Tranding

01:17 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / মীর নিসার আলি মানে প্রতিরোধ

মীর নিসার আলি মানে প্রতিরোধ

"সাহেব, তোমরা আমাদের দেশে এলে ক্যানে? আমরা তো তোমাদের কোন ক্ষেতি করিনি, আমরা তো ছিলাম ভাইয়ে ভাইয়ে গলাগলি করে, হিন্দু মুসলমানের প্রীতি বাহু বেঁধে বাংলা মায়ের শ্যামল অঞ্চলে মুখ ঢেকে...হাজার হাজার মাইল দূরে এসে ক্যানে বুট জুতা মাড়াতে এলে আমাদের স্বাধীনতা...” --এই ছিলো উৎপল দত্তের তিতুমীরের কথা।

মীর নিসার আলি মানে প্রতিরোধ

মীর নিসার আলি মানে প্রতিরোধ


(গত ২৭শে জানুয়ারি ছিল তিতুমীরের জন্মবার্ষিকী। তাকে নিয়ে কিছু বিতর্ক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষন)

 

অশোক ভট্টাচার্য 


"ইংরেজ রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করিল। রাজ্য সুশাসিত হইল। সুতরাং ভবানী ঠাকুরের  কাজ ফুরাইল। দুষ্টের দমন রাজাই করিতে লাগিলেন। "
--এই কথা গুলো বলে বঙ্কিম যখন 'দেবী চৌধুরানী'( প্রকাশকাল-১৮৮৪)র উপসংহার টানছেন, তারও প্রায় ৫০ বছর আগে ১৮৩১ এ এই বাংলার নারকেলবেড়িয়াতে রচিত হয়ে গিয়েছিলো আর এক ইতিহাস। 

 

বঙ্কিমের কথা অনুযায়ী 'ইংরেজ রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করিল", কিন্তু কার হাত থেকে ইংরেজ তা ছিনিয়ে নিয়েছিলো? উত্তরঃ- মুসলমানের হাত থেকে। এই  উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বাংলার ইতিহাসের ট্রাজেডির বীজ। ট্রাজেডির শুরু অনেক আগেই। এই বঙ্কিমই সেই ট্রাজেডির ইঙ্গিত দিচ্ছেন 'আনন্দমঠ' উপন্যাসেঃ

 

"মুসলমানের পর ইংরেজ রাজা হইল, হিন্দু প্রজা তাহাতে কথা কহিল না। বরং হিন্দুরাই রাজ্য জয় করিয়া ইংরাজকে দিল। কেননা হিন্দুর ইংরাজের উপর ভিন্ন জাতীয় বলিয়া কোন দ্বেষ নাই।’’ 

 

তা'লে দ্বেষ কার প্রতি? সহজ উত্তরঃ- মুসলমানের প্রতি। কিন্তু এদেশে এই ক্যান্সার ছড়ালো কে? উত্তরঃ- সেই তারা যারা একদিন বিভাজনের রাজনীতি এনেছিলো শুধুমাত্র লুঠ করবে বলে, সেই ইংরেজ।

 

"সাহেব, তোমরা আমাদের দেশে এলে ক্যানে? আমরা তো তোমাদের কোন ক্ষেতি করিনি, আমরা তো ছিলাম ভাইয়ে ভাইয়ে গলাগলি করে, হিন্দু মুসলমানের প্রীতি বাহু বেঁধে বাংলা মায়ের শ্যামল অঞ্চলে মুখ ঢেকে...হাজার হাজার মাইল দূরে এসে ক্যানে বুট জুতা মাড়াতে এলে আমাদের স্বাধীনতা...”
--এই ছিলো উৎপল দত্তের তিতুমীরের কথা। 

 

এই তিতুমীরকে মুছে দিয়ে অন্য তিতুমীরকে সামনে আনতে হবে; এটা ছিলো সেদিনেরও এবং আজকেরও এজেন্ডা। "তিতুমীর হিঁদু মেয়েদের ধরে ধরে রেপ করেছিলো,হিঁদু মন্দিরে গোরুর মাংস ঝুলিয়ে দিয়েছিলো, এমনকি মোছলমানরাও যারা তার বিরোধিতা করত, তারাও রেহাই পেত না.."--এমন প্রচার শুরু করিয়েছিলো ইংরেজরা, সেই পথে হেঁটেই তিতুমীরের প্রথম জীবনীকার বিহারিলাল সরকার তিতুমীরকে 'ধর্মোন্মাদ' তকমা সহ আরো অনেক নেতিবাচক বিশেষণ লাগিয়ে দিলেন, সেই ট্রাডিশন মেনেই আজও দু'টাকার হোয়াটসঅ্যাপ ইউনির্ভাসিটির লোকজন 'সংঘ'বদ্ধ হয়ে একই কাজ করে চলছে। লক্ষ একটাই গুজব ছড়িয়ে বিভাজন করে দাও, পরস্পর লড়িয়ে দাও।

 

অথচ 'অমলেন্দু দে'র লেখা থেকে জানতে পারি তিতুমীর জমিদার কৃষ্ণদেবকে যে চিঠি লিখেছিলেন, সেখানে তিনি শান্তিপূর্ণ সমাধান চেয়েছিলেন। ধর্মপ্রাণ ছিলেন তিতুমীর। তাই মুসলমান দাড়ির উপর কর চাপানো অত্যাচারী কৃষ্ণদেবের বিরুদ্ধে তাঁর গর্জে ওঠাকে কেউ যদি জেহাদ আখ্যা দ্যান তাহলে বলতে হবে জেহাদ এবং ধর্মকে হাতিয়ার করেই তিতুমীর লড়াই শুরু করলেও সেই লড়াই ছিলো আদপে একেবারে পিছনের সারিতে থাকা পিষে যাওয়া মানুষগুলোর বেঁচে থাকার লড়াই, যে লড়াই শেষ পর্যন্ত গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। 

 

আজ থেকে পাঁচশ বছর আগেও ঠিক একই কৌশলে ধর্মকে অবলম্বন করেই( হয়ত পথ ছিলো আলাদা) প্রেম ও অহিংসাকে অবলম্বন করে বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী চৈতন্য দেব। 

 

তিতুমীরের সব থেকে বড় দোষ হয়ত তিনি 'এলিট ' ছিলেন না। তাই বাংলার এলিট বুদ্ধিজীবি সমাজের সাহিত্য-লেখায় তিনি কলকে পাননি সেই সময় থেকে পরবর্তী অনেকটা সময় জু্ড়েই।

 

অত্যাচারী জমিদার, অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে সেই সময় প্রেম-অহিংসার বাণী চলত না। মনে রাখতে হবে যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে বৈষ্ণব ধারা স্তিমিত হয়ে শক্তির আরাধনা শুরু হচ্ছে এই বঙ্গে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষেই বাংলার সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়েছিলো। আর তাই অত্যাচারীর বিরুদ্ধে 'আলি আলি ' বলে রে রে করে মানুষ তাতানোটাও ছিলো তিতুমীরের লড়াইয়েরই একটা অংশ।

 

তিতুমীর একটা নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু কৃষ্ণদেবের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইতো  'হিন্দু বিরোধী' লড়াই ছিলোনা। বরং হিন্দু সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো তিতুমীরের অনুগামী হয়ে পড়েন সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধেই লড়াই করার স্বার্থে। তাই তিতুমীরের লেঠেল বাহিনীতে হিন্দু-মুসলিম সবাই ছিলো। বলা বাহুল্য সেই লেঠেল বাহিনী তৈরি হয়েছিলো সব হারানো মানুষগুলোকে নিয়ে। সেই লড়াই পূর্ণতা পেলো ইংরেজ-বিরোধী, শোষক ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। 


আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে তাই কেবল এটাই বলব...
তিতুমীর মানে প্রতিরোধ।।

Your Opinion

We hate spam as much as you do