বহু আন্দোলনের পরেও একই কাজে পুরুষদের সমান বেতন পান না মেয়েরা। স্যালারি ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মেয়েরা পুরুষদের থেকে ২৮ শতাংশ বেতন কম পান। এমনকি, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র, যা অনেকটাই প্রগতিশীল বলে ধরা হয়, সেখানেও এই ফারাক প্রায় ২৬ শতাংশ। আর অংসগঠিত ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও বেশি। সেখানে পুরুষ কর্মীদের চেয়ে মেয়েরা কার্যত অর্ধেক মজুরি পান বলে অভিযোগ। আবার, জরুরি এবং সামাজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ‘স্বেচ্ছাকর্মী’ হিসেবে নামমাত্র সাম্মানিক পান অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মী, আশাকর্মীরা।
২০২৫ এ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ভারতে শ্রমজীবী মহিলারা কেমন আছেন?
৮ই মার্চ ২০২৫
মার্চের ৮ তারিখ উপলক্ষে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস নারীর অধিকার বিষয়ে প্রতি বারই চাপা পড়ে যায় অগণিত দাবিগুলি— সম কাজে সম বেতন, পূর্ণ কর্মীর মর্যাদা, সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি, কাজের যথাযথ সময় নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্রে শৌচাগার-রাতের ডিউটিতে বিশ্রামের জায়গা-শিশুদের জন্য ক্রেশ, সুরক্ষিত গণপরিবহণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি রোখা, মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধের যথাযথ তদন্ত, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার তৈরি ইত্যাদি। যে সব কারণে বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মেয়ে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, নারী দিবসের আলোচনায় সেগুলি কবে উঠে আসছে কি?? কবে সে সবের সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ, নীতি নির্ধারণের পথে হাঁটবে সরকার বা বেসরকারি সংস্থাগুলি?
ভারতের কাজের বাজারে মহিলা কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে ১০ শতাংশ। এই খবরটি সকলের কাছে যথেষ্ট উৎসাহের। এর ফলে এটা প্রমাণিত হয় যে কাজের বাজারে মহিলারা অনেক বেশি এগিয়ে থাকছেন। তবে চিন্তার বিষয়টি হল প্রায় ৮৯ মিলিয়ন মহিলা যারা বিভিন্ন অফিসে কাজ করেন তারা সরকারি প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তারা কাজ করেন সেই প্রতিষ্ঠানগুলি তাঁদেরকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে দিয়েছেন।
ভারতের কাজের বাজারে পুরুষদের থেকে এখন অনেকটা এগিয়ে থাকছেন নারীরা। অনেক সময় দেখা গিয়েছে তারা কাজের নিরিখে পুরুষদের থেকে অনেক বেশি দক্ষ। তবে যেসব সুযোগ সুবিধা তাঁদের পাওয়া উচিত ছিল সেখান থেকে তারা কিছুই পাচ্ছে না।
সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে কাজের বাজারে বিগত ১০ বছরে মহিলা কর্মীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃ্দ্ধি পেয়েছে। সেখানে পুরুষ কর্মীদের তাঁরা অনেক সময়তেই কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। তবে এর কারন অন্যতম একটা তা হল একই কাজে বরং অধিক দক্ষতায় পুরুষের চেয়ে মজুরি অনেক কম দিলেও চলে। দেখা গিয়েছে মাসের শেষে শুধু মাইনে ছাড়া অন্য সমস্ত সরকারি সুযোগ থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
বহু আন্দোলনের পরেও একই কাজে পুরুষদের সমান বেতন পান না মেয়েরা। স্যালারি ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মেয়েরা পুরুষদের থেকে ২৮ শতাংশ বেতন কম পান। এমনকি, তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র, যা অনেকটাই প্রগতিশীল বলে ধরা হয়, সেখানেও এই ফারাক প্রায় ২৬ শতাংশ। আর অংসগঠিত ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও বেশি। সেখানে পুরুষ কর্মীদের চেয়ে মেয়েরা কার্যত অর্ধেক মজুরি পান বলে অভিযোগ। আবার, জরুরি এবং সামাজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ‘স্বেচ্ছাকর্মী’ হিসেবে নামমাত্র সাম্মানিক পান অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে মিল কর্মী, আশাকর্মীরা।
ভারতের কাজের বাজারে ২০ থেকে ২৪ বছরের মহিলার সংখ্যা বাড়ছে প্রতি বছরই। সেখানে ১০ শতাংশের মধ্যে ৭.৫ শতাংশ মহিলা অনেক বেশি দক্ষতা দেখাচ্ছেন। অনেক সময় দেখা গিয়েছে বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আয় করলেও স্ত্রী-য়ের আয় তাঁর স্বামীর তুলনায় অনেক বেশি। শুধু কাজের ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রেও স্ত্রী তাঁর স্বামীর তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন।
এর পাশাপাশিই রয়েছে সন্তানের জন্মের পরে কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়ার দিকটি। সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না সবাই। বহু ছোট সংস্থা সন্তানসম্ভবা কর্মীকে বরখাস্ত করে, যাতে কোনও সুযোগ-সুবিধা দিতে না হয়। কাজের জায়গায় শিশুর জন্য ক্রেশ না থাকার কারণে কাজ ছেড়ে দেন প্রায় ৫০ শতাংশ মহিলা, বলছে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিপোর্ট। বিশ্বের মধ্যে ভারতে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যোগদানের হার অনেক কম (২০২৩ সালে ২৪ শতাংশ)। তার অন্যতম কারণই হল শিশুর দেখাশোনার দায়িত্ব কার্যত একা সামলে চাকরি করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রসঙ্গে দিল্লির একটি স্টেশনে শিশু-সহ কর্তব্যরত আরপিএফ কনস্টেবলের ছবি ভাইরাল হওয়ার কথা তুলছেন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী দেবজিতা দত্ত। মূলত মাতৃত্বের জয়গান গেয়ে সমাজমাধ্যমে পোস্ট দেন অনেকে। দেবজিতা বলছেন, ‘‘এক জন কর্মরত মা হয়ে আমার মনে হয়েছিল, কতটা পরিকাঠামোর অভাব থাকলে, কতটা বাধ্য হলে তবে কেউ এ ভাবে শিশুকে নিয়ে ডিউটি করতে আসেন? তিনি কি ওই ভাবে ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? আইনশৃঙ্খলার অবনতির পরিস্থিতিতে শিশুটির সুরক্ষা কে নিশ্চিত করবে? যদি শিশুটির কিছু হয়, তখন কিন্তু দায়ী করা হবে মাকেই।’’ এই সমস্যার দিকটি কম আলোচিত হওয়া আসলে জনমানসে সচেতনতার অভাবেরই প্রতিফলন বলে মত তাঁর।
এ রাজ্যের শ্রমজীবী মেয়েরা ও প্রান্তিক-লিঙ্গ যৌনতার মানুষদের কাজের ক্ষেত্রে সমস্যার দিকগুলি নিয়ে কাজ করছে নারী দিবস উদ্যাপন মঞ্চ। তাদের তরফে সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘মেয়েদের শ্রমের একটা অদৃশ্যায়ন ঘটছে। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেও সংসার চালানোর উপযুক্ত টাকা রোজগার করতে পারছেন না। শ্রমজীবী মেয়েদের সঙ্কটগুলি দূর করার উদ্দেশ্যে অনেকেই আন্দোলন চালাচ্ছেন। তবে সেগুলি প্রায়ই বিচ্ছিন্ন বা সমান্তরাল ভাবে চলছে। শ্রমজীবী প্রান্তিক লিঙ্গ যৌনতার মানুষ ও শ্রমজীবী মেয়েদের পরস্পর আলোচনার মঞ্চ তৈরি করা দরকার।’’ নারী দিবসে বিভিন্ন সভায় সাধারণ শ্রমজীবী মেয়েদের কথা তুলে আনবে মঞ্চ। এর পাশাপাশি আর জি কর-কাণ্ড নিয়ে এখনও যে ধোঁয়াশা, সংশয় রয়েছে, তা কাটিয়ে উপযুক্ত বিচারের দাবিও তুলছে তারা।
ইতিহাস বলছে, ১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কে ১৫০০০ শ্রমজীবী মহিলা পথে নেমেছিলেন ভোট দেওয়ার অধিকার ও সম কাজে সম বেতন চেয়ে, কাজের দীর্ঘ সময় কমানোর দাবিতে। সে দিনের প্রতিবাদীদের মতোই আজকের মেয়েরা নারী দিবসে অন্তঃসারশূন্য বার্তার বদলে
চান সদর্থক পদক্ষেপ, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের দায়বদ্ধতা। তাঁরা চান, নারী দিবসে এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হোক এবং তা চলুক বাকি ৩৬৪ দিনও।
এমনটাই দেখা গিয়েছে শুধু বাইরের কাজ বা অফিসের কাজ নয়, ঘরের কাজেও পুরুষদের একেবারে পিছিয়ে ফেলে দিয়েছে নারীরা। তারা অফিস থেকে ফেরার পর ঘরের কাজেও সমান দক্ষতা দেখাচ্ছেন। তবে এতসব করেও যে সরকারি সুযোগ সুবিধা তাঁদের পাওয়া উচিত সেখানে তাঁরা কিছুই পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি আগামীদিনে কতটা বদলাবে সেটাই আন্তর্জাতিক মহিলা দিবসে সবথেকে বড় প্রশ্ন।
We hate spam as much as you do