বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের ঐতিহাসিক সাফল্য
নির্বাচনের ফল যেকোনো দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নির্নায়ক, হলেও জনগনের কাছে নির্বাচনের ঠিক কয়েকমাস আগের তৈরি এজেন্ডাই নির্বাচনের কারন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। "উন্নয়ন " থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও আশুপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে যখন "নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব রক্ষা" র এজেন্ডা তখন আপাতভাবে এগিয়ে যাওয়ার থেকে টিকে থাকার জন্য যা করা দরকার জনগণ তাই করেন। অনেকটা সেই ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো। এবারের নির্বাচনে বেশিরভাগ গরীব মানুষের মধ্যে সেই অস্তিত্বহীন হয়ে যাবার ভয় কাজ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পরিনতি। সেই লড়াই জীবনধারনের মানোন্নয়নের লড়াইয়ের পাশাপাশি সেই সময় দেশভাগ ইত্যাদি পরিস্থিতির কারণে মানুষের যে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনার সময় এই লড়াই পরিচালনা করে সাফল্য নিয়ে আসাও বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছর টানা থেকে যাওয়ার একটা কারন হিসেবে ধরা যায়।
জ্যোতি বসু বা পরবর্তীতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য এর সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে রাজ্যবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। দায়িত্ব পালনের সময়ও বামফ্রন্ট সরকার তার সাফল্য, সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলির বস্তুনিষ্ঠ বিচারের চেষ্টা করেছে। কী কাজ সরকার করেছে তা যেমন বামফ্রন্ট বলেছে, তেমনই কী কাজ করতে পারেনি, কেন পারেনি তাও সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছে। রাজনৈতিক কারণেই বাম-বিরোধী শক্তিগুলি একদিকে বামফ্রন্ট সরকারের জনস্বার্থবাহী উন্নয়নমূলক কাজগুলিকে বাধা দিয়েছে; অন্যদিকে অর্থহীন সমালোচনা করতে চেষ্টা করেছে বামফ্রন্ট সরকারের ইতিবাচক কাজগুলি।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রবেশ করেছিল নতুন এক পর্বে। রাজ্য সরকারের অভিমুখই সেদিন থেকে বদলে যেতে শুরু করে।
(গনতন্ত্রের বিকাশ----)
গণতান্ত্রিক অধিকার সুনিশ্চিত করা ও প্রসারিত করা, আইনের শাসন প্রতিষ্টা এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষে যা যা সম্ভব তাই করেছে বামফ্রন্ট সরকার। গ্রাম ও শহরের সাধারণ মানুষকে, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষকে, মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। নতুন পরিবেশ পেয়ে শক্তি অর্জন করেছে সংগঠিত গণতান্ত্রিক শক্তি। বামফ্রন্ট সরকার দায়িত্বে এসেই রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেয়। নকশালপন্থী ও কংগ্রেসীদেরও অনেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। বিনা বিচারে আটকের মতো বর্বর প্রথা রদ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকার পুলিসকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পূরণের কাজে ব্যবহার করেনি।
ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারকে বামফ্রন্ট সরকার সর্বদা মর্যাদা দিয়েছে। শ্রমিক ধর্মঘট ভাঙতে কখনও পুলিস যায় নি। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় রাজ্য সরকার কখনও হস্তক্ষেপের অভিযোগ ছিল না। সবচেয়ে সমালোচক সংবাদমাধ্যমও সরকারী বিজ্ঞাপন পেয়েছে। দেশের মধ্যে বামফ্রন্ট সরকারই প্রথম পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যস্তরে মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছিল।
ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতিগত ঐক্যরক্ষায় দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। তথাকথিত সংখ্যালঘু মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার অছিলায় তাদের একটা বিশেষ সাহায্যপ্রাপ্ত সামাজিক অংশ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেনি।
অথচ দেখা গেছে এরা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপত্তা ভোগ করেছেন। জাতিগত ঐক্যের প্রশ্নেই পাহাড়ে পার্বত্য পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। নেপালী, সাঁওতালী, উর্দুভাষার স্বীকৃতি ও মর্যাদা রক্ষায় রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ ভবিষ্যতে আলোচনার দাবী রাখে।
নব্বইয়ের দশকে নয়া উদারবাদী পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি বা বামপন্থীদের দুনিয়া জুড়ে যে দ্বিধা তৈরি হয় তার মধ্যেই চলার পথের পরিবর্তন করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার।
(কৃষি উন্নয়ন )
দেশভাগের সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছে বাংলা। এখানে কৃষি উন্নয়ন খুবই প্রয়োজনীয় গঠনমুলক কর্মসূচি ছিল।
কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কারে বামফ্রন্ট সরকারের অবদান অতুলনীয়। সারা দেশের জমির মাত্র ৩% পশ্চিমবঙ্গে। অথচ গোটা দেশে ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে যত জমি বন্টিত হয়েছে তার ২২% পশ্চিমবঙ্গেই হয়েছিল। ভূমি সংস্কারের ফলেই রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা ৮৪শতাংশ কৃষি জমির মালিক। জাতীয় স্তরে তা ৩৪ শতাংশের সামান্য বেশি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে ৩০লক্ষাধিক কৃষক পেয়েছেন ১১লক্ষ ২৭হাজার একরেরও বেশি জমি। পাট্টা প্রাপকদের প্রায় ৩৭% তফসিলি জাতিভূক্ত, প্রায় ১৮% আদিবাসী এবং ১৮% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভূমিসংস্কার কর্মসূচীর সঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্য মোকাবিলার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছিল। পাট্টা পেয়ে জমির মালিক হয়েছিলেন কৃষক পরিবারের মহিলারাও। নারী-পুরুষ যৌথ পাট্টা দেওয়া হয়েছিল ৬লক্ষ ১৮হাজারেরও বেশি। শুধুমাত্র মহিলারা পাট্টা পেয়েছিলেন ১লক্ষ ৬১হাজারেরও বেশি। জমির পাট্টা বিলি ধারাবাহিকভাবে চলেছে। সপ্তম সরকারের আমলেও ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১৬ হাজার ৭০০ একর জমির পাট্টা বিলি হয়।সেই সময়পর্বে বস্তুতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গেই শুধুমাত্র জমি বন্টিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫লক্ষ ১৩হাজার নথিভূক্ত বর্গাদারের আইনী অধিকার সুরক্ষিত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বর্গা উচ্ছেদ আটকাতে ১৯৭৭সালের সেপ্টেম্বরেই ভূমি সংস্কার আইনের সংশোধন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে বর্গা নথিভূক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১১লক্ষ ১৫হাজার একর। এছাড়া ‘চাষ ও বসবাসের ভূমিদান’ প্রকল্পে খেতমজুর, গ্রামীণ কারিগর ও মৎস্যজীবীদের ৫কাঠা পর্যন্ত জমি দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে। প্রায় ২লক্ষ পরিবার এই প্রকল্পে উপকৃত।বনাধিকার আইন ২০০৬ কার্যকর করার ক্ষেত্রেও বামফ্রন্ট সরকার উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল।
(উদ্বাস্তু সমস্যা)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় আলোচনার বাইরে থেকে যায় তা হল দেশভাগের ফলে তৈরী হওয়া উদ্বাস্তু সমস্যা। যার সমাধান এক চুড়ান্ত মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল।
শুধু গ্রাম নয়, শহরেও গরীব মানুষকে বসবাসের জমি দিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। যেমন, উদ্বাস্তুদের নি:শর্ত জমি প্রদান, ঠিকা প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধন করা, কুড়ি বছরের উপর সরকারী জমিতে বসবাসকারীদের মাত্র ১ টাকায় ৯৯ বছরের লিজ দেওয়া, ইত্যাদি।
(খাদ্য শস্য উৎপাদন)
এর আগে যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল খাদ্য শস্য উৎপাদনে ঘাটতি রাজ্য। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যশস্য উৎপাদনে উদ্বৃত্ত্ব রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৭৬-৭৭সালে রাজ্যে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন হত ৭৪লক্ষ মেট্রিক টন। ২০১০-১১ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ১৭০লক্ষ মেট্রিক টন। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই চাল উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্যে পরিণত হয়। বছর গড়ে চাল উৎপাদিত হয় ১৪৮লক্ষ মেট্রিক টন। ১৯৭৭-৭৮সালের তুলনায় ৯৮শতাংশ বেশি। জাতীয়ক্ষেত্রে কৃষিতে বৃদ্ধির হার ২০০৮-০৯ সালে ছিল ১.৬%। ২০০৯-১০সালে ০.২%। আর পশ্চিমবঙ্গে ২০০৮-০৯সালে ৪.৪%। ২০০৯-১০সালে ৪.২%। দেশের মোট খাদ্যশস্যের ৮শতাংশ উৎপাদন হয় এরাজ্যে। যদিও দেশে মোট কৃষিজমির মাত্র ৩ শতাংশ রয়েছে এ-রাজ্যে। দেশজুড়ে কৃষিতে সঙ্কটের মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে অগ্রগতির হার ছিল সর্বভারতীয় হারের থেকে বেশি।
কৃষিজমিকে বহুফসলি করে তুললে কৃষক ক্ষেতমজুর সারাবছর কৃষির মধ্যেই আয়ের সংস্থান করতে পারেন।
এক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছেছিল। ১৯৯২-৯৩সালে রাজ্যে শস্য চাষে নিবিড়তা ছিল ১৫৫শতাংশ। ২০১০-১১ সালে ১৯২শতাংশ। কৃষিতে বৈচিত্র্যও যথেষ্ট বেড়েছিল। কৃষকের আয় বাড়ানোর জন্য যা জরুরী। বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই সবজি উৎপাদনে (আলু ছাড়া অন্যান্য সবজির উৎপাদন প্রায় ১৩০ লক্ষ মেট্রিক টন) দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। আলু উৎপাদনে (প্রায় ৯৫লক্ষ মেট্রিক টন) দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। দেশের ৩৫%আলু এ রাজ্যে উৎপাদিত হয়। সবজি ও ফল উৎপাদনেও পশ্চিমবঙ্গ সামনের দিকে চলে আসে।
(সেচের উন্নয়ন)
সেচের উন্নয়ন কৃষিতে সাফল্যের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। ১৯৭৭ সালে মাত্র ৩২ শতাংশ সেচসেবিত জমি থেকে তা বেড়ে ৭৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।
সামাজিক বনসৃজনে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ( ১৯৮১র পরিকল্পনা) অনুসৃত জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রশংসিত হয়।
(মৎস্যচাষকে উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ যায়গায় নিয়ে যাওয়া )
মৎস্যচাষেও বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বেড়েছে। ১৯৭৭ সালে মাছের উৎপাদন ছিল ২ লক্ষ ৩৪ হাজার মেট্রিক টন। বামফ্রন্টের আমলে তা ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যায়। রাজ্যের নিজস্ব চাহিদার চেয়েও বেশি হওয়ার ফলে তা অন্য রাজ্যে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেই দেশের মোট চাহিদার ৬২ শতাংশেরও বেশি মৎস্যবীজ উৎপাদিত হত। মৎস্যচাষে এই অগ্রগতি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছিল কর্মসংস্থানের সুযোগ।
(পঞায়েত ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ)
এখন যে রাজ্য সরকারের স্লোগান "দুয়ারে সরকার " সেই ভাবনা অনেক আগেই বাম আমলে নিয়ে আসা হয়েছিল। জ্যোতিবাবু প্রায়ই বলতেন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কথা। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে নয়, পঞায়েত দিয়েই চলবে সরকার।
কেন্দ্রীয় সরকারের আইন ব্যবহার করেই
শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, আধুনিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্টা করা গেছে।
ভূমিসংস্কার রাজ্যের গ্রামীণ মানুষকে যদি আর্থিক সুরাহা দিয়ে তাকে তাহলে বামফ্রন্টের আমলে পঞ্চায়েত তাঁদের দিয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামন্ততান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্ক এবং ক্ষমতার মূলে আঘাত হেনেছে।
এখানে নিয়মিত নির্বাচন হয়েছে।
পঞ্চায়েতের মাধ্যমে একেবারে নিচে থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা তুলে এনেছে। সরকারী খরচের প্রায় ৩৫ শতাংশ টাকা খরচ করা হতো ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত মারফত। খাপ পঞায়েতের মত চুড়ান্ত পিছিয়ে পড়া ব্যবস্থার দেশে পশ্চিমবঙ্গ গোটা ভারতবর্ষে এক উদাহরণ।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ৩৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করেছিল। একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল পুরসভাগুলির ক্ষেত্রেও। তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ ছাড়াও, সপ্তম বামফ্রন্ট সরকরের আমলে ও বি সি সম্প্রদায়ের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে পঞ্চায়েতে আসন ও পদ সংরক্ষন করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনগনের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে ১৯৯২সালে তৈরি হয় গ্রাম সংসদ। অর্থাৎ, ৭৩ তম সংবিধান সংশোধনের আগেই। সারা দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম সংসদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। পঞ্চায়েতে গণঅংশগ্রহণে পশ্চিমবঙ্গই এদেশে পথপ্রদর্শক।
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার নেতৃত্বে উঠে এসেছিল দুর্বলতর মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকেও পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত দেশে নতুন নজির সৃষ্টি করে।
(পৌরব্যবস্থায় গনতান্ত্রিক রূপান্তর) পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার আমলেই , নগরায়নের চাহিদা অনুসারে পৌরব্যবস্থার অভূতপুর্ব প্রসার ঘটানো হয়। ২০১১ সালের জনগণনার হিসাব অনুসারে এরাজ্যে ৭৪০টি সেন্সাস টাউনের প্রকাশ ঘটেছে যা সারা দেশের সর্বাধিক। এর আগে পৌরসভার হাতে বিশেষ কোনো ক্ষমতা ছিল না।
বামফ্রন্ট সরকারই পৌরসভাগুলিকে সত্যিকারের স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সংস্থায় পরিণত করেছিল। বামফ্রন্ট সরকারই নিয়মিত পৌরনির্বাচনের ব্যবস্থা করে।
এই পৌর পরিকল্পনা বিশেষকরে উদ্বাস্তু কলোনী গুলোর সুস্থ বসবাসের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল। তবে এই ব্যবস্থার
(লোডসেডিং এর মোকাবিলা )
লোডসেডিং একটি পপুপার বিদ্রুপ হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো মাত্র ১৬১৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের নির্বাচনের আগে তা দাঁড়ায়, ১১,৩০০ মেগাওয়াটে। প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারকে যে রাজনৈতিক অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল তা সর্বজনবিদিত।
(মানবোন্নয়ন)
এর আগে আলোচনা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পূর্বতন সরকারগুলো বৃহৎ ক্ষেত্রে উন্নয়নের কর্মসুচী নিলেও আমরা যাকে বলি একেবারে তৃণমূল স্তরে উন্নয়নকে পৌঁছে দেওয়ার কাজ বামফ্রন্টই করেছিল।
(দারিদ্র হ্রাস)
দারিদ্র হ্রাস এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভৌগলিক কারনেই ১৯৭৭-র আগে শহর-গ্রাম মিলিয়ে গড়ে ৬০ শতাংশের উপর মানুষ এরাজ্যে দারিদ্রসীমার নীচে ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের হিসেবে, ২০০৪-০৫ সালেই তা ২০.৫ শতাংশে নেমে গিয়েছিল।কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে, দারিদ্র্য কমার হারে দেশের মধ্যে দ্বিতীয় ছিল পশ্চিমবঙ্গ; কেরালার পরই। ষষ্ঠ এবং সপ্তম বামফ্রন্টের সময়কালে রাজ্যে আর্থিক অগ্রগতির হার জাতীয় গড়ের ওপরে থেকেছে। ২০০১-০৬ এই পাঁচ বছরে রাজ্যে আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার থেকেছে ৭.৩ শতাংশ, যা ছিল জাতীয় হার (৬.৭%) থেকে বেশি।
অর্থনৈতিক উন্নতির ফলেই ২০১০-১১ সালেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে শিল্পপণ্যের বাজার ছিল প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে।
(শিক্ষা ও স্বাস্থ্য )
১৯৭১ সালে রাজ্যে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৮.৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ শতাংশ। সর্বভারতীয় হারের চেয়ে তা অনেক বেশি।
বিকেন্দ্রীভবণ ভাবনা থেকে মানব সম্পদ উন্নয়নের ভাবনা আসে। বামফ্রন্ট সরকার শিক্ষাকে অনুৎপাদক খাতে ব্যায় মনে করেনি।
স্কুল শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষায় সুস্থ স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত করা এবং গুণমান বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে।
সবচেয়ে সাফল্য এসেছিল প্রাথমিক শিক্ষায়। রাজ্যে ছয় থেকে দশ বছর বয়সী শিশুদের ৯৯.৬ শতাংশকে স্কুলে আনা গিয়েছিল। মিড ডে মিলের আওতায় আনা গিয়েছিল ৯৬% শিশুকে। স্কুলছুটের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমে আসছিল। প্রাথমিক স্তরে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১.৮ শতাংশ। উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ৫.৪ শতাংশ।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার সুযোগ বেড়েছিল নজিরবিহীনভাবে। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ২ লক্ষেরও কম ছাত্রছাত্রী। ২০১১ সালে সাড়ে ১০ লক্ষের মতো। মেয়েরা পরীক্ষা দিয়েছে ছেলেদের চেয়ে বেশি সংখ্যায়।
মাদ্রাসা শিক্ষকদের সরকারী তহবিল থেকে বেতন, পেনশনের ব্যবস্থা, উন্নততর বেতন, পাঠক্রমের আধুনিকীকরণ, মাদ্রাসার সংশাপত্রকে বিদ্যালয় শিক্ষার সমতুল্য ঘোষণা – এসব কাজ গোটা দেশের প্রশংসা পেয়েছে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও সাফল্য নজরকাড়া।
বামফ্রন্ট সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৬ সালে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ এবং ২০০৯ সালে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ বায়োমেডিক্যাল জেনোমিক্স’ এবং ২০১০ সালে মুর্শিদাবাদে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস চালু করে।
বামফ্রন্ট সরকারে উদ্যোগেই পশ্চিমবঙ্গে ১৪টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চালু হয়েছিল একটি ডিমড বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০-র বেশি নতুন কলেজ। শুধুমাত্র সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ৭৩টি নতুন ডিগ্রি কলেজ রাজ্যে চালু হয়েছিল। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উচ্চগবেষণার সুযোগ আজ যা দেখা যায় তার প্রায় পুরোটাই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে। উচ্চশিক্ষায় সংখ্যালঘুদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার।
এরাজ্যে ১৯৭৬-৭৭ সালে ২ লক্ষেরও কম ছাত্র-ছাত্রী উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেত। ২০১১ সালে রাজ্য সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অধীনস্থ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্টানে ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে দশ লক্ষ।
নয়া উদারবাদী নীতি যখন স্বাস্থ্যকে মুনাফার উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র মনে করেছে
তখন যতটা সম্ভব সরকারের উদ্যোগে কাজ হয়েছে। ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ১৩২৬। ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২ হাজার। এইসব গ্রাম শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রই এলাকায় এলাকায় কোভিড পরীক্ষা, ভ্যাকসিনেসন এর স্থান। নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাসপাতাল প্রাথমিক কেন্দ্র কাছাকাছি থাকার ফলে
ফলে গড় আয়ু, জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হার অনেক কমেছে। পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় হারের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। গড় আয়ু জাতীয় ক্ষেত্রে পুরুষ ৬৫.৮ বছর ও মহিলা ৬৮.১ বছর। পশ্চিমবঙ্গে পুরুষের ক্ষেত্র গড় আয়ু ৬৮.২৫ বছর, মহিলাদের ক্ষেত্রে ৭০.৯ বছর। জন্মহার জাতীয় স্তরে প্রতি হাজারে ২২.৮। এরাজ্যে ১৭.৫। শহরাঞ্চলে জন্মহারের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সবার আগে -- ১২.৪। জাতীয় হার ১৮.৫। মৃত্যুহার জাতীয় স্তরে প্রতি হাজারে ৭.৪।
প্রসূতি মৃত্যুর হার জাতীয় স্তরে প্রতি লক্ষে ২৫৪ জন; পশ্চিমবঙ্গে ১৪১ ।
সরকারী হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রোগনির্ণয় কেন্দ্র চালু করে একদিকে গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষকে কিছুটা সুরাহা দেওয়া গিয়েছিল, অন্যদিকে বেসরকারী ক্ষেত্রেও খরচের উপর পরোক্ষে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয়েছিল।
(সুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশ নির্মাণ )
সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বহুত্ব ও বৈচিত্র্য বিকশিত করতে অভূতপূর্ব ভূমিকা পালন করেছে বামফ্রন্ট সরকার। । লোকসংস্কৃতির চর্চা থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র চর্চা, সাহিত্য চর্চার সুস্থ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করা গিয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিনকে উৎসাহিত করতে উদ্যোগ নিয়েছিল রাজ্য সরকার। বাংলা অকাদেমী, হিন্দি অকাদেমি, উর্দু অকাদেমি, সাঁওতালি অকেদেমি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র (২০১০ সালে উত্তরবঙ্গেও শাখা গঠিত হয়)—সবই বামফ্রন্ট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা। ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও শিক্ষার প্রসারের ফলে গ্রামাঞ্চলে নতুন নতুন অংশের মানুষ নতুন অধিকারবোধ নিয়ে সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গনে উঠে এসেছিলেন। তার জন্য যতটা সম্ভব উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিকাঠামোর তৈরির কাজে বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য নজিরবিহীন।
(শহরের কর্মসংস্থানের প্রশ্ন অসমাপ্ত থেকে গেল )
হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসে ন’শোর বেশি অনুসারী শিল্পেই দু’লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। তথ্যপ্রযুক্তিতেও কাজের সুযোগ বেড়েছিল নানা স্তরে। সিঙ্গুরেও মূল কারখানার পাশাপাশি যন্ত্রাংশ তৈরির কয়েকশো কারখানায় বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বামফ্রন্ট সরকারের কাছে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বৈষম্যকারী লাইসেন্স প্রথা যখন বড় ও মাঝারি শিল্প স্থাপনে বাধা তখন ক্ষুদ্র শিল্পে বামফ্রন্ট সরকার জোর দিয়েছে। ক্ষুদ্র শিল্পে সংখ্যার বিচারে ও কর্মসংস্থানের বিচারে পশ্চিমবঙ্গই ছিল দেশের সেরা। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে রাজ্যে প্রায় ২৮ লক্ষ ক্ষুদ্র শিল্প ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছিল প্রায় ৫৫ লক্ষ মানুষের। উপকৃত মানুষের সংখ্যা আরও কয়েকগুন বেশি। কিন্তু বড় ও মাঝারি শিল্প না এলে ক্ষুদ্রশিল্পের বিকাশ থমকে যেতে এবং পিছু হঠতে বাধ্য। তাই শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার ইঐদ্বকর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার বৃহৎ শিল্প প্রসারে গুরুত্ব দেয়।
আন্তরিকতার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার দাঁড়িয়েছি স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির পাশে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৮০ হাজার। ২০১১ সালে এই সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১৫ লক্ষে। সদস্য সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষের উপর; যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই মহিলা। দলগুলির সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। আয়ের সংস্থান বাড়ানোর লক্ষ্যে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ব্যাঙ্ক ঋণে সুদের উপর ভরতুকি দিত। গোষ্ঠীগুলিকে সুদ দিতে হত মাত্র ৪ শতাংশ। কারণ, বাকি ৭ শতাংশ সুদের টাকা ভরতুকি হিসেবে দিত রাজ্য সরকার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ধান চাল সংগ্রহের এজেন্ট হিসেবে যুক্ত করার ব্যবস্থা ছিল দেশের সামনে নতুন নজির। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার রাজ্য সরকারে পৃথক একটি দপ্তর চালু করেছিল – স্বয়ম্ভর ও স্বনিযুক্তি প্রকল্প দপ্তর।
কেন্দ্রীয় সরকারী স্বনিযুক্তি প্রকল্পতে দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ উঠে আসে এক নম্বরে। ‘প্রাইম মিনিস্টারস এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রাম’ – কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প। সবচেয়ে ভালো কাজ করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
বামফ্রন্ট সরকার শুধু রাজ্য সরকারী কর্মচারী নয়,স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী, পৌরসভা, পঞ্চায়েত, সমবায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন, পেনশন, পারিবারিক পেনশন, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, মাদ্রাসা, বিদ্যালয় প্রভৃতিতে নিয়মিত নিয়োগের প্রক্রিয়া জারি ছিল। বেতন, পেনশন, মহার্ঘভাতাতেও রাজ্য সরকার কখনই ছাঁটাই করেনি।
(বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা)
কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ালেও বামফ্রন্ট সরকার গরীব নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য ভরতুকি দিয়েছে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিদ্যুতের দাম বাড়ালে ১২০ কোটি টাকা ভরতুকি দিয়েছিল রাজ্য সরকার। ফলে ২০ লক্ষ গ্রাহকের ক্ষেত্রে মাশুল আগের চেয়ে কমে যায়।
(বাজার)
২০০৯-১০ সালে অধিক ফলনে ক্ষতিগ্রস্ত আলুচাষীদের বাঁচাতে ৪০০ কোটি টাকা ভরতুকি দেয় রাজ্য সরকার। যাতে আলুর দামের অনিশ্চয়তায় কৃষক মার না খান।
পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির আঁচ সাধারণ মানুষের উপর যতটা সম্ভব কম যাতে লাগে সেজন্য রাজ্য সরকার নিজের তহবিল থেকে ভরতুকি পর্যন্ত দিয়েছিল।
বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে খোলা বাজারের বর্ধিত আঘাত থেকে সাধারণ মাগনুষকে বাঁচাতে ২০০৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ৫১০৬ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। যার মূল্য লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মানুষের সুরাহা।
নয়া উদারবাদী কেন্দ্রীয় নীতির ফলস্বরূপ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর মূল্যবৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান চাপ প্রশমনের কোনো পরিকল্পনাই কেন্দ্রীয় সরকার নেয় নি। বামফ্রন্ট সরকার কর ধার্য করার ক্ষেত্রে চাপে থাকা সাধারণ মানুষকে যতটা সম্ভব রেহাই দেওঞয়ার চেষ্টা করেছিল।
(অসংগঠিত শ্রমিকেরসামাজিক সুরক্ষা)
বামফ্রন্ট সরকার যেভাবে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এরাজ্যে তা কংগ্রেসী আমলে ছিল অকল্পনীয়। বামফ্রন্ট সরকার অনেক আগে থাকতেই প্রতিবন্ধী ভাতা (শুরু ১৯৮০সাল), বার্ধক্য ভাতা (শুরু ১৯৭৯ সালে), আদিবাসী বার্ধক্যভাতা (একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে দেওয়া হতো), কৃষক ভাতা, বিধবা ভাতা – এরকম যে কটি ভাতা রাজ্য সরকার দিত সেগুলির টাকার পরমাণও বাড়ানো হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে উপভোক্তার সংখ্যাও।ম
১৯৯০-র দশকে যখন জাতীয় স্তরে নয়া উদারবাদী নীতির আগ্রাসী রূপ সাধারণ মানুষের উপর দ্রুত চাপ বাড়াচ্ছিল। তখন সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিতে বাড়তি জোর দেওয়া হয়।লক্ষ লক্ষ মানুষকে এইসব সামাজিক সুরক্ষামূলক প্রকল্পগুলির আওতায় কিছুটা হলেও নিরাপত্তা দেওয়া গেছে।
ভূমিহীন কৃষকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প শুরু করেছিল বামফ্রন্ট সরকারই। দেশে এর কোনো পূর্বনজির ছিল না। ১৯৯৮ সালে রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকদের মাসকাবারি আর্থিক সাহায্য দেবার একটি প্রকল্প চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যে এরকম প্রকল্পের কোনো পূর্বনজির ছিল না।
দেশের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প (সাসপফাউ) চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। পরিবহন শ্রমিকদের জন্য পেনশন ও অন্যান্য সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছিল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। প্রায় ২৫ লক্ষ পরিবহন শ্রমিকের জন্য রাজ্য সরকার নিজের উদ্যোগ। বিড়ি শ্রমিকদের জন্য চালু করা হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্প’। কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পেও শ্রমিকদের দেয় বাবদ অর্থ দিয়ে দিত রাজ্য সরকার। সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে দিতে হতো না। নির্মান কর্মীদের জন্যও পেনশন, পারিবারিক পেনশন, গৃহনির্মানে সাহায্যের মতো একগুচ্ছ কল্যাণ মূলক প্রকল্প চালু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। গঠন করা হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কর্মী কল্যাণ পর্ষদ’। বামফ্রন্ট সরকার ২ কোটি ৬৪ লক্ষ গরিব মানুষকে ১টাকা কোজি দরে চাল দিত। শুধু বি পি এল নয়, এ পি এল-র দরিদ্র মানুষেরও এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ‘‘শহরাঞ্চলের হকার সংক্রান্ত নীতি’’ (অক্টোবর ২০১০) গৃহীত হয়েছিল। হকারদের আইনী স্বীকৃতি দেওয়া ও হকারদের স্বার্থরক্ষায় অভূতপূর্ব পদক্ষেপ।
(বাসস্থান--)
আবাস যোজনায় গরীব মানুষের জন্য পাকাবাড়ি এবং পারিবারিক শৌচাগার নির্মান প্রকল্পে বামফ্রন্ট সরকার ধারাবাহিক গুরুত্ব দিয়েছে। আবাসন দপ্তর ২০০৯ সালে দরিদ্রদের জন্য ‘আমার বাড়ি’ প্রকল্প গ্রহণ করে। বস্তির উন্নয়নে এবং বস্তির মানুষের জন্য নতুন বাড়ি তৈরির জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করেছিল নগর উন্নয়ন দপ্তর। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট (২০১০) অনুযায়ী, গ্রামাঞ্চলে গরিবের জন্য বাড়ি তৈরিতে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে প্রথম তিনটি রাজ্যের মধ্যে স্থান করে নেয়। সংখ্যালঘু গরিব মানুষের জন্য বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে তখন রাজ্য ছিল দ্বিতীয় স্থানে। বামফ্রন্ট সরকারই ‘ও বি সি’-দের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছিল। সংরক্ষণের সুযোগ প্রসারিত করেছিল। গরিব মুসলিম জনগোষ্ঠীদেরও ‘ও বি সি’ হিসেবে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে এসেছিল। এক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকারই দেশে পথিকৃৎ।
(উদারনীতি ঘোষনার পর )
কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি ঘোষণার পর সার্বিকভাবে পরিস্থিতি বিচার করে বামফ্রন্ট সরকার নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের ২৩ সেপ্টেম্বর রাজ্য সরকারের ‘শিল্পায়ন সংক্রান্ত নীতি বিবৃতি’ ঘোষিত হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে শিল্প বিনিয়োগের পরিমাণের প্রশ্নে এই রাজ্য উঠে আসে দেশের মধ্যে তিন নম্বর স্থানে। বিনিয়োগ আসে পেট্রোকেমিক্যালস, তথ্য প্রযুক্তি, লৌহ ও ইস্পাত, ম্যানুফ্যাকচারিং, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো মতো ক্ষেত্রগুলিতে। ২০০৫ সালে রাজ্যে বিনিয়োগ এসেছিল ২৫১৫.৫৮ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৭২.২৬ কোটি টাকা। ২০০৮ সালে মন্দার বছরেও ৪৪৩৪.৫০ কোটি টাকা। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছিল ১৫হাজার ৫২ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা।
(নগরোন্নয়ন)
পরিকল্পিত নগরোন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় শিলিগুড়ি, দুর্গাপুর, আসানসোল শিল্পাঞ্চল, খড়গপুর প্রভৃতি অঞ্চলে। নতুন বিমান বন্দর তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় অন্ডালে।
কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক ও যুক্তরাষ্ট্রিয় কাঠামো রক্ষার লড়াই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থবরাদ্দের মূল দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। ন্যায্য কারণেই বামফ্রন্ট সরকার দাবি করেছিল, রাজ্য থেকে সংগৃহীত সম্পদের অন্তত ৫০ শতাংশ রাজ্যের হাতে তুলে দেওয়া হোক। কেন্দ্র শোনে নি। তা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট সরকার সম্পদ সংগ্রহের প্রশ্নে সবসময় দরিদ্রতর মানুষকে রেহাই দিতে চেষ্টা করেছে এবং এই অংশের মানুষের প্রয়োজনের কথা বিবেচনায় রেখেই সম্পদের সিংহভাগ বরাদ্দ করেছে। সম্পদ বন্টনের সিংহভাগ বরাদ্দ করা হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রগুলিতে। পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে। কোষাগারের উপর বাড়তি চাপ সহ্য করেছে রাজ্য সরকার। জিএসটির পরিকল্পনাও ছিল অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের। যা এখন রাজ্যগুলির নিজস্ব আয় বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। ফলে এখন রাজ্য সরকার গুলো নানাভাবে সাইকেল, সরাসরি টাকা ইত্যাদি দিতে সক্ষম হচ্ছে।
শিল্প হলে যেমন ছিল কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত হয়, তেমনই রাজ্য সরকারের সম্পদ সংগ্রহের সুযোগ বাড়ে। সংগৃহীত বাড়তি অর্থ তখন জনকল্যাণে বরাদ্দ করা যায়। শিল্পায়নে বাধা দিলে রাজ্য সরকারের সম্পদ সংগ্রহের সুযোগকেও বাধা দেওয়া হয়।
এই সময়কালের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যা যা কেন্দ্রীয় ভাবে তৈরি হচ্ছিল এবং গত পাঁচ ছয় বছরে ক্রমশ তা সাধারন গরীব মানুষের ব্যক্তি পরিচিতি ও অস্তিত্ব রক্ষার কৃত্রিম সংকট নির্মিত হয়েছে, সেই সময়কে প্রতিহত করে পশ্চিমবঙ্গের মত দেশভাগ পীড়িত রাজ্যে বামপন্থীদের নির্বাচনী সাফল্য হয় নি। কিন্তু বামপন্থার প্রভাব ও দৈনন্দিন জীবনে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ভাবনার প্রকাশ বজায় থাকবে। সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিকাশের যায়গা নেই। বাংলার নবজাগরণের হাত ধরে বামফ্রন্ট সরকারের কর্মসুচী পর্যন্ত অনেক দোষ ত্রুটির মধ্যেও এক উদাহরণ যোগ্য মানবোন্নয়নের সন্ধান দেবে।