১৯৭৫-এ শাসকদল পলিটিক্যাল সোসাইিটর একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ কোরে গনতন্ত্রের ওপর আক্রমন নামিয়ে এনেছিল । মোদির শাসনকালে একইসঙ্গে সিভিল ও পলিটিক্যাল সোসাইিটর নিয়ন্ত্রণ কােরে আরএসএস-এর পরিকল্পনা মতো ভারতে একটি ‘ হিন্দুরাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগঠিত ও ধারাবািহক প্রচেষ্টা চলছে । সরকারে থাকার সুবাদে আরএসএস-এর লােকেরা সেই উদ্দেশ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সব ধরেনর মিডিয়া ইত্যাদি ‘কালচারাল অ্যপারেটাসগুলিকে ব্যবহার করে ‘হিন্দুত্ববাদী’ মতাদশর্গত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ।
ইমারজেন্সি! তখন ও এখন (গনতন্ত্রের বিপদ বেড়েছে)
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা গান্ধী যখন ইমারজেন্সি জারী করেলন, তখনও কী হতে যাচ্ছে তা আমার মোত এক কিশোরের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব ছিলনা । ২৬ জুন রাতের দিকেবাড়ির ভালভ সেট রেডিওর দৌলতে, বিবিসি-সর্ট-ওয়েভ-এর শেŀর কমা-বাড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে, রেডিওতে কান পেতে, অনেক ধৈর্য ধরে শোনার পরে জানা গেল : জয়প্রকাশ নারায়না , মোরারজি দেশাই, অটলিবহারী বাজপেয়ী, জর্জ ফার্নান্ডেজ, জোতির্ময় বসু সহ আরওঅনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে ।
তার আগে ১৯৭২ থেকেই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে কমিউনিস্ট বিরোধী আধা-ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস । যার বিস্তার ঘটল ইমারজেন্সিতে । ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস শুরু হয় প্রথম কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে তারপরে তা নেমে আসে সমাজের সব অংশের মানুষদের ওপর । তখন ঐ বয়েস বুঝতে পারিনি ‘আধা-ফ্যাসিস্ট কেন বলা হচ্ছে ? পরে ফ্যাসিবাদের চর্চা করতে গিয়ে জেনেছিলাম ফ্যাসিস্ট শাসন কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার । ১৯৭২ থেকেই শতাধিক সিপিআইএম কর্মী এলাকা ছাড়া হেয় শুধু আমাদের নৈহাটিতেই আশ্রয় নিয়েছন । কেউ কেউ আমাদের পাড়াতেও । সিপিআইএম নেতা গোপাল বসুও প্রাক্তন বিধায়ক অজিত বসুর বাড়িতেই প্রায় ২৫-৩০ জন । গোটা পার্টিটাই তখন একটি পরিবার বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছিল । নাহলে ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট ঐরকম সাফল্য পেল কিভাবে ?
ইমারজেন্সির সময় প্রেস সেন্সারিশেপর দাপটে সত্য জানার উপায় ছিলনা । সবই অ্যাকর্ডিং টু ম্যাডামস ডিসায়ার। আকাশবানীর খবর ১৫ মিনিটের মধ্যে অন্তত ১০ মিনিটের ইন্দিরা-সঞ্জয়ের বানী । বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে রেডিয়ো মারফত্ কিছু খবর পাওয়া যেত । প্রেস সেন্সারিশেপর মধ্যেও তখনকার সান্ধ্য ‘গণশক্তি’, ‘সতযুগের’এর ভূমিকা চিরস্মরণীয় । বরুণ সেনগুপ্ত ও গৌরিকেশার ঘোষের গ্রেফতারের সংবাদ ‘গণশক্তি’ ছেপেছিল ‘আনন্দবাজার’ নয় । সারাদেশ ২০৮টি দৈনিক পত্রিকা ও ১৮৩৪টি সাপ্তাহিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল । মাকর্স-এঙ্গেলস-লেনিন থেকে গান্ধী- রবীন্দ্রনাথ - নেহরুর উদ্ধৃতি ছাপতে দেওয়া হয়নি । আকাশবাণীতে ১৭টি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ কােরে দেওয়া হয়েছিল ।
রেডিওতে কিশোরকুমারের গান বাজানো নিষিদ্ধ ছিল । কোনও কারণ না দেখিয়ে মিসা, ডি-আই-আর যথেচ্ছ প্রয়োগ করা হত ।
১৯৭৬ সালে জানুয়ারি মাসে লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য রাখার সময় সিপিআই(এম) এমপি সোমনাথ চ্যাটার্জি মহাশয় বলেছিলেন : ‘আমি সরকার পক্ষকে বলতে চাই যে, দেশপ্রেম ব্যাপারটি আপনাদের একচেটিয়া কারবার নয় এদেশে । আমরাও চাই দেশের উন্নতি হোক । কিন্তু কোন পথে দেশ এগবে , তা নিয়ে সরকারের সঙ্গে মতপার্থক্য ঘটলেই কী বিরোধীদের ওপর দেশদ্রোহীর -র তকমা লাগিয়ে দিতে হবে ?’ বাক্যগুলি এতটাই প্রাসঙ্গিক যে, ২০১৪ ও ২০১৯-এর পরে যেকোনো বিজেপি বিরোধী এমপি-ই এই কথাগুলি বলতে পারেন । কিন্তু এখন বিপদের ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনেকগুন বেশি ।
১৯৭৫-এ শাসকদল পলিটিক্যাল সোসাইিটর একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ কোরে গনতন্ত্রের ওপর
আক্রমন নামিয়ে এনেছিল । মোদির শাসনকালে একইসঙ্গে সিভিল ও পলিটিক্যাল সোসাইিটর নিয়ন্ত্রণ করে আরএসএস-এর পরিকল্পনা মতো ভারতে একটি ‘ হিন্দুরাষ্ট্র'প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগঠিত ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চলছে । সরকারে
থাকার সুবাদে আরএসএস-এর লোকেরা সেই উদ্যেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সব ধরনের মিডিয়া ইত্যাদি ‘কালচারাল অ্যপারেটাসগুলিকে ব্যবহার করে ‘হিন্দুত্ববাদী’ মতাদশর্গত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । আরএসএস-এর শতাধিক শাখা সংগঠন সিভিল সোসাইিটর বিভিন্ন বগর্ও স্তরে বিগত কয়েক দশক ধরে, সরকারী প্রতিষ্টানগুলিকে বাদ দিয়ে, ‘হিন্দুত্ববাদী’ মতাদশর্গত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে । তার ফলে সিভিল সোসাইটির থেকেও মােদি-সাহ-রা ভালোরকম সমথর্ন পাচ্ছেন । পাশাপাশি ২০১৪-র পর থেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অরগ্যানগুলির মধ্যে আরএসএস-এর অনপ্রবেশ লক্ষণীয়ভাবে ক্রমবর্ধমান।। সব ক্ষেত্রেই যে সব বিষয় গণমাধ্যমগুলোর সামনে আসছে না । সংঘের বৃহত্ পদক্ষেপগুলি শুধু জানা যাচ্ছে । গভীর রাতে সিবিআই দখল; রামমিন্দর বিষয়ে
হিন্দুত্ববাদের পক্ষে রায়দানের কয়েক মাস পরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে রাজ্যসভায় মনোনীত করে নিয়ে আসা; নরেন্দ্র মোদির পছন্দের আমলাদের দিয়ে নথর্ব্লক, সাউথ ব্লকে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা; বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা গুলিকে ব্যবহার করে সংঘ
পরিবারের তথাকথিত বিতর্কিত সন্ত্রাসবাদী কাযর্কলাপের সঙ্গে যুক্ত অভিযুক্তদের জামিন বা মুক্তির ব্যবস্থা করা; সরকার বিরোধী কথা বলা রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মী, শিল্পীদের যথেচ্ছ এনআইএতে গ্রেফতার করা, ইত্যাদি ঘটনাক্রম দেখিয় দিচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণের লক্ষ ও পদ্ধতি এখন অনেক তীব্র ও মারাত্মক । আরএসএস-এর দীর্ঘদিনের দাবী বাস্তবায়িত করে, বিজেপি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকেই ধ্বংস করে, তাকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে ভারতের সংবিধানের মৌলিক এসেন্সকে ধব্ংস করল । মোদি সরকারের পিছনে রয়েছে ভারতের বিগ বুর্জোয়াজী, ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা , আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির মালিকরা, ধনতান্ত্রিক
কৃষি অর্থনীতির নিয়ন্তারা ।
আরএসএস একটি ফ্যাসিস্টিক সংগঠন ও সেই কারণেই তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি
কোনও সাধারণ রাজনৈতিক দল নয় । ১৯৩৫-এ জর্জি দিমিত্রভ লিখেছেন : ‘ফ্যাসিসিমের ক্ষমতায় আরোহণ একটি বুর্জোয়া সরকারের বদলে আর একটি বুর্জোয়া সরকারের স্থান অধিকারের মতো সাধারণ ঘটনা নয় । এ হল বুর্জোয়া শ্রেনীর আপন শ্রেনী আধিপত্য বজায়
রাখার অন্য এক ধরণের রাষ্ট্ররূপ , বুর্জোয়া গনতন্ত্রের বদলে আর এক ধরনের রাষ্ট্ররূপ, প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদীদের একনায়কত্ব স্থাপন । এই পার্থক্য উপেক্ষা করাটা গুরুতর ভুল হবে ।’ কিন্তু এই ভুল অনেকের ক্ষেত্রে যে হয়েছিল তা স্বীকার করে দিমিত্রভ লিখেছেন : ‘আমাদের মধ্যেই এমন অনেক লোক ছিলেন যাঁরা ফ্যাসিসিমের বিপদকে অসহনীয়ভাবে খাটাে করে দেখেছেন । এই
ঝোঁকটা আজও পযর্ন্ত সর্বত্র কাটিয়ে ওঠা যায়নি ।’ ১৯৭৫-এ ইমারজেনসির সময় ভারত গনতন্ত্রের ওপর যে আক্রমন নেমে এসেছিল, তার তুলনায় ১৯১৪-র পর যে আক্রমণের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি তার পার্থক্য বোঝা খুব জরুরী । আজকের লড়াই শুধু গনতন্ত্রকে রক্ষার লড়াই নয়, সেইসঙ্গে
মতাদশর্গত-রাজনৈতিক-সাংগঠনিকভাবে হিন্দুত্বব্বাদকে পরাজিত করার
লড়াই, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্ররূপকে প্রতিষ্ঠা করার সব রকম প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার লড়াই ।
১৯৭৫-এর থেকে এই লড়াই অনেক অনেক গুণ কঠিন ।
We hate spam as much as you do