলে স্বীকার করি।"
আমাদের দেশে এখন যোগ সংস্কৃতির এক প্রাচুর্য দেখা যাচ্ছে; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও আজকাল প্রবল ঢক্কানিনাদ সহকারে রাজপথে বসে পড়েন যোগসাধনা করতে। কিন্তু রবি ঠাকুরের কথা মানলে, যোগসাধনা উৎকট ব্যায়াম চর্চা করলেই সফল হয় না; তার জন্যে প্রয়োজন মিলনাত্মক মানসিকতাও। গত পাঁচ বছরে ভারতে মিলনের উদাহরণ কতবার দেখা গিয়েছে, তা গোটা পৃথিবী দেখেছে।
রবিঠাকুর দেখিয়েছিলেন আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সভ্যতার গৌরবময় তারতম্য
আমেরিকার সভ্যতার অগ্রগতির তুলনা এনেও রবীন্দ্রনাথ ভারতের সভ্যতার আত্মাকে প্রস্ফুটিত করে তুলেছিলেন। বলেছিলেন: "আমেরিকার অরণ্যে যে তপস্যা হয়েছে তার প্রভাবে বনের মধ্যে থেকে বড়ো বড়ো শহর ইন্দ্রজালের মতো জেগে উঠেছে। ভরতবর্ষেও তেমন করে শহরের সৃষ্টি হয় নি তা নয়, কিন্তু ভারতবর্ষ সেইসঙ্গে অরণ্যকেও অঙ্গীকার করে নিয়েছিল। অরণ্য ভারতবর্ষের দ্বারা বিলুপ্ত হয় নি, ভারতবর্ষের দ্বারা সার্থক হয়েছিল; যা বর্বরের আবাস ছিল তাই ঋষির তপোবন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমেরিকায় অরণ্য যা অবশিষ্ট আছে তা আজ আমেরিকায় প্রয়োজনের সামগ্রী, কোথাও বা তা ভোগের বস্তুও বটে, কিন্তু যোগের আশ্রম নয়।
ভূমার উপলব্ধি দ্বারা এই অরণ্যগুলি পুণ্যস্থান হয়ে ওঠে নি। মানুষের শ্রেষ্ঠতর অন্তরতর প্রকৃতির সঙ্গে এই অরণ্য প্রকৃতির পবিত্র মিলন স্থাপিত হয় নি।
অরণ্যকে নব্য আমেরিকা আপনার বড়ো জিনিস কিছুই দেয় নি, অরণ্যও তাকে আপনার বড়ো পরিচয় থেকে বঞ্চিত করেছে। নূতন আমেরিকা যেমন তার পুরতন অধিবাসীদের প্রায় লুপ্তই করেছে, আপনার সঙ্গে যুক্ত করে নি, তেমনি অরণ্যগুলিকে আপনার সভ্যতার বাইরে ফেলে দিয়েছে তার সঙ্গে মিলিত করে নেয় নি। নগর-নগরীই আমেরিকার সভ্যতার প্রকৃত নিদর্শন- এই নগর-স্থাপনার দ্বারা মানুষ আপনার স্বতন্ত্র্যের প্রতাপকে অভ্রভেদী করে প্রচার করেছে। আর তপোবনই ছিল ভারতবর্ষের সভ্যতার চরম নিদর্শন; এই বনের মধ্যে মানুষ নিখিল প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার মিলনকেই শান্তসমাহিতভাবে উপলব্ধি করেছে।"
দেশজুড়ে একটা বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার প্রক্রিয়া চলছে । এক দেশ এক ভাষা এক সংস্কৃতি ।
প্রাকৃতিক থেকে শুরু করে দীর্ঘ হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক দুরত্ব অস্বীকার করে সারা দেশকে একই ধাঁচে ফেলে দেওয়ার এই সংকীর্ণতা রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করত
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মন্ত্রকে রবীন্দ্রনাথের মতো গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে খুব বেশি লোক দেখেননি। আজ যেভাবে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে সারা দেশের মানুষকে একই সাংস্কৃতিক ধাঁচে ফেলে দেওয়ার জোর প্রকল্প চলছে, জয় শ্রীরাম স্লোগান নিয়ে প্রবল বাগ্বিতণ্ডা চলছে যেখানে দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে বিশেষ জোর কোনো বক্তব্য নেই শাসকের সেখানে রবীন্দ্রনাথকে বেশি করে মনে পড়ে। আমরা আমাদের বৈচিত্র্যের শক্তিকে সম্বল করে যেখানে আরও বেশি কৃতিত্বের দিকে এগোতে পারি, সেখানে দেশের মধ্যেই জাতীয়তাবাদী জিগির তুলে বিভাজন সৃষ্টি করে ভারতবর্ষের মুল বৈশিষ্ট্যকে ধুলিস্যাত করার চেষ্টা চলছে।
একজন চুড়ান্ত প্রগতিশীল নবজাগরণের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মানবিকতার পূজারী, নিজের প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে আজকে যে রাজনৈতিক-সামাজিক আবহ তৈরী হয়েছে, তা দেখে তিনি নিশ্চিত গর্জে উঠতেন , তার উত্তাপ কতটা হত, সেকথা আমাদের কল্পনারও অতীত। আন্তর্জাতিক মননের মানুষটি যেমনটি উঠেছিলেন একসময়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে; তার প্রমান পাই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর ত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তার দ্বিধাহীন কন্ঠস্বর ।
তাই জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে তার ধারনা ছিল প্রগতিশীল অনন্য।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন একটি প্রবন্ধে লিখেছেন লাটভিয়াবাসী বিশিষ্ট ব্রিটিশ চিন্তাবিদ ঈশা বার্লিনের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অন্যরকম অবস্থান------
"Tagore stood fast on the narrow causeway, and did not betray his vision of the difficult truth. He condemned romantic overattachment to the past, what he called the tying of India to the past “like a sacrificial goat tethered to a post,” and he accused men who displayed it – they seemed to him reactionary – of not knowing what true political freedom was, pointing out that it is from English thinkers and English books that the very notion of political liberty was derived. But against cosmopolitanism he maintained that the English stood on their own feet, and so must Indians. In 1917 he once more denounced the danger of ‘leaving everything to the unalterable will of the Master,’ be he brahmin or Englishman."
ছবি - রবীন্দ্রনাথ - মহাত্মা গান্ধী ও কস্তুরবা গান্ধী
We hate spam as much as you do