Tranding

03:21 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / উগ্র জাতীয়তাবাদ , পপুলিস্ট অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাই শ্রীলঙ্কার সংকটের কারণ

উগ্র জাতীয়তাবাদ , পপুলিস্ট অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাই শ্রীলঙ্কার সংকটের কারণ

সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেওয়ার মতো নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেওয়ার মতো নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। স্বৈরাচারী মানসিকতা শ্রীলঙ্কা সংকটের মূল কারণ চীনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণসহ বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেতাই করা থেকে শুরু করে পরিণাম না ভেবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর দেউলিয়া হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর পরও ভ্যাট অর্ধেকে নামিয়ে আনা, পুরো কৃষিকে জৈবকৃষিতে রূপান্তর করার মতো উদ্ভট চিন্তাগুলো এসেছে রাজাপক্ষেদের স্বৈরাচারী মানসিকতার কারণে। এটাই আসলে শ্রীলঙ্কার সংকটের প্রধান কারণ।

উগ্র জাতীয়তাবাদ , পপুলিস্ট অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাই শ্রীলঙ্কার সংকটের কারণ

উগ্র জাতীয়তাবাদ , পপুলিস্ট অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অদূরদর্শিতাই শ্রীলঙ্কার সংকটের কারণ


10th july 2022
এমন একটা প্রচার করা হচ্ছে যেন শ্রীলঙ্কায় এবারই শুধু ঋণ নেওয়া হয়েছে আর সেই ঋন দিয়েছে শুধু চীন। এ কথা ঠিক নয়।বহু আগে থেকেই ঋণের জালে  আটকে ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এমন সংকট আসেনি। 


বর্তমান সরকারের অপদার্থতার কারণেই আজ এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছে তারা। বলছেন অর্থনীতিবিদেরা। 
মরার উপর খাঁড়ার ঘা। এক বাক্যে এটাই  শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা। অর্থনীতিবিদদের মতে, একদিকে কোভিড, অন্যদিকে রাজাপাকসে সরকারের ভুল নীতির কারণেই আজ শ্রীলঙ্কা এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। 


কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক অমিরথালিঙ্গম ডিডাব্লিউকে তার মতামত জানিয়েছেন। তার বক্তব্য, ''অনেকেই বলছেন, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। সে কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, গত ৬৭ বছর ধরেই ঋণের জালে জড়িয়ে আমাদের দেশ। এ কোনো নতুন ঘটনা নয়। বর্তমান সমস্যা বুঝতে হলে সরকারের অপদার্থতার বিষয়টি বুঝতে হবে।'' একই সঙ্গে তার বক্তব্য, কোভিডও শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক সংকটের দিকে আরো বেশি ঠেলে দিয়েছে। 

অমিরথালিঙ্গমের বক্তব্য, প্রতি বছর কেবলমাত্র পর্যটন থেকে শ্রীলঙ্কা পাঁচ থেকে সাত বিলিয়ন ডলার রোজগার করে। গত দুই বছরের কোভিডকালে সেই রোজগার কার্যত শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে। ২০১৯ সালে কলম্বোয় হামলাও পর্যটনে মার খাওয়ার অন্যতম কারণ। শ্রীলঙ্কার মতো দেশের জন্য যা অপূরণীয় ক্ষতি। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা রোজগারের ক্ষেত্রে বিপুল ক্ষতি হয়েছে শ্রীলঙ্কার। এখানেও কোভিড একটি বড় কারণ। বিদেশে কাজ করা বহু শ্রীলঙ্কার মানুষের চাকরি চলে গেছে। কাজের পরিসর কমেছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে সংস্কারের নামে চরম গাফিলতি করেছে রাজাপাকসের সরকার। অমিরথালিঙ্গমের অভিযোগ, ''সরকার বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের রেট নিজেদের মতো করে রেগুলেট করার চেষ্টা করেছে। সেটা করতে গিয়ে তারা কালোবাজারির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।''


অর্থনীতিবিদের বক্তব্য, শ্রীলঙ্কার সরকার কোনোদিক বিবেচনা না করে এক ডলার ২০৩ শ্রীলঙ্কার মুদ্রায় বেঁধে দিয়েছিল। অথচ বাজারে তখন এক ডলার বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৬৬ শ্রীলঙ্কার মুদ্রায়। ফলে অধিকাংশ মানুষ বেশি রোজগারের আশায় কালো বাজারে বিদেশি মুদ্রা ভাঙিয়েছেন। যার জেরে দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রীলঙ্কার ব্যাংক-- প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রা থেকে তাদের রোজগার কমেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রা, অর্থাৎ ডলারের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থেকেছে। অমিরথালিঙ্গমের মতে, ৯০ শতাংশ বিদেশি মুদ্রা কালো বাজারে চলে গিয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অন্যতম নিরপেক্ষ থিংকট্যাঙ্ক অ্যাডভোকাটা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা কে ডন ভিমাঙ্গা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, অধ্যাপক অমিরথালিঙ্গমের সঙ্গে তিনি সহমত। তার বক্তব্য, শ্রীলঙ্কার প্রাইমারি ব্যালেন্স বরাবরই ঋণাত্মক ছিল। ট্রেড ডেফিসিটও দীর্ঘদিন ধরে ঋণাত্মক। তা সত্ত্বেও এমন অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে, এমনটা মনে হয়নি। কিন্তু বর্তমান সরকারের ভুল নীতি পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটাই ধসিয়ে দিয়েছে। তার কথায়, ''ব্যাংকের হাতে বিদেশি মুদ্রা নেই। ফলে তারা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। বিদেশ থেকে ওষুধ, তেল, কয়লা, খাবার ইত্যাদি কিছুই রপ্তানি করতে পারছে না। ফলে বাজারে জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। অধিকাংশ জিনিস পাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশি সাহায্য না এলে এই পরিস্থিতি থেকে শ্রীলঙ্কা উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এবং এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী বর্তমান সরকার।''

ভিমাঙ্গা এবং অমিরথালিঙ্গম দুইজনেরই বক্তব্য, বর্তমান সরকারের চীনমুখী নীতিও অর্থনৈতিক সংকট আরো প্রবল করেছে। চীনের থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। সেই ঋণের টাকায় সমুদ্রবন্দর এবং বিমানবন্দর তৈরি হয়েছে। ঋণের টাকায় তৈরি হয়েছে ক্রিকেট স্টেডিয়াম। অথচ সেখান থেকে যতটা রোজগারের কথা সরকার ভেবেছিল, তার অর্ধেকও হচ্ছে না। ফলে আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে ঋণ পরিশোধ করতে। পরিস্থিতি এমনই হয়েছে যে, চীনকে সমুদ্র বন্দর ৯৯ বছরের লিজে দিয়ে দিতে হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ, রাজাপকসে পরিবার সমস্ত অর্থনীতির তত্ত্বকে উপেক্ষা করে প্রতিদিন ঋণের বোঝা বাড়িয়ে গেছে কিন্তু তা পরিশোধের উপায় চিন্তা করেনি। যার জেরে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

উগ্র জাতীয়তাবাদের ব‍্যবহার 

সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেওয়ার মতো নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেওয়ার মতো নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা।
স্বৈরাচারী মানসিকতা শ্রীলঙ্কা সংকটের মূল কারণ চীনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণসহ বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে যাচ্ছেতাই করা থেকে শুরু করে পরিণাম না ভেবে তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর দেউলিয়া হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর পরও ভ্যাট অর্ধেকে নামিয়ে আনা, পুরো কৃষিকে জৈবকৃষিতে রূপান্তর করার মতো উদ্ভট চিন্তাগুলো এসেছে রাজাপক্ষেদের স্বৈরাচারী মানসিকতার কারণে। এটাই আসলে শ্রীলঙ্কার সংকটের প্রধান কারণ।


স্বৈরতন্ত্রের প্রকাশ

গুম, অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলার মাধ্যমে বিরোধীদের দমন, সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিগত মতপ্রকাশের ওপর তীব্র চাপ, চরম দুর্নীতি, ইস্টার বোমা হামলার অজুহাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর তীব্র বিদ্বেষ সৃষ্টি আর বিচ্ছিন্নতাবাদী ইতিহাসের কারণে হিন্দু তামিলদের প্রতি বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেওয়ার মতো নানা অগণতান্ত্রিক কাজ করেছেন রাজাপক্ষে ভাইয়েরা। ক্ষমতায় এসেই দুই ভাই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা নিয়ে কোনো রাখঢাক করেননি; রীতিমতো সাংবিধানিক সংশোধনীর মতো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন (১৮ ও ২০তম সংশোধনী)।

স্বৈরাচারী শাসন নিশ্চিতে শ্রীলঙ্কার সংবিধান সংশোধন
সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে শ্রীলঙ্কায় একটি সাংবিধানিক কাউন্সিল ছিল। এটি গঠিত হতো সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য এবং নাগরিক সমাজের সদস্যদের (৩ জন) নিয়ে। প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট ও আপিল আদালতের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল নিয়োগ করত এই কমিশন। এ ছাড়া দেশের সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন কিছু কমিশন, যেমন নির্বাচন কমিশন, অডিট কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জাতীয় প্রকিউরমেন্ট কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনও নিয়োগের এখতিয়ার ছিল সেই সাংবিধানিক কাউন্সিলের। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর ক্ষেত্রে এটা এক অসাধারণ অনুকরণীয় পদক্ষেপ ছিল।

২০তম সংশোধনীতে গোতাবায়া রাজাপক্ষে এই সাংবিধানিক কাউন্সিল বিলুপ্ত করে দেন। এর জায়গায় আনা হয়েছে সংসদীয় কাউন্সিল, যাতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই সংসদীয় কাউন্সিলকে শুধু পর্যবেক্ষকের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে; তারা শুধু মতামত দিতে পারবে। এখন প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়োগ দিতে পারেন।


২০তম সংশোধনীতে খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে প্রেসিডেন্টের সব কর্মকাণ্ডকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া হয়েছে; তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি অভিযোগ আনা যাবে না। অথচ ১৯তম সংশোধনীতে এটা করা যেত। প্রেসিডেন্টকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া এবং সাংবিধানিক কাউন্সিলকে প্রথম বিলুপ্ত করা হয় ২০১০ সালে, প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের সময়, সংবিধানের ১৮তম সংশোধনীতে। মাহিন্দা তাঁর ছোট ভাই গোতাবায়ার চেয়ে আরেকটি কাজ বেশি করেছিলেন, একজন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না—এ বাধ্যবাধকতা বাতিল করেছিলেন। ১৯তম সংশোধনীতে এটা আবার যুক্ত হয়, কিন্তু গোতাবায়া এটাকে আবার বাতিল করেননি।

শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টের হাতে কোনো মন্ত্রণালয় থাকা বাতিল করা হয়। কিন্তু ২০তম সংশোধনীতে সেটা আবার ফিরিয়ে আনা হয় এবং গোতাবায়া রাজাপক্ষে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রেখেছেন নিজ হাতে।

গোতাবায়ার ২০তম সংশোধনীতে প্রেসিডেন্টকে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যক্তিদের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আগের সংশোধনীতে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা নির্দিষ্ট করা থাকলেও এ সংশোধনী অনুযায়ী তিনি যত ইচ্ছা ততজন মন্ত্রী নিয়োগ দিতে পারবেন। এর চেয়েও বড় কথা, এ সংশোধনীতে মন্ত্রিসভা গঠনে প্রধানমন্ত্রীকে স্রেফ একজন পর্যবেক্ষক বানিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো সময় সংসদ ভেঙে দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্টকে। ১৯তম সংশোধনীতে সাড়ে চার বছরের আগে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভাঙতে পারতেন না।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার দাবিতে শ্রীলঙ্কার তরুণেরা আন্দোলন করেছেনঅর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার দাবিতে শ্রীলঙ্কার তরুণেরা আন্দোলন করেছেন

শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী প্রেসিডেন্টের একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা কমিয়েছিল, গণতন্ত্র শক্তিশালী করার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। বলা হয়, এ সংশোধনী শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় এক বিরাট মাইলফলক এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনীয় অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। এ সংশোধনী হয়েছিল ২০১৫ সালে, যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাইথ্রিপালা সিরিসেনা আর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে (যিনি  আবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)।


শ্রীলঙ্কার স্বৈরশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা
কোনো দেশে সামরিক কিংবা বেসামরিক একনায়কতন্ত্র টিকে থাকার জন্য আসলে অতি শক্তিশালী কারও পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। স্নায়ুযুদ্ধকালে পৃথিবীর অনেক দেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে বিশেষ করে সামরিক একনায়কত্ব ক্ষমতা দখল করতে ও টিকে থাকতে পেরেছিল তৎকালীন মার্কিন সরকারের নীতির কারণে। তখন সমাজতন্ত্র নিয়ে গোটা বিশ্বের আবেগের সময়। মার্কিনরা দেখেছিল, একটা দেশে গণতান্ত্রিক আবহাওয়া খুব ভালোভাবে বিরাজমান থাকলে সেখানে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ মাথাচাড়া দেয়, তাই স্বৈরশাসকের হাতে ক্ষমতা দিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শকে পিছিয়ে দেওয়ার নীতি ছিল তখনকার মার্কিন সরকারগুলোর নীতি। 


শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি প্রতিবেশী দেশ গুলির উপর কীভাবে পড়বে? প্রতিবেশী দেশগুলি শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য আদৌ কি দায়ী? শ্রীলঙ্কার অবস্থা উপমহাদেশের কূটনীতিতে কি কোনো বদল আনবে? সংবাদমাধ্যম থেকে কূটনৈতিক মহল-- সর্বত্র এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা চলছে। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ রায় বিষয়টিকে কূটনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইছেন। তার মতে, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেয় সার্ক আসলে কতটা অকেজো। ''দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিকে নিয়ে সার্ক তৈরি হয়েছিল অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য। কিন্তু শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, সংকট মোকাবিলায় প্রতিবেশীদের বিশেষ কিছু করার থাকে না।'' ইন্দ্রজিতের মতে, ভারত-পাকিস্তান-চীনের সম্পর্কের টানাপড়েন সার্কের মূল ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা সংকটে তা আরো প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে। সার্ক দেশগুলির মধ্যে ভারত এবং চীনের মধ্যে বিনিয়োগের লড়াই চলছে। যার মাঝে পড়ে সমস্যা বাড়ছে শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলির। 

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের মতে , শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার কার্যত একটি পরিবারের হাতে কুক্ষিগত ছিল। তাদের দুর্নীতির কথা সামনে এসেছে। বিদেশেও তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির কথা শোনা যাচ্ছে। এই সবকিছুই শ্রীলঙ্কাকে ক্রমশ এই ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। 


 সমাধানসূত্র সহজ নয়, একথা সকলেই মনে করেন। কলম্বোর দুই বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, ভারত যেভাবে শ্রীলঙ্কার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট, শ্রীলঙ্কাকে এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে ফের ভারতমুখী নীতি নিতে হবে। তবে একইসঙ্গে তাদের বক্তব্য, ভারত গ্রান্ট দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে বাঁচানোর জায়গায় নেই। ভারতের অর্থনীতি তত মজবুত নয়। ভারত সফট লোন বা ঋণ দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে সাময়িক সাহায্যের ব্যবস্থা করছে। এক বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তেল পাঠানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কার ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ানোর জন্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ৪০০ মিলিয়ন ডলার কারেন্সি সোয়াপের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু এসব কোনো কিছুই সুদূরপ্রসারী সুবিধা দিল না। শ্রীলঙ্কাকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন। বর্তমান সরকারের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না ।

আবার গতকাল শ্রীলঙ্কায় যা ঘটে গেল দ্বিতীয়বার রাজাপক্ষে সরকারের পতন ঘটল এবং সম্ভবত স্থায়ীভাবেই রাজা পক্ষে সরকার আর থাকছে না। বিক্রম সিংহের তিনি চীন বিরোধী হিসেবেই সরকার বসেছিলেন কেউ কেউ ভেবেছিল চীনের বিরুদ্ধে একটা প্রচার চালিয়ে শ্রীলঙ্কায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে তারই নজির হিসেবে বিক্রম সিংহে কে বসানো হয়েছিল। গতকাল জনগণ তো কিছুই মানলেন না। 

Your Opinion

We hate spam as much as you do