Tranding

03:13 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ঘৃণাভাষনের প্রসার - বিদেশে ভারতীয় প্রতিনিধিদল

পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ঘৃণাভাষনের প্রসার - বিদেশে ভারতীয় প্রতিনিধিদল

প্রাক্তন কূটনীতিক থারুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বলেন যে, "যদিও পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বিভক্ত করা, বিপরীতে এটি ভারতে মানুষকে ঐক‍্যবদ্ধ করেছে, তাদের ধর্ম বা অন্য কোনও বিভেদ নির্বিশেষের একতা ... ধর্মীয় এবং অন্যান্য বিভেদকে ভেঙে অসাধারণ পরিমাণে ঐক্যবদ্ধতা ছিল যা মানুষ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বার্তাটি খুব স্পষ্ট যে একটি খারাপ উদ্দেশ্য ছিল... "।

পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ঘৃণাভাষনের প্রসার - বিদেশে ভারতীয় প্রতিনিধিদল

পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা, ঘৃণাভাষনের প্রসার - বিদেশে ভারতীয় প্রতিনিধিদল 

অধ্যাপক রাম পুনিয়ানি 

(newsclick এ প্রকাশিত ও 
অনুবাদ চিরন্তন গাঙ্গুলী )

1 june 2025


২২শে এপ্রিলের পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলা ভারতের জনগণের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন কথার বাহবা দিয়েছিলেন, তখন ‘গোদি মিডিয়া’ তাদের অনুসরণ করে দাবি করেছিল যে ভারত পাকিস্তানের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করেছিল যে তারা অনেক ভারতীয় বিমান বোমা মেরে ভূপাতিত করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই প্রথম দাবি করেছিলেন যে তিনি যুদ্ধবিরতি  করিয়েছেন।

মোদী এর কৃতিত্ব নিলেন এবং সেনাবাহিনীর মুখপাত্র বিস্তারিতভাবে বললেন যে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির অনুরোধ এসেছে এবং ভারত উভয় পক্ষের আরও সেনা সদস্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের সম্ভাব্য রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।

সরকার বিদেশে বিভিন্ন সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ভারতীয় পক্ষকে গল্পটি জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিরোধী দলের অনেক সংসদ সদস্যও এতে অন্তর্ভুক্ত আছেন । কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুরের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া প্রতিনিধিদলটি ছিল এর মধ্যে একটি। এই প্রতিনিধিদলগুলিকে কী ধরণের ব্রিফ দেওয়া হয়েছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থারুরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রাক্তন কূটনীতিক থারুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বলেন যে, "যদিও পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে বিভক্ত করা, বিপরীতে এটি ভারতে মানুষকে ঐক‍্যবদ্ধ করেছে, তাদের ধর্ম বা অন্য কোনও বিভেদ নির্বিশেষের একতা ... ধর্মীয় এবং অন্যান্য বিভেদকে ভেঙে অসাধারণ পরিমাণে ঐক্যবদ্ধতা ছিল যা মানুষ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। বার্তাটি খুব স্পষ্ট যে একটি খারাপ উদ্দেশ্য ছিল... "।

সমস্ত প্রতিনিধিদলকে কি এই ধরণের একটি সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হয়েছিল ? এই বর্ণনায় স্পষ্টতই অনেক সত্য রয়েছে, কারণ হিন্দু এবং মুসলিম সহ সমস্ত ভারতীয়, পহেলগাম, কাশ্মীরের জঘন্য কাজের নিন্দা জানাতে একত্রিত হয়েছিল।

কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর যেভাবে ঐক্যের কথা বলেছেন, তা কি সব দলকে জানানো হয়েছে, যেখানে  দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে?


তবে, এই সবকিছুর আড়ালে এখনও লুকিয়ে আছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া। পহেলগাম ট্র্যাজেডির আগেও, মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ঘৃণা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই ট্র্যাজেডির পরে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে তৈরি এই ঘৃণা আরও চরমে পৌঁছেছে। গত সপ্তাহে একটি প্রবন্ধে, আমি এই সংখ্যালঘু  সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের একটি আংশিক তালিকা দিয়েছিলাম। এই ঘটনাগুলি সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোসাইটি অ্যান্ড সেক্যুলারিজম, মুম্বাই দ্বারা ধারাবদ্ধ করা হয়েছে।

আরেকটি প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছে যে “যখন ভারত সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণহানির জন্য শোক প্রকাশ করছিল, তখনও অফলাইন এবং অনলাইনে একটি একসুরে প্রচার শুরু হয়েছিল, যার মূল  বার্তা ছিল: মুসলমানরা হিন্দুদের জন্য হুমকি, একই পরিণতি সমস্ত হিন্দুদের জন্য অপেক্ষা করছে এবং পাল্টা হিংসা এবং বয়কটের মাধ্যমে মুসলমানদের শাস্তি দেওয়া উচিত।”


এর মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর ছিল অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী খান মাহমুদাবাদের গ্রেফতার, যিনি সেখানকার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি পোস্টে তিনি বলেন, "আমি খুবই আনন্দিত যে এত দক্ষিণপন্থী মন্তব্যকারী কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে প্রশংসা করছেন," তিনি আরও বলেন, "তাদের এটাও দাবি করা উচিত যে গণপিটুনি, নির্বিচারে বাড়িঘর ভাঙচুরের শিকার এবং বিজেপির ঘৃণা ছড়ানোর শিকার অন‍্যান‍্য ভারতীয় নাগরিকদেরও সুরক্ষা দেওয়া হোক।" বেশ কয়েকটি অধিকার গোষ্ঠী উল্লেখ করেছে যে গত দশকে ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা এবং ঘৃণা ছড়ানোর বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে।"


এরপর হরিয়ানা রাজ্য মহিলা কমিশন অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে "মিঃ মাহমুদাবাদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলি দুই মহিলা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাকে "অসম্মান" করেছে এবং সশস্ত্র বাহিনীতে "তাদের ভূমিকাকে ক্ষুণ্ন" করেছে।" এই স‍্যোশাল মিডিয়া পোস্টটি কীভাবে মহিলা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের অবমাননা করেছে বা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তাদের ভূমিকাকে ক্ষুণ্ন করেছে তা একদমই বোধগম্য নয়?


অন্য অভিযোগটি দায়ের করেছিলেন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক যুব কর্মী। এই অভিযোগের ভিত্তিতে আলী খানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে তাকে অস্থায়ী জামিন মঞ্জুর করা হয়। শীর্ষ আদালতও একটি রায় দিয়েছে যেখানে তাকে এই বিষয়ে মতামত না লেখার এবং তার পাসপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে যে আলী খানের পোস্টটি "কুকুরের বাঁশি বাজানো" এবং এটি সূক্ষ্মভাবে বিতর্কিত বার্তা প্রেরণ করতে পারে। আমরা জানি "কুকুরের বাঁশি বাজানো" হল কোডেড বক্তৃতার জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত লেবেল যা পরোক্ষভাবে বিতর্কিত অর্থ বহন করে। বিচারক পোস্টগুলির পিছনে সময় এবং প্রেরণা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যদিও অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করা অবশ্যই খুবই সন্তোষজনক ।
 

এমনকি বিজেপি নেতা এবং মধ্যপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী বিজয় শাহ, যিনি সোফিয়া কুরেশিকে "সন্ত্রাসীদের বোন" বলে মন্তব্য করেছিলেন, আদালত তাকে তীব্র তিরস্কার করেছে। বিজেপি নেতার এই মন্তব্য ছিল অসাধারণ সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সবচেয়ে ঘৃণ্য মন্তব্য। অর্থাৎ, এটিই আসলে শাহের "কুকুরের বাঁশি"। আদালত তার ক্ষমা চাওয়া প্রত্যাখ্যান করলেও, তার গ্রেপ্তার স্থগিত রাখা হয়েছে।

কুকুরের বাঁশি কী? অধ্যাপক আলি খানের পোস্টটি নিশ্চিতভাবেই কুকুরের বাঁশি নয়। এটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যন্ত্রণার প্রকাশ। বিপরীতে, শাহের কুকুরের বাঁশি ঘৃণার প্রকাশ্য প্রকাশের সীমানা। অধ্যাপক আলি খান, সংবেদনশীলভাবে, আমাদের আয়না দেখিয়েছেন যে জাতি তার সংখ্যালঘুদের সাথে কীভাবে আচরণ করছে। বিজেপি নেতা বিজয় শাহ প্রকাশ্যে দেখিয়ে দিলেন যে কীভাবে প্রতিটি সুযোগকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

ভারতের 'নতুন স্বাভাবিক' অবস্থার অংশ হয়ে ওঠা বুলডোজার এবং গনপিটুনি সম্পর্কে কথা বলার জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন অধ্যাপককে দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয় এবং আদালত বুলডোজারের অনুমোদন না দেওয়া সত্ত্বেও, রাজ্য সরকারগুলি বারবার এর ব্যবহার শুরু করেছে।

এছাড়াও, দুই ব্যঙ্গাত্মক, নেহা সিং রাঠোর এবং মাদ্রি কাকোটি, যিনি প্রাক্তন গায়িকা এবং ডক্টর মেডুসা নামে পরিচিত, পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পর মোদী সরকারের সমালোচনা করে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল।

আবার অন‍্যদিকে বিজয় শাহ যা করেছেন তা মূলত তার দল দ্বারা প্রশংসিত, কোনও স্থগিতাদেশ নেই, বহিষ্কার এবং গ্রেপ্তারও করা হয়নি।

বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে নীচের স্তর পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ঘৃণা কেবল নীরবেই মেনে নেওয়া হয়নি, এটি তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য একটি সিঁড়ি হিসাবেও কাজ করে।
 

২০১৯ সালের দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রেক্ষাপটে স্মরণ করার জন্য, উমর খালিদ, শারজিল ইমাম এবং অন্যান্যদের মতো শান্তি ও সম্প্রীতির ডাক দেওয়া ব্যক্তিরা পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে পচছেন, তাদের মামলা শুনানির জন্যও আসেনি, অন্যদিকে একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর জনগণকে 'গোলি মারো...' স্লোগান দিতে বাধ্য করার পর মন্ত্রিসভায় পদোন্নতি হল।

খুব ধীরে ধীরে আমাদের সভ্যতা এবং সংবিধান রাজনীতি ও ধর্মের চাদরে মুড়ে ফেলা হচ্ছে। যার ফলে তার মান নষ্ট হচ্ছে
গণতন্ত্রের জন্য যা প্রয়োজন তা হল আলী খান, উমর খালিদ, নেহা সিং রাঠোর এবং হিমাংশী নারওয়ালের মতো ব্যক্তিদের প্রতি প্রকাশ‍্য সমর্থন, যারা সত্য বলে শান্তির ডাক দিচ্ছেন এবং আমাদের সমাজকে একটি আয়নাও দেখাচ্ছেন।

Your Opinion

We hate spam as much as you do