Tranding

03:21 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ : দুই মহামানবের মিল, অমিল

গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ : দুই মহামানবের মিল, অমিল

রবীন্দ্রনাথ চরকা কাটার সমালোচনা করেছিলেন , যদিও রোমা রোলা লেখেন……। Rabindranath never tires of criticizing charka. In this economic judgment, Tagor was probably right . Except for the rather small specialized market for high quality spun cloth, it is hard to make economic sense of hand spinning even with wheels less primitive than Gandhi’s charka. Hand spinning as a wide spread activity can survive only with the help of heavy govt. subsidies. গান্ধী তার উত্তরে লেখেন …… I am living on the spoliation of my countrymen. Trace the source of every coin that finds it’s into your pocket, and you will realize the truth of what I write . Everyone must spin; let tagor spin like the others. Let him burn his foreign cloths, that is the duty today, God will take care of the morrow .

গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ : দুই মহামানবের মিল,  অমিল

গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ : দুই মহামানবের মিল,  অমিল

 2 October, 2023 IST


 ২রা অক্টোবর ২০২৩

 

 
গান্ধীজি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক অত্যন্ত আকর্ষণের বিষয়। গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র আট বছরের ছোট ছিলেন z ওদের বড় হয়ে ওঠা বা মধ্য বয়স ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উত্তাল সময়z গান্ধীজির সাথে বাংলার সম্পর্কও তাই।  গোপালকৃষ্ণ গান্ধী তাঁর পিতামহের স্মৃতিআশ্রিত বইটির নাম দিয়েছেন  'A Frank Friendship , Gandhi and Bengal'(2007) আর অমর্ত্য সেন তারই সূত্র ধরে বইভূমিকায় মন্তব্য করেছেন, ' there were apparent elements of tension in Bengal's connection with Mohandas Karamchand Gandhi that demanded candidness'. বাংলার সাধারণ মানুষ গান্ধীজির প্রভাবে আপ্লুত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিশীল ও বিদ্বজ্জন সমাজ তাঁকে যেন  খানিকটা   দূরেই  সরিয়ে  রেখেছিলেন - কিছুটা  সমীহ , কিছুটা সংশয় ও কিছুটা  সন্দেহ নিয়ে। এই জট কাটানোর জন্য প্রয়োজন ছিল candid বা খোলামেলা আলোচনা যা আদপে হয়ে ওঠেনি। তাই  বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের চোখে একদিকে তিনি যেমন জাতির জনক বা মহাত্মা রূপে নন্দিত হয়েছিলেন, অপরদিকে তিনি একজন বিজ্ঞান-বিমুখ, আধুনিকতা-বিরোধী, পশ্চাৎমুখী ব্যক্তিত্বরূপে প্রত্যাখ্যাতও  হয়েছিলেন।

 

 

গান্ধীজির পরিভাষায় যা হল ‘অহিংসা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাণীতে তাই হল ‘আনন্দ’। এখানেই তাঁদের পার্থক্য এবং এখানেই তাঁদের মিল; একথা বলেছেন প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ শ্রী অম্লান দত্ত। পরস্পরকে ‘মহাত্মা’ ও ‘গুরুদেব’ নামে সম্বোধন করা ছাড়াও দু’জনেরই উদ্দিষ্ট ছিল অন্তর্শক্তি বা আত্মশক্তির উদ্বোধন। গোপালকৃষ্ণ মহাশয়ের মতে গান্ধীজি যদি হন nationalist বা জাতীয়তাবাদী তবে রবীন্দ্রনাথ হলেন universalist বা বিশ্বমানবতাবাদ; আশীষ লাহিড়ির অনুবাদে ‘সর্বজনীন’। গান্ধীজির কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক আলোকিত সত্তা, 'a pure force' যাঁর বহু গুণাবলী তিনি নিজের মধ্যে আয়ত্ত করতে চাইতেন। অপরপক্ষে গুরুদেব মুক্তকন্ঠে প্রশংসা করতেন গান্ধীজির ‘আত্মশ্রদ্ধার আদর্শ-কে, যা ভারতবর্ষের যুগ যুগান্তরের জড়তাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। মহাত্মাজীর জন্মদিনে প্রদত্ত ভাষণে কবিগুরু বলেন, ‘ইনি আসিবার পূর্বে দেশ ভয়ে আচ্ছন্ন, সঙ্কোচে অভিভূত ছিল; কেবল ছিল অন্যের অনুগ্রহের জন্য আব্দার-আবেদন, মজ্জায় মজ্জায় আপনার পরে আস্থাহীনতার দৈন্য’। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে কবিগুরুর সক্রিয় ভূমিকা তাঁকে গান্ধী-পূর্ববর্তী কংগ্রেসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেছিল। তিনি বুঝেছিলেন যে গান্ধীজির আবির্ভাব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক নতুন অভিমুখে ধাবিত করবে। বহু বছরের বিদেশী শাসনভারে ক্লান্ত মেরুদন্ডহীন জনমানসকে  গান্ধীজি সজোর আঘাতে জাগিয়ে তুলবেন। রবীন্দ্রনাথ বারবার বোঝাতে চাইতেন যে খদ্দর-চরকার প্রচার ও আধুনিক চিকিৎসায় যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রতি অবিশ্বাস  -  শুধু এইটুকুর মধ্যে এই কর্মবীরকে যেন সীমাবদ্ধ না করা হয়। আমাদের বুঝতে হবে তাঁর কমর্ধারার মূল আদর্শ, তাঁর আত্মজাগরণের দর্শন! গান্ধীজির বিশ্বাস ছিল এই যে, ‘ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় আমরা অন্যায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করি বলেই অন্যায় সম্ভব হয়। শোষণ সম্ভব হয় না যদি শোষিত সবাই শোষণকারীর আজ্ঞা পালন করতে দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃত হয়। ...সত্যাগ্রহীর প্রথম কর্তব্য অন্যায় শর্ত গ্রহণ না করা, অন্যায় নিয়ম অমান্য করা, তাতে যত আঘাতই আসুক না কেন।...অসহযোগ যদি সম্পূর্ণ হয় তবে সাফল্য সুনিশ্চিত।‘  সত্যাগ্রহের মূল কথাই হল অন্যায়ের সঙ্গে অসহযোগ, কিন্তু অন্যায়কারীর প্রতি হিংসাবৃত্তি নয়।

 

ভারতের রাজনীতিতে গান্ধীজি প্রথম পা রাখেন ১৯১৫ সালে। সেই বছরেই তিনি শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে যান। কবির বয়স তখন ৫৩। এক বছর আগেই তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন; শান্তিনিকেতনের বয়স তখন ১৫ এবং গান্ধীজি ৪৫। গান্ধীজি অনুধাবন করেছিলেন যে কবিগুরুর শান্তিনিকেতনে নতুন কিছু ঘটতে চলেছে এবং সেখানে আতিথ্য নিয়েছিলেন প্রায় এক মাস। সেই সময় থেকেই তাঁদের মধ্যে যুগপৎ বিরোধ এবং  বন্ধুত্বের সূত্রপাত।

 

তাঁদের বিতর্কগুলি মূলতঃ প্রকাশিত হয় Modern Review ও Young India পত্রিকা দু’টিতে। ১৯১৯ থেকে ১৯২২ - খিলাফৎ আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে গান্ধীজি জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠেন। কিন্তু কবিগুরু এই আন্দোলনের বহু নীতি-প্রকৃতির সাথে একমত হতে পারেননি। অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তাঁদের মধ্যেকার বিতর্কও তীব্র হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য ১৯২১-এ Modern Review তে C .F. Andrews-কে লেখা কবির চিঠিপত্র, প্রত্যুত্তরে Young India-য় (June 1921) গান্ধীজির দু’টি প্রবন্ধ, 'English Learning' ও 'The Poet's Anxiety', তার জবাবে Modern Review-তে পুনরায় কবির রচনা, 'The Call of Truth' এবং তার প্রেক্ষিতে গান্ধীজির প্রতিবেদন 'The Great Sentinel' (October, 1921)। ১৯২২-এর ১০ মার্চ,  মহাত্মাজীর গ্রেফতারের সাথে এই বাদানুবাদে ছেদ পড়ে, কবি ধীরে ধীরে সরে আসেন এই তর্ক বিতর্কের আবর্ত থেকে।

২০১৯-এ  Tata Steel Literary Meet-এ প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বলেন যে গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথকে মনে করতেন এক সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব - 'a master of spoken and written word and an artist in the fullest sense of the term.' রবীন্দ্রনাথের বিশ্বচেতনা তিনি আকাঙ্ক্ষা করতেন, কিন্তু জাতীয়তাবাদী কার্যক্রমের উত্তেজনায় তা আর সম্ভবপর হয়ননি। শান্তিনিকেতনের আর্থিক বিপর্যয়কালেও গান্ধীজি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।

 

আর একটি বিষয় উভয়ের মত পার্থক্যের কারন হয় z ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯২১ দলীয় কাজে কলকাতায় পৌঁছনোর পর, ৬ তারিখ জোড়াসাঁকোয় এসে, গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথকে অসহযোগ আন্দোলনের আদর্শ ব্যাখ্যা করে তাঁর সমর্থন আশা করেন। কিন্তু ‘রবিজীবনী’-র অষ্টম খন্ডে প্রশান্ত কুমার পাল মশাই যা বিবৃতি দিয়েছেন তাতে বুঝে নেওয়াই যায় কবিগুরুর প্রতিক্রিয়া তখন  ঠিক কি হয়েছিল: ‘উভয়ের আলোচনা যখন চলছে, তখন গান্ধীজির অহিংস অসহযোগীরা বিলিতি বস্ত্রের বহ্ণুৎসব করছিল পৈশাচিক উল্লাসধ্বনির সাথে’। এই ধরণের সঙ্কীর্ণ বা জঙ্গী জাতীয়তাবাদের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বারবার তাঁর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। বিলিতি পণ্য বয়কট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ইংরাজের গোলামখানা’ নাম দিয়ে ছাত্রদের তা বর্জন করার আন্দোলন, পশ্চিমী বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি অনাস্থা, কবিগুরুর দৃষ্টিভঙ্গীর সম্পূর্ণ বিপরীতগামী ছিল। চরকা কাটলে দু’দিনেই স্বরাজ আসবে এবং ১৯৩৪-এ বিহার ভূমিকম্পের কারণ হরিজনদের উপর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অত্যাচারের পাপের ফল - এই ধরণের ব্যাখ্যা কবিকে নিরাশ করেছিল। তিনি ব্যাকুল হয়ে নানা প্রবন্ধ ও বক্তৃতায় এই অযৌক্তিক ব্যাখ্যার  সমালোচনা ও বিরোধিতা করেন। একাধিক ক্ষেত্রে গান্ধীজির এহেন যুক্তিহীন বক্তব্য আমাদের আশ্চর্য করে ঠিকই, কিন্তু গান্ধীজির সাম্প্রতিক জীবনীকার, রামচন্দ্র গুহ  তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইভাবে: 'It stemmed from his frustration at the deep rooted prejudices of his fellow Hindus, that he had been trying so long and heroically to combat’। অর্থাৎ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশবাসীর সাথে লড়ার জন্য তাঁকে কুসংস্কারের আশ্রয় নিতে হয়েছে! উচ্চবর্ণ হিন্দুদের অস্পৃশ্যতার সংস্কারমুক্ত করতে এই ছিল তাঁর অস্ত্র।

১৯২১-এ, কবি যখন উত্তর আমেরিকায় বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহে ব্যস্ত, তাঁর চোখে পড়ল গান্ধীজির লেখা একটি প্রতিবেদন যার শিরোনাম 'Evil Wrought by the English Medium’। তাতে বলা হয়েছিল রামমোহন রায় আরও বড় সংস্কারক হতেন এবং লোকমান্য তিলক আরও বড় পন্ডিত, যদি ইংরাজী ভাষায় তাঁদের চিন্তা ভাবনার প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতেন। গান্ধীজি মনে করতেন ইংরাজী শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ একটি কুসংস্কার মাত্র; ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার ফল 'the tendency has been to dwarf the Indian body, mind and soul'; এর উত্তরে ব্যথিত কবি অ্যান্ড্রুজকে লিখলেন, 'I strongly protest against Mahatma Gandhiji's trying to cut down such great personalities of Modern India  as Rammohan Roy in his blind zeal for crying down our modern education’। সেপ্টেম্বরে জোড়াসাঁকোয় গান্ধীজি কবির সাথে দেখা করতে এলে তিনি বলেন, 'the whole world is suffering today from the cult of a selfish and short-sighted nationalism ...we not only have much to learn from the West but that we also have something to contribute. We dare not therefore shut the West out'.

 

১৯১৯-এর ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষিতে কবিগুরু তার ‘নাইটহুড’ পরিত্যাগ করেন। এই প্রসঙ্গে ভাইসরয়কে লেখা তাঁর চিঠি একটি জ্বলন্ত অঙ্গার বলা যেতে পারে: The enormity of the measures taken by the Government in the Punjab for quelling some local disturbances has, with a rude shock, revealed to our minds the helplessness of our position as British subjects in India. The disproportionate severity of the punishments inflicted upon the unfortunate people and the methods of carrying them out, we are convinced, are without parallel in the history of civilized governments…। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই যে গান্ধীজি এই অগ্নিবর্ষী চিঠি ও নাইটহুড পরিত্যাগের মতো ঘটনাকে ‘premature’ বলে নস্যাৎ করে দেন। অথচ, এর ঠিক দু’মাস বাদে তিনি নিজেও ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত দু’টি পদক স্বেচ্ছায় বর্জন করেন।

 

অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গুরুদেবের ছাত্রেরা এক বিতর্কসভার আয়োজন করেন। গান্ধীজি ও গুরুদেবের মতবাদের তুল্যমূল্য আলোচনার পর ভোটাভুটি হবে স্থির হয়। ভোট নেওয়ার পর দেখা গেল অধিকাংশ ছাত্রই গান্ধীপন্থী। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এবং তিনি এই ভেবে আনন্দিত হয়েছিলেন যে তাঁর ছাত্রেরা যথার্থ শিক্ষা লাভ করেছে, কারণ তারা মুক্ত মনের অধিকারী। এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন শ্রী কৃষ্ণ কৃপালিনী যিনি পরে বিবাহসূত্রে ঠাকুরবাড়ির সদস্য হন।

শিক্ষাদানের নিরিখে প্রাথমিকভাবে শান্তিনিকেতন ও সবরমতী একই ধারার কেন্দ্র ছিল। শিক্ষার দর্শন নিয়ে দুই ব্যক্তিত্বের মতবিরোধ ছিল বটে কিন্তু তা কখনোই সংঘাতের পর্যায়ে পৌঁছয়নি। দু’জনেই এমন শিক্ষাধারার কথা ভাবেন যা সরকারী ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং যার মূল ভিত্তি হল (ক) মাতৃভাষায় শিক্ষাদান (খ) দেশজ সংস্কৃতির সাথে পরিচয় (গ) সৃষ্টিশীল বা হাতেকলমে শিক্ষা। ১৯২৫-এ শ্রীনিকেতনের পাঠশালা ‘শিক্ষা সত্র’ পরিদর্শন করতে গান্ধীজি আসেন এবং ১৯৩৪-এ ওয়ার্ধায় তাঁর স্কুল স্থাপনাকালের বিভিন্ন পর্যায়ে ‘শিক্ষা সত্র’-এর অধ্যক্ষের সহযোগিতা আহ্বান করেন। তাঁর শিক্ষানীতি 'Basic Education Scheme' নামে ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

 

এই নীতি পর্যালোচনা করে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, এই শিক্ষা বড্ড বেশী বস্তুনির্ভর এবং ছাত্রদের সার্বিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিপন্থি। অপরপক্ষে, গান্ধীজির যুক্তি ছিল সরকার নিরপেক্ষ ‘আত্মনির্ভরতা’ ও ‘আর্থিক স্বয়ম্ভরতা’ গড়ে তোলা। কবি এই নিয়ে আর আলোচনা দীর্ঘায়িত করেননি বরং 'Gandhiji's genius is essentially practical' এই বলে ব্যাপারটিতে ইতি টানেন।

 

গান্ধীজির কাছে ‘স্বয়ম্ভরতা’ মানে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণতা’। তাই বর্হিবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বিচ্ছিন্ন অস্তিত্ব মানে অপূর্ণতা। সেই কারণেই তাঁর হাতে গড়া শান্তিনিকেতন আশ্রম একদিন বিশ্বভারতী হয়ে উঠল। গান্ধীজি যখন অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন বিশ্বভারতী তখন দু’হাত বাড়িয়ে আপন করে নিচ্ছে তার বিদেশী অতিথিদের; বিশ্বভারতীর চালিকাশক্তি হল  বর্হিবিশ্বের সাথে সংযোগ; এই যোগসূত্র ব্যতীত কোন স্বয়ম্ভরতাই সম্পূর্ণ নয়, এই ছিল বিশ্বকবির দর্শন। গান্ধীজি বা রবীন্দ্রনাথ – দু’জনেরই কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিল পল্লী উন্নয়ন। জীবনের মধ্যপর্বে এসে কবি কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিলেন শান্তিনিকেতন ও সুরুলের গ্রাম। অতঃপর চল্লিশ বছর ধরে চলল গ্রামীণ বিকাশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সাধনা। ইতিমধ্যে গান্ধীজিও আত্মনিয়োগ করেছেন গ্রাম উন্নয়নে - প্রথমে সবরমতী ও পরে সেবাগ্রামে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সুনির্দিষ্ট মত হল এই যে ভারতবর্ষে চিরকালই রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব ছিল; রাজনৈতিক উত্থান-পতন  সমাজ সংস্কৃতিকে কোনোভাবে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। যবে থেকে দেশবাসী সরকারের মুখাপেক্ষি হল তবে থেকে আমরা ঐতিহ্যবিচ্যুত হলাম; গ্রামে গ্রামে যে সামাজিক স্বরাজের কাঠামো ছিল তা বিলুপ্ত হল। দুই মণীষীই বিশ্বাস করতেন যে গ্রামজীবনের চর্যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সনাতন ঐতিহ্য। সেই জীবনচর্যার মূল মন্ত্র হল ‘মানুষে মানুষে সম্পর্ক স্থাপন’; ‘পল্লিসমাজ মানেই হল আত্মীয়সমাজ বা প্রতিবেশী সমাজ’। কবিগুরু তার ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মানুষের সাথে মানুষের সম্বন্ধ স্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল...’। দুই মণীষীই রাষ্ট্রকে দেখেছেন হৃদয়হীন যন্ত্রের মতো আর পল্লীসমাজের মধ্যে পেয়েছেন ‘মানবসম্বন্ধের মাধুর্য’। শক্তি ও অর্থের সাধনা করতে গিয়ে আমরা যদি আত্মীয়সম্বন্ধকে অস্বীকার করি তবে জীবন গ্লানিময় হতে বাধ্য। পল্লীজীবনে উন্নয়নের জোয়ার এনে দারিদ্র্য ও অশিক্ষামুক্ত করতে পারলে তবেই আসবে উদ্দিষ্ট মেলবন্ধন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘সব মানুষের ভিতরেই একটা তেজ থাকে, শক্তি থাকে। সাধারণতঃ তাকে আমরা শুদ্ধরূপে পাই না। বহু অশুদ্ধ উপাদানের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে প্রবাহিত হয় সে শক্তি। কিন্তু তাকে অনুশীলনের ভিতর দিয়ে ক্রমে শুদ্ধ করে নেওয়া যায়। এই শুদ্ধ তেজকেই গান্ধীজি বলছেন আত্মার শক্তি অথবা সত্যের শক্তি। আবার একেই বলা যায় প্রেমের শক্তি।‘

 

রাজা বা জমিদারের উপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পল্লীসমাজের একমাত্র পথ হল ‘সমবায়’ নীতি। গ্রামকে ক্লিষ্টতা থেকে মুক্ত করতে সমবায় গঠন যে একমাত্র পথ এ ধারণা জোরালোভাবে ব্যক্ত হয়েছে দুই মণীষীরই ভাবনায়। সমবায় গঠনের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি যে পৃষ্ঠপোষকতা, তার মধ্যে নিহিত আছে ঐক্যবোধের তত্ত্ব;  ঐক্য মানে সম্পর্ক, ঐক্য মানে সত্য। যা কিছু মানুষে-মানুষে বিচ্ছিন্নতা ঘটায় তা হল ‘সত্যের ত্রুটি’।

 

বৃহৎ শিল্পের প্রতি গান্ধীজি বিরূপ ছিলেন এরকম একটি ধারণা জনমানসে প্রচলিত রয়েছে। আসলে তিনি যেটি চাননি সেটি হল যন্ত্রের আধিপত্যে মানবিক গুণের অবলুপ্তি। সমাজের ধারায় প্রযুক্তি চালিত হবে, প্রযুক্তির  ধারায় সমাজ নয় - এই ছিল তাঁর আদর্শ। অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞানের প্রয়োজন ছিল অপরিসীম - মানুষকে কুসংস্কারমুক্ত করতে এবং দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষকে সহায়তা দিতে বিজ্ঞান ছাড়া গতি নেই - একথা  তিনি সম্যক বুঝেছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, বিজ্ঞান এক মহা শক্তি এবং সমাজের প্রয়োজনে তাকে স্বাগত জানানোর প্রয়োজন আছে।

 

১৯২৪-এ গান্ধীজির জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনায় কবিগুরু যারপরনাই আনন্দিত হয়ে ঘোষণা করলেন, 'We Rejoice'। ১৯২৫-এ গান্ধীজি শান্তিনিকেতন এলেন এবং নতুন করে দু’জনের মধ্যে শুরু হল সেই চিরাচরিত দ্বৈধতা। ১৯২৫-এ লেখা 'Cult of the Charkha'-এ কবি গান্ধীজির চরকা কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। তিনি বলতে চাইলেন, শুধু চরকা নিয়ে বাড়াবাড়ি গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া, বহির্জগতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যতীত দেশের অর্থনীতি কোনোদিন গতি পাবে না। 

 

 

রবীন্দ্রনাথ চরকা কাটার সমালোচনা করেছিলেন , যদিও রোমা রোলা লেখেন……। Rabindranath  never  tires of criticizing  charka. In this economic judgment, Tagor was probably right . Except for the rather small specialized market for high quality spun cloth, it is hard to make economic sense of hand spinning even with wheels less primitive than Gandhi’s charka. Hand spinning as a wide spread activity can survive only with the help of heavy govt. subsidies.

গান্ধী তার উত্তরে লেখেন …… I am living on the spoliation of my countrymen. Trace the source of every coin that finds it’s into your pocket, and you will realize the truth of what I write . Everyone must spin; let tagor spin like the others. Let him burn his foreign cloths, that is the duty today, God will take care of the morrow .   

 

 

সকল সমালোচনার উত্তরে গান্ধীজি দৃঢ় ভাষায় বললেন, 'It was our love of foreign cloth that ousted the wheel from its position of dignity. Therefore, I consider it a sin to wear foreign cloth'। চরকা আসলে স্বয়ম্ভরতার প্রতীক; এর উদ্দেশ্য দিনে-রাতে চরকা কাটা নয় - 'Social reform, personal uplift, economic self sufficiency, national pride: the making of khadi, symbolized and contributed to all these'। গান্ধীজির অনুগামীরা কবির সমালোচনায় বিরূপ হয়েছিলেন, কিন্তু গান্ধীজি বললেন, 'Frank criticism pleases me for our Friendship becomes all the richer by our disagreements'।

 

সত্যকে কার্যকরী করতে দু’জনাই চেয়েছেন সরলতা ও সংযমের আচরণবিধি। রবীন্দ্রনাথ ভোগবাদকে দমন করেছেন সৌন্দর্যবোধের দ্বারা, আর গান্ধীজি নৈতিকতার দ্বারা। ১৯২৯-এ একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “Mahatmaji is the prophet of 'tapasya' and I am the prophet of 'ananda'”; অর্থাৎ, একজন  সংযমের সাধক, অপরজন জীবন-উচ্ছ্বাসের প্রবক্তা; সর্ববিধ ভয় জয় করা ছিল গান্ধীজির তপস্যা, আর জীর্ণতা থেকে উত্তরণ ছিল রবীন্দ্রনাথের আনন্দ!

 

এই দুই মণীষীর সামাজিক/রাজনৈতিক/ দার্শনিক মতদ্বৈধতা ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বিবাদ, বিসম্বাদ বা বিরূপতার বদলে তাঁদের বিতর্ক থেকে যা উদ্ভূত হয় তা হল সত্যের বহুমাত্রিক রূপ। সেই কারণেই পন্ডিত রম্যাঁ রল্যাঁ এই বিতর্কের চরিত্রকে বলেছেন 'noble debate' এবং জওহরলাল নেহেরু, শত বৈপরিত্য সত্ত্বেও, এই দুই মণীষীর একসূত্রের বাঁধনটি খুঁজে পেয়েছেন দেশজ জীবনচর্যার শিকড়ে। ১৯৪১-এ কবিগুরুর মৃত্যুর পর এক চিঠিতে তিনি লিখলেন: 'I think of the richness of India's cultural genius, which can throw up in the same generation two such master types...typical of her in every way, yet representing different aspects of her many sided personality'। গান্ধীজি স্বয়ং কবিগুরুর মৃত্যুর চার বছর বাদে শেষবারের মতো শান্তিনিকেতনে পদার্পণ করে বলেন: 'I started with a disposition to detect a conflict between Gurudev and myself but ended with the glorious discovery that there was none!'.....আমার উজ্জ্বল আবিষ্কার এই যে আমাদের মধ্যে আদতে কোন দ্বন্দ্বই ছিল না!

Your Opinion

We hate spam as much as you do