Tranding

02:15 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে --

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে --

সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতে কন্যাভ্রনহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এহেন দরিদ্র চৈতন্যের দেশে মেয়েদের ক্ষমতায়ন ? মেয়েদের জন্য বরাদ্দ কম আলো , কম শিক্ষা, কম পুষ্টি, যাতে ইটচাপা ঘাসের মতই পেলব ও পরাধীন হয়ে বড় হয় মেয়েগুলো।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে --

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে --

"ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রশ্নমুখর মন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে প্রখর ( মুখর নয় ) হ্য়ে উঠেছে । মনে হয়েছে মানুষে মানুষে ব্যবহারে এমন পার্থক্য কেন ? এমন অনেক কেনই আমাকে পীড়িত করেছে। বেশি পীড়িত করেছে মেয়েদের অবস্থা । কেন তাদের সকল বিষয়ে এমন অধিকারহীনতা?  কেন তাদের জীবন কাটে অবরোধের অন্ধকারে? " 
লোকপ্রিয় সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী তাঁর ছেলেবেলা থেকেই জিজ্ঞাসু তাঁর চারপাশের সমাজের নিয়ম নিগড়ের প্রতি - এ সমাজ বিশ শতকের প্রথম দশকের বঙ্গীয় সমাজ। লেখিকার সময়ে তেমনভাবে তথাকথিত নারীবাদের জন্ম হয় নি। কিন্তু অসাম্য আর অধিকারহীনতার প্রশ্নে সেই বিশ শতকের শুরু থেকে একবিংশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত অনধীকারিনীই হয়ে আছে।
কথাটা লিখতেই হচ্ছে, বেদনাসঞ্জাত এই উপলব্ধি সময় প্রবাহের মধ্যে দিয়ে স্বরূপ পাল্টেছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের ওপর সামাজিক বিবর্তনজনিত প্রভাব বহু রঙ নিয়ে বহু আকার নিয়ে নানাভাবে ক্রীয়াশীল হ্য়েছে। ঔপনিবেশিক ভারতের পিতৃতান্ত্রিক উত্তরাধিকার আজও আমাদের সমাজ বহন করে চলেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিস্পর্ধী যে মুক্ত সমাজ তা তো একটা স্বপ্নই হয়ে থেকে যাবে। আশাপূর্ণা দেবী কথিত ভারতীয় তথা বঙ্গীয় সমাজে অবরোধের অন্ধকার কেটে, উত্তর স্বাধীন ব্রিটিশমুক্ত সমাজে নারী জীবন সংগ্রামে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে ঠিকই । দূর্ভাগ্যজনকভাবে মেয়েদের বহিঃজগতে পা রাখাকে সমাজ অনস্যুত পিতৃতন্ত্র কোনোদিন ভালো চোখে নেয়নি। সমাজের প্রতি , সংসারের প্রতি তাদের অবদানকে অবজ্ঞা  করা হয়েছে ,খাটো করা হয়েছে। এর অজস্র দৃষ্টান্ত আছে সাহিত্যে, সমাজে , ইতিহাসে।
আন্তর্জাতিক নারী ক্ষমতায়ন বর্ষ ছিল ২০০১। আমাদের সমকালের অন্যতম প্রখ্যাত কবি মল্লিকা সেনগুপ্তের কথাকটি মনে পড়ছে প্রসঙ্গত। তিনি বলছেন একবছর কালের প্রতিকী সময়খন্ড পার করে এসে এটা বলা সমীচীন হবেনা যে women's empowerment অনেকটাই হয়ে গেল। প্রশ্ন হল যে "ক্ষমতায়ন যে জরুরী এই চেতনাই বা কতটুকু প্রসারিত হল ?" সারা পৃথিবীর মধ্যে ভারতে কন্যাভ্রনহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এহেন দরিদ্র চৈতন্যের দেশে মেয়েদের ক্ষমতায়ন ? মেয়েদের জন্য বরাদ্দ কম আলো , কম শিক্ষা, কম পুষ্টি, যাতে ইটচাপা ঘাসের মতই পেলব ও পরাধীন হয়ে বড় হয় মেয়েগুলো।ঔপনিবেশিক দাসত্বের মনোভাব ও পুরুষতন্ত্রের জাঁতাকল পড়ে যখনই লক্ষনরেখা (সামাজিক অনুশাসন) অতিক্রম করতে চেয়েছে মেয়েরা, একবার নয় বারবার রক্তাক্ত হতে হয়েছে । নারীর ক্ষমতায়ন সুত্রেই বলতে পারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের নেতৃত্বে থাকাতেও সাধারণ মেয়েদের অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। কেন হয়নি ? কারন ক্ষমতায়ন নেই নারীর ।২০০১ সালের যে তথ্য আছে নারীশোষনের পরিসংখ্যানের , ২০২১ সালের আজকের দিনটি পর্যন্ত তা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুন। যেমন ১০০০ পুরুষ প্রতি ৯৩০ জন নারী ( এখন একটু বেশি ৯৪০) প্রতি ৫৪মিনিটে একজন ধর্ষিতা হচ্ছে , গড়ে দিনে ৮৭জন ধর্ষিতা হচ্ছে । সংঘটিত অপরাধের মোট ৭.২ % অপরাধ হল মহিলাদের প্রতি । 
*মুসলিমদের ক্ষেত্রে তালাক প্রাপ্ত ৬৫% (২০০১) যদিও বহু আলোচিত, সংবাদের শিরোনামে উঠে আসা সেই শিউরে উঠা ঘটনা রূপ কানোয়ারের সতী হওয়া এবং তাকে একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থনের কথা,বিতর্কিত ফায়ার ছবির বিরুদ্ধে মৌলবাদী আক্রমণ, ওয়াটার ছবিতে বারানসীর হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থার বাস্তবচিত্র দেখাতে না দেওয়ার জন্য হামলাবাজি এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য নারীর পণ্যায়নের দিকে নানা ছলচাতুরীতে মেয়েদের সৌন্দর্যকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে তাদের ভুল লক্ষের দিকে ঠেলে দেওয়া-  তবূও এই ঘটনাগুলি আমাদের এ জন্মের মত ভোলা সম্ভব নয়।
এভাবেই সময় প্রবাহে ভারতবর্ষ নামক বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশে নানা বৈষম্য ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় মেয়েদের জীবনে নেমে আসে। সুদূর অতীত থেকে একবিংশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত মেয়েদের লড়াই সংগ্রাম, অধিকারহীনতার ধারাবাহিকতা আজ একটা কদর্য জটিল অন্ধকারের মধ্যে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০২০ সালে নেমে এসেছে বিশ্বমারীর অভিশাপ - পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে এর সংক্রমণ এড়াতে রাষ্ট্রগুলি লকডাউনে বা অবরুদ্ধ জীবনে প্রবেশ করিয়েছে মানুষকে । এমনিতেই লগ্নিপুঁজির দাপটে বিশ্বায়নের ফলে সমাজমন বদলেছে। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির উদারতার আলোয় মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে গেছে , চরম ভোগবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছি আমরা , বহুজাতিক সংস্থা শপিং মলের দৌলতে এখন আর কিছুই অলভ্য নয়। দেশের বাজার পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হাতে। খনি , ইস্পাত , জল , অরণ্য দেশের এইসব সম্পদ এখন আমাদের নয়। রেল বেসরকারিকরণের ব্যবস্থা পাকা। কর্মসংস্থান নেই, শিল্পোন্নয়ন নেই , ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন , তদুপরি কৃষিবিল বিরোধী শূন্য সংসদে পাশ হয়ে যাওয়া এবং কৃষকদের ১০০দিনের অবস্থান বিক্ষোভের অসহনীয় লড়াই । লকডাউন কালে আমরা দেখেছি এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে দিশেহারার মত পথ অতিক্রম করছেন কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিক । এদের জীবনে বাঁচার কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। দিশাহারা সমাজ , অর্থনীতি বিশ্বমারী মোকাবিলায় উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে রোগী থেকে চিকিৎসক ,সেবিকা ,পুলিস ,প্রশাসক , আধিকারিক সকলেই বিপর্যস্ত, নিরুপায়, অসহায় । এই বিধ্বস্ত, পর্যুদস্ত, অর্ধমৃত, বিপন্ন সমাজজীবনে নারীর বিপন্নতা বহুগুন বেড়েছে । গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়েছেন বহু মহিলা , কাজ নেই ,খাবার নেই , মাথার ওপর ছাদ নেই , এমতাবস্থায় তৈরি হচ্ছে অসহিষ্ণুতা , একদিকে ভোগবাদের হাতছানি অন্যদিকে খিদে , ইচ্ছাপূরণ না হওয়ার জ্বালা, এই দুই এর শিকার হচ্ছেন ক্ষমতাহীনারা , নারীরা । পঙ্কিল রাজনীতির গর্ভ থেকে উঠে আসছে সাম্প্রদায়িকতার অসুস্থ চেতনা। যার অবশ্যম্ভাবী ফল সমাজে দূর্বলতর দরিদ্র শ্রেনীর মানুষ আর ক্ষমতাহীনা মেয়েদের ওপর অকথ্য নির্যাতন - এই চৈতন্যের অন্ধত্ব নির্মাণের কারিগর যে রাষ্ট্র,  সে আর মানুষের জন্য নয়,তার ধারকবাহকরা দেশের মানুষের অসহায়তা অনুধাবনের প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেন না , বরং তারা হাতের শেষ অস্ত্র হিসাবে ধর্মীয় আবেগের উন্মত্ততায় বেঁহুশ করে রাখতে চাইছেন মানুষকে। পৌরানিক রাজা যিনি কিনা ছিলেন অবতার ,তাঁর শাপগ্রস্থতা ঘোচানোর জন্যই কেবল একটার পর একটা অন্যায়  করেছেন প্রিয়তমা পত্নীর চরিত্র জেনেও তাকে প্রজানুরঞ্জনের অগ্নিতে প্রবেশ করিয়েছেন তাঁর বিশুদ্ধতা প্রভাবের লক্ষে , সেই বিতর্কিত পুরুষের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এরা রামমন্দির স্থাপন করছেন বিপুল অর্থব্যয়ে । আর এই উন্মত্ততার জঠর থেকে উঠে আসা অন্ধকার চৈতন্য আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে পিছনের দিকে। রক্তাক্ত হয়ে গোঙাচ্ছে নির্ভয়া , কাতরাচ্ছে হাথরাস , উন্নাও , ছিন্নভিন্ন হচ্ছে কাঠুয়া বালিকা আসিফা । একবিংশশতকে অনেক সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাবার কথা মেয়েদের - যেখানে আমার রাজ্যে আজ ২০২১ এ আর একটা নারী দিবসের প্রাক্কালে খবর আসে নিত্যনৈমিত্তিক আদিবাসী, খেটে খাওয়া শ্রেনীর মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার,বালিকা,শিশু ধর্ষণের কদর্য রিরংসার ! এইভাবে আর কতকাল ধরে সমাজ সংসারে ভোগলাঞ্ছিতা হবে মেয়েরা ?
অতএব চাই সেই সমাজ চাই সেই দেশ যেখানে মেয়েরা পুরুষের সাথে সমানাধিকার প্রাপ্ত হবে,অত্যাচার,শোষণের অভিমুখে থাকা সাধারন মানুষ নারীপুরুষ নির্বিশেষে যৌথ লড়াই যেদিন কন্যা জন্মানোর আনন্দে আক্ষরিক অর্থে উদ্বেল হবেন একজন পিতা, মুক্তপাখার মত ভেসে বেড়াবে সেই মেয়ে পুরুষের না পুরুষতন্ত্রের থেকে ছিনিয়ে আনা অর্ধেক আকাশ ।
 * তথ্য সুত্র- পুরুষ নয় পুরুষতন্ত্র/ মল্লিকা সেনগুপ্ত 
 

Your Opinion

We hate spam as much as you do