Tranding

03:16 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / প্রধানমন্ত্রী, মূখ্যমন্ত্রীকে পদচ‍্যুত করার সংশোধনী কি গনতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনবে?

প্রধানমন্ত্রী, মূখ্যমন্ত্রীকে পদচ‍্যুত করার সংশোধনী কি গনতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনবে?

এবার বিলটিকে মধ্যযুগীয় বলে তুলোধোনা করলেন রাহুল গান্ধী । লোকসভায় তিনি বলেন, "আমরা আসলে মধ্যযুগে ফিরে গিয়েছি, যখন রাজা নিজে ইচ্ছামতো কাউকে সরিয়ে দিতে পারতেন। কারোওর মুখটা পছন্দ না হলে তাকে ইডি দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিকে ৩০ দিনের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন।" কালো টিশার্ট পরে রাহুলের মত, যারা সংবিধানকে হত্যা করছে আর যারা রক্ষা করছে-দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে।

প্রধানমন্ত্রী, মূখ্যমন্ত্রীকে পদচ‍্যুত করার সংশোধনী কি গনতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনবে?

প্রধানমন্ত্রী, মূখ্যমন্ত্রীকে পদচ‍্যুত করার সংশোধনী কি গনতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনবে?

 চিরন্তন গাঙ্গুলী

 24 Aug 2025


কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে সংবিধান আইন ২০২৫ নামে একটা বিল পেশ করেছেন যা নিয়ে চারিদিকে খুবই হইচই হচ্ছে। যে বিলে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী বা যে কোন মন্ত্রী কোন কারণে শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য ৩০ দিন টানা জেলে থাকলে স্বাভাবিক নিয়মেই তারা পদচ্যুত হবেন এবং পুরো পাঁচ বছর পদচ্যুত হয়েই থাকতে হবে


বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা জেলে থাকলে তাদের পদাধিকার হারানোর  কোন আইন নেই। নতুন বিল সংবিধানের 75, 164 এবং 239AA ধারা সংশোধন করে তার সাথে একটি উপ-ধারা যুক্ত করার কথা বলেছে।


এই মুহূর্তে ভারতের সংবিধানে স্পষ্ট করে কিছু জানানো নেই যে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী অথবা যে কোন একজন মন্ত্রী জেলবন্দি থাকলে তার পদ  থাকবে কি থাকবে না?
বিলে দাবি করা হয়েছে যে, গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত, গ্রেপ্তার এবং হেফাজতে থাকা একজন মন্ত্রী সাংবিধানিক নৈতিকতা এবং সুশাসনের নিয়ম আটকাতে পারে বা বাধা দিতে পারে, যার পরিণামে জনগণের  দেশের সংবিধানের প্রতি আস্থা হ্রাস করার সম্ভাবনা থাকবে।


75 নং অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের নিয়োগের সাথে সম্পর্কিত।

বর্তমানে, ভারতের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা কোনও মন্ত্রী জেলে থাকাকালীন পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না এমন কোনও নির্দিষ্ট আইন নেই।

75(1) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করবেন এবং অন্যান্য মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর‍ পরামর্শক্রমে নিযুক্ত হবেন।

75(2)নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে মন্ত্রীদের পদ বহাল থাকবে।

75(3) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, মন্ত্রী পরিষদ সম্মিলিতভাবে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।

75(4) অনুচ্ছেদে মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

এবং 75(5) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, একজন মন্ত্রী, যিনি টানা ছয় মাস ধরে সংসদের কোনও কক্ষের সদস্য নন, তিনি ছয় মাস হয়ে যাওয়ার পর আর  মন্ত্রী থাকতে পারবেন না।

একইভাবে, 164নং অনুচ্ছেদ  মুখ্যমন্ত্রী এবং অন‍্যান‍্য মন্ত্রীদের তাদের পরিষদে নিয়োগের সাথে সম্পর্কিত। অনুচ্ছেদ 239AA দিল্লি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত।

সংশোধনী বিলটিতে 75(5A), 164(4A), এবং 239AA(4A) ধারাগুলোকে এক যায়গায়  করার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে শাস্তিযোগ্য অপরাধের জন্য আটকের ৩১তম দিনে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীদের তাদের পদ থেকে পাঁচ বছর বা তার বেশি সময়, স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে অপসারণের ব্যবস্থা করা যায়।

সংক্ষেপে বিলটি
সংক্ষেপে, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে নিম্নলিখিত তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে:

পাঁচ বছর বা তার বেশি দণ্ডনীয় অপরাধের জন্য টানা ৩০ দিন ধরে গ্রেপ্তার এবং আটক থাকা একজন মন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে
আটকের ৩১তম দিনের মধ্যে  অপসারণ করবেন।

প্রধানমন্ত্রী যদি ৩১তম দিনের মধ্যে আটক মন্ত্রীকে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ না দেন, তাহলে পরের দিন থেকে মন্ত্রীকে নিজেই তার পদ ত্যাগ করতে হবে । 

প্রধানমন্ত্রীর অপসারণ সম্পর্কে, প্রস্তাবিত বিলটিতে বলা হয়েছে যে,  দণ্ডনীয় অপরাধের জন্য যদি প্রধানমন্ত্রী যদি পাঁচ বছর বা তার বেশি সময়ের জন‍্য শাস্তিপ্রাপ্ত হয়ে গ্রেপ্তার হন এবং টানা ৩০ দিন তাকে আটক থাকতে হয়, তাহলে তাকে ৩১তম দিনের মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে 

। যদি তিনি পদত্যাগ না করেন, তাহলেও পরের দিন থেকে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না ।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিলটিতে স্পষ্ট করা হয়েছে যে, ৩০ দিনের জন্য হেফাজতে থাকার কারণে অপসারিত বা পদত্যাগকারী কোনও মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রাষ্ট্রপতির সুপারিশে তাদের পদে পুনর্নিয়োগের যোগ্য হবেন।

বিলটিতে মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের মন্ত্রী পরিষদ এবং দিল্লির কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য একই রকম নিয়ম তৈরি করা হয়েছে।

বিরোধী দলের মন্ত্রীদের উপর নির্যাতন?

দিল্লির আবগারি নীতি মামলায় পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলে থাকা সত্ত্বেও দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পটভূমিতে বিলটি আনা হয়েছে বলে বলা হচ্ছে।

কেজরিওয়ালকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়ার সময়, সুপ্রিম কোর্ট তাকে সচিবালয়ে যেতে নিষেধ করেছিল। 

এর আগে দিল্লি হাইকোর্টে কেজরিওয়ালকে পদ থেকে অপসারণের জন্য একটি আবেদন দাখিল করা হয়েছিল। আবেদনটি খারিজ করে হাইকোর্ট বলেছিল যে এটি তারই সিদ্ধান্ত, এবং এই ধরনের বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপের কোনও সুযোগ নেই।

দিল্লির মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন, যাকে ৩০ মে, ২০২২ তারিখে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (‘ইডি’) গ্রেপ্তার করেছিল, তিনি ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে পদত্যাগপত্র জমা দেন। দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন মনীশ সিসোদিয়াকে ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে সিবিআই গ্রেপ্তার করে, কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে পদত্যাগ করেন।

ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪ তারিখে অর্থ পাচারের মামলায় ইডি গ্রেপ্তার করে। একই দিনে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে, হাইকোর্ট তাকে জামিন দেয়, অনুসন্ধান করে যে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে কোনও মামলা নেই।

স‍্যোশাল মিডিয়া  X-এর প্রেক্ষিতে, সিনিয়র আইনজীবী এবং কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি বলেন, "বিরোধী দলকে অস্থিতিশীল করার সর্বোত্তম উপায় হল বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে
পক্ষপাতদুষ্টভাবে নিয়োগ করা এবং, নির্বাচনীভাবে তাদের পরাজিত করতে না পারলেও, নির্বিচারে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে তাদের অপসারণ করা।"

367(2) ধারা অনুসারে, একটি সাংবিধানিক সংশোধনের জন্য উপস্থিত এবং ভোটদানকারী সেই সভার কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন। বর্তমানে এনডিএ সরকারের নিজস্ব দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।


সিনিয়র আইনজীবী এ.এম. সিংভির মতে
“বিরোধী দলকে অস্থিতিশীল করার সর্বোত্তম উপায় হল বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করার জন্য পক্ষপাতদুষ্ট কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে নিয়োগ করা এবং, নির্বাচনীভাবে গনতান্ত্রিক উপায়ে তাদের পরাজিত করতে না পারলেও, নির্বিচারে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে তাদের অপসারণ করা। ”  


এই সংশোধনী বিল কি সত্যিই রাজনীতিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা বলে?

সিনিয়র আইনজীবী মোহন কাতারকি বলেন যে বিরোধী দলের মুখ্যমন্ত্রীদের উপর নির্যাতন অত্যন্ত  বাস্তব ঘটনা হলেও, একজন জেলবন্দী মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকা উচিত দাবি করে এর সমাধান করা যায় না।

তিনি আরও বলেন যে, সংবিধানের 164(1) অনুচ্ছেদের বক্তব্য  একজন জেলবন্দী মন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের বিশ্বাস হারাচ্ছেন বলে মনে করা উচিত।  তিনি আরও বলেন যে, এই ক্ষেত্রে বিলটি কোনও রাজনৈতিক নৈতিকতার কথা বলে না। বরং, এটি একজন জেলবন্দী মুখ্যমন্ত্রীকে এক মাস ধরে পদে বহাল থাকার বৈধতা দেয়।

এর সাথে , সংবিধানের 102নং এবং 191নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নির্বাচিত সাংসদ এবং বিধায়কদের অযোগ্যতা  কি কারনে সেই  বিষয়গুলি উল্লেখ করা হয়েছে।


অযোগ্যতার কারণগুলি কি কি? লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা, মানসিকভাবে অসুস্থ থাকা, আর্থিকভাবে  দেউলিয়া  হওয়া, ভারতের নাগরিক না হওয়া, স্বেচ্ছায় কোনও বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করা, অথবা সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোনও আইন দ্বারা বা তার অধীনে অযোগ্য হওয়া, যার মধ্যে রয়েছে  দশম তফসিলের বক্তব্য দলত্যাগের জন্য অযোগ্যতা ।

102নং এবং 191নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত আইন হল জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, যা নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ফলে সংসদের সদস্যপদ বাতিল হবার আইন।
এছাড়াও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে সাংসদ বিধায়করা যদি নূন্যতম দুবছরের জন্য যদি সাজাপ্রাপ্ত হন তাহলে তারা আর তাদের পদে থাকতে পারবেন না।

বিরোধীদের বক্তব্য 
সুতরাং এই বিল নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন রাহুল গান্ধী। লোকসভার বিরোধী দলনেতার মতে, এই বিলের মাধ্যমে গোটা দেশ মধ্যযুগে পিছিয়ে যাচ্ছ। প্রতিবাদস্বরূপ কালো রঙের টিশার্ট পরে যোগ দেন অধিবেশনে। জানান, যারা সংবিধানকে হত্যা করছে আর যারা রক্ষা করছে-দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে।

কংগ্রেস-সহ গোটা বিরোধী শিবির বিলটির বিরোধিতা করেছে। ইন্ডিয়া জোটের বক্তব্য, এটা আসলে বিরোধীদের নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, এই বিল আসলে সুপার এমার্জেন্সি লাগু করার চেষ্টা। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে চিরতের ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে মোদি সরকার। ভারতীয় গণতন্ত্রের উপর হিটলারোচিত আঘাত হানা হচ্ছে এই বিলের মাধ্যমে। এটা আসলে গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টার শামিল।

 

এবার বিলটিকে মধ্যযুগীয় বলে তুলোধোনা করলেন রাহুল গান্ধী । লোকসভায় তিনি বলেন, "আমরা আসলে মধ্যযুগে ফিরে গিয়েছি, যখন রাজা নিজে ইচ্ছামতো কাউকে সরিয়ে দিতে পারতেন। কারোওর মুখটা পছন্দ না হলে তাকে ইডি দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে দিতে পারেন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিকে ৩০ দিনের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন।" কালো টিশার্ট পরে রাহুলের মত, যারা সংবিধানকে হত্যা করছে আর যারা রক্ষা করছে-দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলছে।


সিপিআইএম পলিটব‍্যুরো এই বিলের বিরোধিতা করে তাদের বিবৃতিতে বলেছে "বর্তমান সরকারের নব্য-ফ্যাসিবাদী প্রবণতার পরিপ্রেক্ষিতে, এটি স্পষ্টতই বিরোধী রাজ্য সরকারগুলিকে লক্ষ্য করার জন্য একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এই পদক্ষেপটি ঘৃণ্য এবং একটি নামী গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য নিয়ন্ত্রণ এবং ভারসাম্যকে ক্ষুণ্ন করে। অপরাধের উল্লেখ কেবল আসল উদ্দেশ্যকে ঢেকে ফেলার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে," 

Your Opinion

We hate spam as much as you do