Tranding

03:36 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য ও এইসময়ে তার প্রাসঙ্গিকতা

ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য ও এইসময়ে তার প্রাসঙ্গিকতা

চিনে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতা ডাঃ সান ইয়াৎ সেন, ইন্দোনেশিয়ার সোয়েকর্ন, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, এঁরা সকলেই বারবার সমাজতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র প্রথমবার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে হরিপুরা অধিবেশনে বলেছিলেন, বিশ্বে একদিকে সাম্রাজ্যবাদ–পুঁজিবাদ আর একদিকে সমাজতন্ত্র৷ এই সমাজতন্ত্র আমাদের প্রেরণাদায়ক৷ এ দেশের বিপ্লবীরা সকলেই তাই মনে করতেন৷ বিংশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যত দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল, প্রত্যেকটি আন্দোলনকে মদত দিয়েছে, সাহায্য দিয়েছে রাশিয়ার সমাজতন্ত্র৷ না হলে সাম্রাজ্যবাদীরা সহজে পিছু হটত না৷

ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য ও এইসময়ে তার প্রাসঙ্গিকতা

ঐতিহাসিক নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য ও এইসময়ে তার প্রাসঙ্গিকতা

 


হাজার হাজার বছর ধরে,  মানব ইতিহাসে– সেই আদিম সমাজের পর থেকে যখন শ্রেণিবিভক্ত দাসসমাজ শুরু হল সেই যুগে, পরে রাজতন্ত্রের যুগে এবং পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের যুগে শোষিত অত্যাচারিত নিষ্পেষিত মানুষ চোখের জলে বারবার প্রশ্ন তুলেছে– এই দুঃখ–দুর্দশার অবসান হবে কি? শোষণ অত্যাচার বন্ধ হবে কি? শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে কি? মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম মার্কসবাদকে হাতিয়ার করে ভি আই লেনিন এবং তাঁর সুযোগ্য সহযোদ্ধা মহান স্ট্যালিন নভেম্বর বিপ্লব সংগঠিত করে উত্তর দিয়ে গেছেন– ইতিহাসে শ্রেণিশোষণ উচ্ছেদ করা সম্ভব, শোষিত মানুষ যদি বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে সংগঠিত হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, যদি সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে লড়াই করতে পারে তা হলে চিরদিনের জন্য মানবসমাজ থেকে শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিশাসন, অত্যাচার বন্ধ করা সম্ভব৷ নভেম্বর বিপ্লব এটা বাস্তবে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে৷

 

নভেম্বর বিপ্লব বিংশ শতাব্দীতে মানবসভ্যতায় আলোড়ন তুলেছিল৷ দেশে দেশে শোষিত মানুষকে অনুপ্রাণিত উৎসাহিত করেছিল৷ আবার এই নভেম্বর বিপ্লব বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী–পুঁজিবাদীদের আতঙ্কিত করে তুলেছিল৷ বিংশ শতাব্দীর সব থেকে মহৎ ও যুগান্তকারী ঘটনা নভেম্বর বিপ্লব৷ মহান নভেম্বর বিপ্লব শুধু বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার বুকে শোষণমূলক ব্যবস্থাকেই উচ্ছেদ করেনি, দেশে দেশে শোষিত শ্রমিক শ্রেণিকে শুধু অনুপ্রাণিতই করেনি, মানবসভ্যতার গতিপথ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও এই নভেম্বর বিপ্লব সৃষ্ট সমাজতন্ত্র নির্ণায়ক ভূমিকা গ্রহণ করেছিল৷ 

 

যেমন  আগে সমস্ত এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনক্ষেত্র ছিল, উপনিবেশ, আধা উপনিবেশ ছিল৷ এর বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতা আন্দোলন দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল তার প্রেরণা জুগিয়েছে নভেম্বর বিপ্লব সৃষ্ট রাশিয়ার সমাজতন্ত্র৷ এইজন্য চিনে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতা ডাঃ সান ইয়াৎ সেন, ইন্দোনেশিয়ার সোয়েকর্ন, আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, এঁরা সকলেই বারবার সমাজতন্ত্রকে অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা নেতাজি সুভাষচন্দ্র প্রথমবার কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে হরিপুরা অধিবেশনে বলেছিলেন, বিশ্বে একদিকে সাম্রাজ্যবাদ–পুঁজিবাদ আর একদিকে সমাজতন্ত্র৷ এই সমাজতন্ত্র আমাদের প্রেরণাদায়ক৷ এ দেশের বিপ্লবীরা সকলেই তাই মনে করতেন৷ বিংশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যত দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল, প্রত্যেকটি আন্দোলনকে মদত দিয়েছে, সাহায্য দিয়েছে রাশিয়ার সমাজতন্ত্র৷ না হলে সাম্রাজ্যবাদীরা সহজে পিছু হটত না৷ সমাজতন্ত্রের জন্যই বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পেরেছিল৷

 

ভারতবর্ষেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, এ কথা ঠিক৷ আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াইয়ের সংবাদ পৌঁছনো, বম্বের নৌবিদ্রোহ, তার আগে ’৪২–এর আগস্ট বিদ্রোহ একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল৷ তার চেয়েও বড় কথা সমাজতন্ত্রের বিজয়যাত্রা, পূর্ব ইউরোপের সমাজতন্ত্র, চিনের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের জয়যাত্রা, ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদীদের আতঙ্কিত করে দেয়৷ তাড়াতাড়ি তারা বোঝাপড়া করে নেয় ভারতবর্ষের পুঁজিপতি শ্রেণির সাথে যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়৷ কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা– এঁদেরও প্রেরণা দিয়েছে নভেম্বর বিপ্লব৷ আফ্রিকার প্যাট্রিস লুমুম্বা যাঁকে আমেরিকা হত্যা করেছিল তাঁরও প্রেরণাদাতা নভেম্বর বিপ্লব৷ আবার এই দেশগুলি স্বাধীন হওয়ার পরে সাম্রাজ্যবাদীরা চেয়েছিল যাতে এরা স্বাধীনভাবে মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে৷ তখন সমাজতান্ত্রিক শিবির এগিয়ে এসে উদার হস্তে এই দেশগুলিকে অর্থনৈতিক সাহায্য করেছিল৷ ভারতবর্ষ সহ এই সমস্ত দেশগুলিকে সর্বপ্রকারের সাহায্য করেছিল স্বাধীনভাবে দাঁড়াতে৷ 

 

একটা সময় ছিল এই নব্যস্বাধীন পুঁজিবাদী দেশগুলো চেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের কবজা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে৷ জোট নিরপেক্ষ গোষ্ঠী গড়ে তুলেছিল, তাও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সাহায্য নিয়েই৷ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যখন ফ্যাসিস্ট জার্মানি, ইটালি, জাপানি সাম্রাজ্যবাদ গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করছে, পূর্ব ইউরোপ দখল করেছে, ফ্রান্স দখল করেছে, ইংল্যান্ড দখল করার মুখে, জাপানের সৈন্যবাহিনী বর্মা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, চিন দখল করেছে–  এইভাবে গোটা বিশ্ব যখন বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে ত্রাতার ভূমিকা পালন করেছিল মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত লালফৌজ৷ এটি স্মরণীয় যে, সেই সময়ের বিশ্বের বরেণ্য মনীষী রমাঁ রলাঁ, বার্নার্ড শ, আইনস্টাইন, আমাদের দেশের সমস্ত বুদ্ধিজীবী মনীষী সকলেই তাকিয়ে ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে৷ 

 

রবীন্দ্রনাথ তখন রোগশয্যায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ লিখছেন, প্রতিদিন তিনি খবর নিতেন রাশিয়ার লালফৌজ কতটা এগোচ্ছে৷ যেদিন শুনতেন এগোচ্ছে না, কাগজ ছুঁড়ে ফেলতেন দুঃখে৷ যেদিন তাঁর অপারেশন হয় সেদিন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বললেন, লালফৌজ এগোচ্ছে৷ রবীন্দ্রনাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বললেন ওরাই পারবে, ওরাই ঠেকাতে পারবে, ওরাই জিতবে৷ সত্য সেটাই, যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন না থাকত, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র না থাকত, মহান স্ট্যালিনের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ লড়াই না হত, তাহলে সেদিন বিশ্বের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যেত৷ এটা শুধু আমাদের দাবি নয়৷ সাম্রাজ্যবাদীদের কর্ণধার চার্চিল, রুজভেল্ট এরা পর্যন্ত সোভিয়েতের এই ভূমিকা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল৷ ফলে নভেম্বর বিপ্লব মানব ইতিহাসে নির্ণায়কের ভূমিকা নিয়েছিল৷

 


এই নভেম্বর বিপ্লবকে একদিকে আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, প্রেমচন্দ, সুব্রমণিয়ম ভারতী, মুলক রাজ আনন্দ, কিষণচন্দ, ইকবাল, নজরুল– এইসব সাহিত্যিকরা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন৷ শরৎচন্দ্র শ্রমিক বিপ্লবের আহ্বান নিয়ে ‘পথের দাবী’ লিখেছেন, যা ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল৷ নজরুল সাম্যবাদ ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্যের জয়গান গেয়ে কবিতা রচনা করেছেন৷ আবার বিপিনচন্দ্র পাল, বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রাই, এঁরাও অভিনন্দন জানিয়েছিলেন৷ সুভাষচন্দ্র অভিনন্দন জনিয়েছিলেন, নেহেরু নভেম্বর বিপ্লবকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছিলেন৷ গান্ধীজিও প্রশংসা করেছিলেন৷ যদিও এঁরা কেউই কমিউনিস্ট ছিলেন না৷ পাশ্চাত্যের রমাঁ রলাঁ, বার্নার্ড শ, আইনস্টাইন, এঁরাও সমাজতন্ত্রের নির্লিপ্ত  প্রশংসা করেছিলেন৷ কী দেখে? তাঁরা দেখেছিলেন ফরাসি বিপ্লব রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র কায়েম করেছিল, সেখানকার ভূমিদাসরা উদীয়মান বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করেছিল তাতে স্লোগান উঠেছিল 

 

সাম্য–মৈত্রী–স্বাধীনতা-সেকুলার মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করার৷ দাবি উঠেছিল গণতন্ত্র কায়েমের৷ আমেরিকা থেকে উঠেছিল ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, অফ দ্য পিপল–এর ধারণা৷ এটা একটা নতুন আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছিল বিশ্বে৷ পরবর্তীকালে এই বুর্জোয়া শ্রেণি তার রাজতন্ত্রবিরোধী সংগ্রামের স্তরে, যখন তার কৈশোর–যৌবন ছিল, তার যে প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, তা অতিক্রম করে পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মে ক্ষুদ্র পুঁজি যখন বৃহৎ পুঁজি, একচেটিয়া পুঁজিতে পরিণত হয়, তখন সাম্য–মৈত্রী–স্বাধীনতার ঝান্ডা, গণতন্ত্রের ঝান্ডা, মানবতাবাদের ঝান্ডা ছুঁড়ে ফেলে দেয়৷ ফলে বুর্জোয়া বিপ্লবের সাম্য–স্বাধীনতার স্লোগান পরবর্তীকালে বুর্জোয়ারাই পদদলিত করেছে৷ আজ আমরা পৃথিবীর সর্বত্র দেখছি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কী চরম বৈষম্য! 


সমীক্ষা বলছে , এক শতাংশ মানুষ ৯৯ শতাংশ মানুষের সম্পদের মালিক৷ ৩০০ কোটি মানুষের সমান সম্পত্তির মালিক বিশ্বের মাত্র ৮টি পরিবার৷ আমাদের দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের সমান সম্পত্তির মালিক মাত্র ৫৭টি পরিবার৷ একদিকে শ্রমিকদের প্রাপ্য ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয়ের হাতে সঞ্চিত হয়েছে বিশাল ধন সম্পদ, বিশাল ঐশ্বর্য, চলছে তাদের রাজকীয় ভোগবিলাস৷ অন্যদিকে কোটি কোটি বেকার ও ক্ষুধার্ত মানুষ, ছাঁটাই শ্রমিক অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মরছে৷ এই চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় কি সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব? ফলে পুঁজিবাদ সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি৷ বৈষম্যের উপরে পুঁজিবাদ দাঁড়িয়ে আছে৷ 

 

পুঁজিবাদ মানবজাতির মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী গড়ে তুলবে কি, বরং তা ধ্বংস করছে৷ ধর্মবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ এসবের মধ্য দিয়ে সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ধ্বংস করছে৷ আর স্বাধীনতা বলতে পুঁজিবাদ বোঝে লুণ্ঠনের স্বাধীনতা, শোষণের স্বাধীনতা৷ একচেটিয়া পুঁজিপতিরা অবাধে শোষণ করবে, লুণ্ঠন করবে– এই স্বাধীনতা৷ আর জনগণের রয়েছে অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর স্বাধীনতা, আত্মহত্যার স্বাধীনতা৷ প্রতিবাদ করার কোনও উপায় নেই, প্রতিরোধ করার উপায় নেই, করলেই চরম দমন–পীড়ন৷

 

নিঃসন্দেহে সমাজজুড়ে এইসব দুঃখ দারিদ্র সংকট যতদিন থাকবে ততদিন মানুষ নতুন সময়ে নতুন আঙ্গিকে এক প্রতিবাদ প্রতিরোধ করবে। আর এই সংগ্রামে আলোকবর্তিকার মত পথ দেখাবে নভেম্বর বিপ্লব। 

Your Opinion

We hate spam as much as you do