জিজ্ঞেস করতেই কান্নাভেজা গলায় প্রিয়া বলল "বাবা আমায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে । আমি কিছুতেই এখন বিয়ে করব না। পড়াশোনাটা শেষ করতে পারব না। এখন সবাই বলছে স্কুল বন্ধ, শুধু শুধু বাড়িতে বসে বসে সময় নষ্ট হচ্ছে । তাই আমার নাকি বিয়ে করে নেওয়াই উচিৎ।"
একা ক্লাসরুম। একা সবাই
আকাশ কর
মুস্তাফার সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছে আজ। মুখ টুখ ধুয়ে নাকে মুখে কিছু গুঁজেই সাইকেল নিয়ে ছুট দিল সে। দশটা থেকে কলেজের অনলাইন ক্লাস। এখন সাইকেল চালিয়ে যেতে হবে প্রায় ১ ঘন্টা। তারপর নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। রাস্তায় কােথাও খাতা কলম নিয়ে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা
এখন চলবে লেখাপড়া .বান্ধবী প্রিয়ার ফোন ধরতেই রুবি শুনল ঝরঝর করে কাঁদছে সে। "একি, কি হয়েছে, কাঁদছিস কেন?” জিজ্ঞেস করতেই কান্নাভেজা গলায় প্রিয়া বলল
"বাবা আমায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে । আমি কিছুতেই এখন বিয়ে করব না। পড়াশোনাটা শেষ করতে পারব না। এখন সবাই বলছে স্কুল বন্ধ, শুধু শুধু বাড়িতে বসে বসে সময় নষ্ট হচ্ছে । তাই আমার নাকি বিয়ে করে নেওয়াই উচিৎ।" স্বান্তনার কোনও ভাষা ছিল না রুবির কাছে। প্রিয়ার নিরুত্তর চোখের জল আর
ফাঁকা শ্মসানের মত ক্লাসরুমের একা বেঞ্চ একইরকম অসহায় ।
স্থান কাল পাত্র ছাড়া এই দুটো ঘটনার সবটাই ঘোরতর বাস্তব। আমাদের দেশ বিশেষ করে আমাদের বাংলার ছোট ছোট কুড়িদের স্বপ্ন এই দুই বছরে দুুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। লকডাউনে দীর্ঘ দেড় বছর শাটডাউন থাকল লেখাপড়া। আমাদের রাজ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পরেও গড়াচ্ছিল না শুধু লোকাল ট্রেন আর খুলছিল না স্কুল কলেজের তালা। লোকাল ট্রেন না চললে বাড়ে অন্য গাড়ি চড়ার পরিমাণ আর তাতেই বাড়ে তেলের বিক্রি । সরকারের লাভ। দান খয়রাতিতে সুবিধে। কিন্তু স্কুল কলেজ? "ওরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে। তত কম মানে....।" শ্রেফ এজন্যই। সমাজের সবথেকে স্পশকাতর অংশ যারা যে কোনও কিছুকেই প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করলে চায় না তাদের বিচ্ছিন্নতার অবসাদে ডুবিয়ে রাখো!
এই দেড় বছরে ভয়ংকর পরিস্থিতি হয়েছে আমাদের রাজ্যের। একদিকে কেন্দ্রীয় জাতীয় শিক্ষানীতির চাপে এমনিতেই গরীব পরিবারের ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তার উপর লেখাপড়ায় সরকারি ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় এবং বিশেষ করে অনলাইন শিক্ষার চাপে কার্যত তাদের ছাত্রাবস্থা খাদের কিনারায় । বিভিন্ন সমীক্ষায় এই সময়ে ধরা পড়েছে প্রাথমিক শিক্ষার স্তরে থাকা বড় অংশ অক্ষর ও সংখ্যা জ্ঞান ভুলতে বসেছে। সমস্ত স্কলারশীপ বন্ধ। পরিকাঠামাে ধ্বংস হোস্টেলে হোস্টেলে । সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে সমাজের প্রান্তিক অংশের ছাত্রছাত্রীরা। একদিকে যেমন আজকের শিক্ষাব্যবস্থাকে সস্তার শ্রমিক বানানোর কারখানায় পরিণত করা হচ্ছে তখন এই সময় রাজ্যের সরকার আমাদের ভবিষ্যৎ দের কার্যত জোর করে ঠেলে দিচ্ছে শিশুশ্রমের দিকে। হু হু করে বেড়েছে ওয়ার্কিং স্টুডেন্টের সংখ্যা । এমনিতেই এ রাজ্যে কর্মসংস্থানের কোনও চিহ্ন নেই। এই সময়ে ছাত্রদের কাছে আরও কমেছে পড়াশুনা গুরুত্ব। এই প্রবণতা ভয়ংকর। এসএফআই এর টানা আন্দোলনের ফলে স্কুল কলেজ খুলতে বাধ্য হলেও স্কুল ছুটদের ক্লাসে
ফেরানোর কোনও উদ্যোগ নেই । গত দুই বছর কার্যত বিনা কারণে ছাত্রছাত্রীদের ফি দিতে হয়েছে ৷ বেসরকারী ক্ষেত্রেতো কোনোও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এই শিক্ষাবর্ষে কেন সরকার সমস্ত ফি মকুব করবে না? কেন স্কলারশীপ বাড়াবে না? কেন বিশেষ স্টিমুলাজ প্যাকেজ দিয়ে সরকার চেষ্টা করবে না স্কুলছুটদের ফেরাতে ? যখন মুকেশ আম্বানীরা প্রতিনিয়ত বাড়াচ্ছে ডেটাপ্যাকের দাম তখন অনলাইন ক্লাস করতে বাধ্য করা ছাত্রছাত্রীদের কেন ফ্রী ডেটাপ্যাক দেবেনা সরকার? প্রশ্ন উঠছে ৷ শুধু বামেরা তুলছে না। প্রশ্ন উঠছে মাঠ ময়দান থেকেই। উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় এসএফআই তৈরি করেছে অ্যান্টি ড্রপআউট স্কোয়াড। সারা রাজ্য জুড়ে চলছে সার্ভে । পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে। খুঁজে বের করা হবে কারা কারা ড্রপআউট হয়ে গেছে।
তাদের ক্লাসে ফেরানোর চেষ্টা এসএফআই করবে। তাদের মত করে, তেমধ করেই সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। না নিলে এই সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সংঘর্ষের রাস্তাতেই যেতে হবে । তিলতিল করে গড়া এই রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় সকলের অংশগ্রহনের সুযোগ ধ্বংস হতে দেওয়া যাবে না।
কথা না শুনলে কিঞ্চিৎ গোলযোগ হবে। "ভগবান" এর নিদ্রা না হলে ভাঙবে না .
( লেখক রাজ্যের বাম ছাত্রসংগঠন এসএফআই এর নেতা এবং উত্তর ২৪পরগনার সম্পাদক )
We hate spam as much as you do