Tranding

02:15 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / বৌদ্ধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থে ইউনিয়ন জরুরি

বৌদ্ধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থে ইউনিয়ন জরুরি

শিক্ষায় বেসরকারীকরণের কাছ থেকে দুরকম বৈশিষ্ট্যের মুনাফা,বুর্জোয়া রাষ্ট্র এবং তার পরিচালক রাজনৈতিক আদর্শের দলগুলি ঘরে তোলে। এক.বেসরকারীকরণের লাগামহীন বিস্তার শিক্ষান্তে বাজারকে শ্রমিক সাপ্লাই দেবে;যে শ্রমিক তার উপার্জন ও ভোগ্যের জীবনচালনায় এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে সে কোনো রাজনৈতিক প্রশ্ন অথবা দাবীই রাখতে পারবেনা তা সে যতই তার শ্রম লুঠ হোক না কেন! সে এইসব দাবী এই কারণেই লুঠেরা মালিকের সামনে রাখতে পারবেনা যেহেতু শিক্ষাজীবন থেকে সে কেবলমাত্র উৎপাদনের প্রকৌশলটুকুই রপ্ত করেছে,বাজারী শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে কখনই রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক সংকট সম্পর্কে কিছুই শেখায় নি

বৌদ্ধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থে ইউনিয়ন জরুরি

বৌদ্ধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থে ইউনিয়ন জরুরি 

শঙ্খজিৎ দে 
১০ই মার্চ ২০২৩


ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের আহ্বানে আজ ১০ই মার্চ ২০২৩ সংঘটিত হতে যাচ্ছে বিধানসভা অভিযান। প্রধান মুখ্য দাবীর মধ্যে অন্যতম দাবী হল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং সংসদ নির্বাচন শুরু করা। অতীতে রাজ্য সরকারের প্রস্তাবিত অরাজনৈতিক 'কাউন্সিল' গঠনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছাত্ররা যে উদ্যমে রাস্তায় নেমেছে বলাবাহুল্য আজ সে উদ্যমের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধিই পেয়েছে। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে এই অভিযান সংগঠিত হতে যাচ্ছে যে সময়ে একদিকে গোটা রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র দুর্নীতি আর নৈরাজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক ভাইরাসের আক্রমনে গভীর সংকটে অন্যদিকে রাজ্যের সরকারী অধীনস্থ বিভিন্ন স্তরেরশিক্ষক, কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘ্যভাতার প্রশ্নে চরমতম বঞ্চনার মুখে পড়তে হয়েছে। প্রকাশ্য সভা,সমিতি এমনকি পেনডাউন বা কর্মবিরতির আন্দোলনের পরও রাজ্য সরকারের নারাজ মনোভাব। গোটা রাজ্যের কোষাগার থেকে প্রাপ্ত অর্থে সংস্থান হওয়া পরিবারগুলি চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। তারই প্রতিবাদে আজ সেই শিক্ষক,কর্মচারীরা ধর্মঘট আহ্বান করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সম্ভবত এই প্রথম ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলনের একত্র জোয়ার তৈরী হওয়ার ইতিহাস তৈরী হতে চলেছে। 


জাতীয় এবং বিশ্বপরিস্থিতির নিরিখে পশ্চিমবাংলার দক্ষিণপন্থী এবং স্বৈরাচারী সরকারের দমন,পীড়ন এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ কে সম্পূর্ণ নষ্ট করার অভিপ্রায় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একদিকে গত দশবছরে শিক্ষাক্ষেত্র-কে আস্তাকুঁড়ে ফেলবার চক্রান্তের অংশ (যা আজ মানুষের সামনে প্রকাশিত) হিসেবে শিক্ষক নিয়োগ সহ বিভিন্ন নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতি,স্বজনপোষণ,লুঠতরাজ, কলেজক্যাম্পাসকে দুর্বৃত্তদের আখড়ায় পরিণত করা, তার সাথে সাথেই বছরের পর বছর সংসদ নির্বাচন না করে কলেজে,বিশ্ববিদ্যালয় মাধ্যম কে রুগ্ন,জীর্ণ করে দেওয়া আসলেই সরকারের নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রতি মোহ,অঙ্গীকার কে বাস্তবায়ন করার কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের এই সরকার শুধুমাত্র ছ্যাঁচড়া চুরির জন্য রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার চরম সর্বনাশ করেনি; পর্দার পিছনের অভিপ্রায় টা হল শিক্ষার লাগামহীন বেসরকারীকরণ! কোভিড পরবর্তী সময়ে অনলাইন অ্যাপনির্ভর শিক্ষার ব্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কাজ করা রাজ্যের মন্ত্রী,আমলা মহোদয়েদের মুখোশ অনেকখানি খুলে গেছে। চক্রান্ত নতুন নয়! লুঠের টাকায় ঢালাও বেসরকারি স্কুল,কলেজ,প্রফেশনাল ইন্সিটিউশন,বিএড কলেজ তৈরীর এবং চালনার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকায় তাদের অংশ নিতে দেখা গেল। শুধু তাইই নয় এইসব লুঠের টাকা ইনভেস্ট করা ব্যবসাখানা
-ইন্সিটিউশন থেকেও তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রয়োজনাতিরিক্ত মোটা টাকা ফি'জ নিয়ে গেছে। বেহাল,দুষ্টমননে পূর্ণ শিক্ষাদপ্তর জেগে ঘুমোনোর মত এসব এসব শিক্ষাবিক্রীর দোকানগুলোকে বছরের পর বছর অনুমোদন দিয়ে গেল! 


শিক্ষায় বেসরকারীকরণের কাছ থেকে দুরকম বৈশিষ্ট্যের মুনাফা,বুর্জোয়া রাষ্ট্র এবং তার পরিচালক রাজনৈতিক আদর্শের দলগুলি ঘরে তোলে। এক.বেসরকারীকরণের লাগামহীন বিস্তার শিক্ষান্তে বাজারকে শ্রমিক সাপ্লাই দেবে;যে শ্রমিক তার উপার্জন ও ভোগ্যের জীবনচালনায় এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে সে কোনো রাজনৈতিক প্রশ্ন অথবা দাবীই রাখতে পারবেনা তা সে যতই তার শ্রম লুঠ হোক না কেন! সে এইসব দাবী এই কারণেই লুঠেরা মালিকের সামনে রাখতে পারবেনা যেহেতু শিক্ষাজীবন থেকে সে কেবলমাত্র উৎপাদনের প্রকৌশলটুকুই রপ্ত করেছে,বাজারী শিক্ষা ব্যবস্থা তাকে কখনই রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক সংকট সম্পর্কে কিছুই শেখায় নি! কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজারের হাতে তৈরী এইসব ছাত্র বা শ্রমিকের অবস্থা এমনও হয়েছে যে সে প্রচলিত বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কেও সন্দিগ্ধ হয়েছে,রাজনৈতিক দলগুলোকে, তাদের ভাবনাকে শত যোজন দূরে সরিয়ে নিজের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষেও কিছু বলতে পারেনা। এইসব বেসরকারী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের বিপুল ইনভেস্ট ছাড়া ভর্তি হওয়া যায় না। স্বভাবতই একজন সাধারণ ছাপোষা নাগরিক সমাজের ছেলে বা মেয়েটি চাইবেই এই বিপুল ইনভেস্টের পরিণাম হিসেবে দ্রুততার সঙ্গে জীবিকা অর্জন করার তাগিদ। যা দাঁড়ালো তা হল, বৌদ্ধিক জগৎ কে বিকশিত করার সময় তার হাতে নেই! বৌদ্ধিক জগতের চর্চা যতই কম,ফ্যাসিস্ত সরকারের ততই সুবিধা,লুঠের নীতি প্রণয়ন করার লাগামহীন সুবিধা। এই সংকট শুধু আমাদের রাজ্যের নয়। ভারতবর্ষ জুড়ে এমনকি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়- গুলিতেও ইনোভেটিভ (সৃষ্টিশীল) জার্নালগুলো প্রায় লুপ্তির দিকে। প্রজেক্ট তহবিল গড়ে তোলার জন্য নাম কা ওয়াস্তে কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশনা ছাড়া বাকি গবেষণার ক্ষেত্রটা কোথায়? 

 

দ্বিতীয়ত,বেসরকারীকরণ মানেই ইউনিয়নহীন একটা ব্যবস্থা। ছাত্রছাত্রীদের কারখানার মতো শৃঙখলা দৈনন্দিন বজায় রাখতে হচ্ছে সেখানে। ইউনিয়ন না থাকলে আগেই বলেছি গণতন্ত্রের প্রাথমিক পাঠ থেকেই একজন ভবিষ্য নাগরিক বিচ্যুত হয়! শুধু তাইই নয়, ইউনিয়ন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখলে নয়া উদারবাদী ধান্দার ধনতন্ত্রের অসুবিধাটা অন্য জায়গায়! সে সবসময় চাইছে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে,তার নিজের স্বার্থেই চাইছে! মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার অভিপ্রায়ে পলি জমার সম্ভাবনা ইউনিয়ন তৈরী হলেই,কেননা ইউনিয়ন একজন ছাত্র-ছাত্রীকে সমষ্টিবদ্ধ বিশেষত মৌলিক দাবীগুলির স্বপক্ষে সমষ্টিবদ্ধ হতে ইতিবাচক ভূমিকাই গ্রহণ করে এসেছে। 


মমতা ব্যানার্জির সরকার তাই প্রথম থেকেই ইউনিয়ন নির্বাচনের বিরোধী। কেননা সে নৈতিক ভাবেই এই নয়া উদারবাদের কর্মসূচিকে বাস্তবায়ন করতে চায়। সরকারে আসার প্রাক্ মুহূর্ত থেকেই ব্যাপক সন্ত্রাস তৈরী করে,
ক্যাম্পাস রক্তাক্ত করে ইউনিয়ন নির্বাচন সম্পর্কে নাগরিক সমাজে নেতিবাচক ধারণা তৈরী করায় উদ্যোগী হয়েছে তার দল। অনেকাংশে সফলও হয়েছে। এই সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে স্বপন কোলে-র মতো ছাত্রদের তৃণমূলের দুষ্কৃতি বাহিনীর হাতে মরতে হয়েছে। একই দাবীতে আন্দোলনরত সুদীপ্ত গুপ্ত-কে পিটিয়ে মেরেছে এই সরকারের পুলিশ। মমতা একাই নন,তার অঘোষিত বন্ধু বিজেপিও একই অপকর্মের শরিক। বিজেপি শাসিত রাজ্যেও ছাত্র-সংসদ নির্বাচন ঘিরে একদিকে তীব্র অচলাবস্থা;অন্যদিকে বিজেপির সভাপতি সহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরাট অংশই উত্তরাখণ্ড, হিমাচলের মতো রাজ্যে শিক্ষাবাজারে ব্যাপক বিনিয়োগ করে লাগামহীন বেসরকারিকরণের খেলায় মত্ত! 


আজকের পরিবেশ জটিল। দাবী আদায়ের সংগ্রামের পরিসর সঙ্কীর্ণ করে দেওয়া হচ্ছে কুৎসিততম প্রয়াসে। অবধারিত লুঠ আর লুঠ। একইসাথে জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি আর অবৈজ্ঞানিক পথে দেশের মানুষকে ঠেলে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। এর বিরুদ্ধে বৌদ্ধিক প্রতিরোধ গড়া জরুরি, ব্যাপকভাবে জরুরি। এর আবশ্যকতা অনুধাবন করে শিয়ালদা থেকে প্রত্যয়দীপ্ত মিছিল এগিয়ে যাক বিধানসভার অভিমুখে...

মতামত লেখকের ব‍্যক্তিগত

Your Opinion

We hate spam as much as you do