Tranding

02:15 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / অপারেশন সংবিধান

অপারেশন সংবিধান

আমার নিজের মতে ১৯৭৫ এর দু বছরের জরুরী অবস্থার সময় বাদ দিলে গণতন্ত্রের এমন বিপদ এর আগে কখনো আসেনি। যে সংবিধান আইন ও শাসন বিভাগীয় স্বৈরাচারের হাত থেকে এতদিন রক্ষা করে এসেছে এবার সরাসরি আক্রান্ত সেই সংবিধান। কথাটা বোধ হয় একটু নরম হয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার সংবিধান ধ্বংস করার কাজে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কেন? তাই নিয়েই এই লেখা।

অপারেশন সংবিধান

অপারেশন সংবিধান

২৬শে জানুয়ারি ২০২৩

অধ্যাপক চঞ্চল চক্রবর্ত্তী 
--(অবসরপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক
বারাকপুর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)
 

মাত্র কিছুদিন হল আমরা স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব উদযাপন করলাম। ২৬শে জানুয়ারি সংবিধানের ৭৪ তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে ভাষণ দেবেন দেশের রাষ্ট্রপতি। এই উপলক্ষে আমরা একটু দেখে নিতে চাই বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা ঠিক কিরকম অবস্থায় রয়েছে।
 

আমার নিজের মতে ১৯৭৫ এর দু বছরের জরুরী অবস্থার সময় বাদ দিলে গণতন্ত্রের এমন বিপদ এর আগে কখনো আসেনি। যে সংবিধান  আইন ও শাসন বিভাগীয় স্বৈরাচারের হাত থেকে এতদিন রক্ষা করে এসেছে এবার সরাসরি আক্রান্ত সেই সংবিধান। কথাটা বোধ হয় একটু নরম হয়ে গেল। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার সংবিধান ধ্বংস করার কাজে বদ্ধপরিকর। কিন্তু কেন? তাই নিয়েই এই লেখা।

 
এতদিন বিজেপি বলে আসছিল এক দেশ (হিন্দুস্তান), এক জাতি (হিন্দু ), এক ভাষা ( হিন্দি), এক সংস্কৃতি, এক পতাকা ইত্যাদি। বিজেপির এই দর্শন ভারতীয় ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। নরেন্দ্র মোদী বুঝতে পেরেছেন সংবিধানের খোলনলচে না বদলাতে পারলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়। তাই এবার 'অপারেশন সংবিধান'। বিষয়টি এখনো সকলে গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছেন বলে দেখছিনা। এখনো বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব না দিলে বা বলা ভালো সর্বাত্মক বিরোধিতায় না নামলে অনেক খেসারত দিতে হবে দেশের মানুষকে।
 

বিজেপির প্রাথমিক লক্ষ্য সুপ্রিম কোর্ট। মোদি সরকার পার্লামেন্ট, পুলিশ, আমলা, সব কিছু হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। এখন বাকি সুপ্রিম কোর্ট।  মোদির অশ্বমেধের ঘোড়ার অমিত বিক্রমে সারা দেশ জয় করার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে সুপ্রিম কোর্ট। তাই চিন্তা ভাবনা করে পরিকল্পনা মাফিক নামানো হল আর কেউ নয় দেশের উপরাষ্ট্রপতি এবং আইন মন্ত্রীকে।
 

উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখর সোজাসুজি বলেই ফেললেন পার্লামেন্টারি সার্বভৌমত্বের কথা। ইতিহাস খুঁড়ে তুলে আনলেন ১৯৭৩ সালের   কেশবানন্দ ভারতী মামলার কথা। স্পষ্ট করে বললেন সুপ্রিম কোর্টের রায় ভুল ছিল। ওই রায়ে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে। আর এদিকে আইন মন্ত্রী কিরণ রিজিজু লাগাতার বলে যাচ্ছেন বিচারপতিদের নিয়োগের জন্য নাম কলেজিয়াম সুপারিশ করবে না। National Judicial Appointment Commission ঠিক করবে। এই প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্ট এখনো মান্যতা দেয়নি। কিন্তু তাতে তিনি থামেননি। ২৪ শে ও ২৫শে জানুয়ারি আইন মন্ত্রীর যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে রয়েছে রীতিমত ধমকের সুর। সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে সংঘাত বিরামহীন ভাবে চলছে। আইনজীবীদের মধ্যে একটি বড় অংশ মনে করেন, সরকার তার আস্থাভাজন লোকদের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করতে চায়। আর তা যদি করা যায় তাহলে বিজেপির মনমতো সংবিধান সংশোধনে আর কোন বাধা থাকবে না।
 

এখন প্রশ্ন হল এই সংঘাতের আসল কারণ কি? উপ রাষ্ট্রপতি হঠাৎ ১৯৭৩ সালের কেশবানন্দ ভারতী মামলার কথা টেনে আনলেন কেন? এর সঙ্গে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। এক, ভারতের পার্লামেন্ট কি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তারা যা খুশি তাই করতে পারে? দুই, সুপ্রিম কোর্ট কি পার্লামেন্টে পাশ হওয়া যে কোন আইন বাতিল করে দিতে পারে? তিন, সংবিধান কি অচল অনড়, তার পরিবর্তন সম্ভব নয়? 
 


এই সব প্রশ্নগুলির উত্তর রয়েছে আমাদের সংবিধানের মধ্যে। ভারতের সংবিধান রচনা করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছিল। আমাদের সংবিধানের উপর বিভিন্ন দেশের সংবিধানের প্রভাব রয়েছে বা বলা যেতে পারে আমাদের সংবিধান রচয়িতারা বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে সাহায্য নিয়েছিলেন, কিন্তু হুবহু কপি করেননি। এখানেই রয়েছে সংবিধান রচয়িতাদের প্রজ্ঞার প্রকাশ। 
 


ভারতের পার্লামেন্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মত সার্বভৌম নয়। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট সার্বভৌম। বৃটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত কোন আইন আদালত পর্যালোচনা বা বাতিল করতে পারে না। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ঠিক এর উল্টো। সেখানে সুপ্রিম কোর্ট হোল সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। আমেরিকান কংগ্রেসের দ্বারা প্রণীত যে কোনো আইন সুপ্রিম কোর্ট পর্যালোচনা ও বাতিল করে দিতে পারে। ভারতের সংবিধান হোল এই দুইয়ের মিশ্রণ। এখানে পার্লামেন্ট ও সুপ্রিম কোর্ট কোনটাই সার্বভৌম নয়। এখানেই ভারতের সংবিধানের সৌন্দর্য। এখানেই সংবিধান প্রণেতারা তাঁদের দূরদর্শিতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁরা জানতেন পার্লামেন্টকে যদি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করা হয় তাহলে এমন সময় আসতে পারে যখন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান বলবৎ করা হতে পারে। আমাদের ৭৩ বছরের সাংবিধানিক জীবনে একাধিকবার এই আশঙ্কার প্ৰমাণ পাওয়া গেছে। ১৯৭৫ সালের জরুরী অবস্থার কথাই ধরা যাক। সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে, ৩৫২ ধারায় দেশে জরুরী অবস্থা থাকাকালীন সংসদের মেয়াদ সর্বোচ্চ এক বছর বাড়ানো যায়। একবার ভাবুনতো সংবিধানের এই স্পষ্ট নির্দেশ যদি না থাকতো তাহলে জরুরী অবস্থা আরও কত বছর চলতে পারতো! 
       


আবার সুপ্রিম কোর্টকেও সংবিধান সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেনি। তা যদি করা হত তাহলে নির্বাচিত সংসদ হয়তো কাজ করতে গিয়ে প্রতি পদে বাধাপ্রাপ্ত হত। তবে সুপ্রিম কোর্টকে ও হাইকোর্টকে সংবিধান একটি বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। সেটা হল বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতা। এর অর্থ, হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট আইনসভা প্রণীত আইন সংবিধান অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে কিনা তা পর্যালোচনা করে দেখতে পারে এবং আদালত যদি মনে করে প্রণীত আইন সংবিধানসম্মত নয় তাহলে তা বাতিল করতে পারে। তাহলে কি হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট যে কোন আইনকে অসাংবিধানিক বলে বাতিল করতে পারে! না, পারে না। আদালতকে ব্যাখ্যা দিতে হবে কেন অসাংবিধানিক। আসলে ভারতে পার্লামেন্টও না, সুপ্রিম কোর্টও না, সংবিধান হোল সার্বভৌম। আদালত এবং সংসদ উভয়কেই সংবিধানের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। ক্ষমতার এই ভারসাম্য-ব্যবস্থার জন্য ভারতে এত বছর গণতন্ত্র টিকে রয়েছে। আর এখানেই বিজেপি-আরএসএস আটকে যাচ্ছে। এখানে একটা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। সংবিধান এতবার সংশোধিত হয়েছে, তাহলে বিজেপির সংবিধান সংশোধনের চেষ্টায় আপত্তির তো কোন কারণ থাকতে পারে না।
     


আপত্তির কারণ রয়েছে এই জন্য যে বিজেপি সংবিধান সংশোধন করতে চায় এমনভাবে যাতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বিনষ্ট করা যায়। আর এখানেই ১৯৭৩ সালের কেশবানন্দ ভারতী মামলার গুরুত্ব। সেই জন্যই জেনেবুঝে উপরাষ্ট্রপতি এই মামলার প্রসঙ্গ তুলেছেন। এই ঘটনা স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে কখনো ঘটেনি। একজন সাংবিধানিক দ্বিতীয় পদাধিকারী ব্যক্তি সর্বোচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কেশবানন্দ ভারতী মামলায় সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে। এই প্রথম আদালতের রায়ে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ধারণা সামনে এল। রায় ঘোষণা করে আদালত জানালো সংবিধানের ৩৬৮ নং ধারায় বর্ণিত  পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা আছে এবং তারা তা করতেও পারে। পার্লামেন্ট সংবিধানের যে কোনো অংশ সংশোধন করতে পারে, কিন্তু সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য সংশোধন করতে পারে না। এখন প্রশ্ন উঠলো সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি? তার উল্লেখ রয়েছে সংবিধানের প্রস্তাবনায়। সেখানে উল্লেখ করা আছে, " আমরা ভারতের জনগণ ভারতকে  একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে চাই ......" কেশবানন্দ ভারতী মামলায় রায় প্রদান করে সুপ্রিম কোর্ট উল্লেখ করে পার্লামেন্ট প্রস্তাবনায় উল্লিখিত সামাজিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য সংবিধানের যেকোন অংশ সংশোধন করতে পারে, তবে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংশোধন করতে পারবে না। এই রায়ে প্রস্তাবনায় উল্লিখিত নীতিগুলো যে মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এইখানে আটকে গেছে বিজেপি। বিজেপির তো আসল উদ্দেশ্য হোল ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটা প্রস্তাবনা থেকে বাদ দেওয়া। তা ছাড়াও আরো যা বলা আছে যথা স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্বের কথা তা পরিবর্তন করতে পারলে ঘৃণার রাজনীতি বল্গাহীন ভাবে চালাতে বিজেপির অবশ্যই সুবিধা হবে। বর্তমান সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে এই রায় পরিবর্তন করা সম্ভব নয় সেটা মোদি, অমিত শাহ রা বুঝেছেন। তাই সুপ্রিম কোর্টকে কব্জায় আনতে হবে, আর তা করতে হলে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা চাই সরকারের। তাই আইনমন্ত্রী লাগাতার কলেজিয়াম পদ্ধতির বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাচ্ছেন। এমনও বলছেন যে জনতা সব দেখছে। এ প্রায় হুমকি দেওয়া। আস্থাভাজন বিচারপতি চাই। তাদের যা বলা হবে তারা তাই করবে। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বিচার ব্যবস্থার স্বাধীন নিরপেক্ষ ভূমিকা বলে আর কিছু থাকবে না। এক দানবীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে ভারতবর্ষে। তাকে ফ্যাসিবাদ বলবেন, না স্বৈরাচারী বলবেন সে আপনারা ঠিক করবেন। আমি খুব স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার। বিচার ব্যবস্থার উপর এই আক্রমণ কেন্দ্রে যেমন করছে বিজেপি, রাজ্যে তার থেকেও নগ্ন আক্রমণে নেমেছে তৃণমূল কংগ্রেস। যেভাবে হাইকোর্টে মাননীয় বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বিরুদ্ধে তান্ডব করেছে সরকারপন্থী আইনজীবীরা তা এক কথায় নজিরবিহীন। কাজেই বুঝতেই পারছেন বিজেপি আর তৃণমূলে ফারাক কিছু নেই। বিচার ব্যবস্থাকে কব্জায় আনতে হবে, এটাই এখন ফ্যাসিস্টদের এজেন্ডা।
          

আমাদের পাল্টা এজেন্ডা স্থির করতে হবে। এ চক্রান্ত আমরা কিছুতেই সফল হতে দেবো না। No Passaron, Fascism Shall Not Pass.
এটাই হোক এবারের সংবিধান দিবসের শপথ।

(প্রবন্ধের মতামত লেখকের ব‍্যাক্তিগত) 

     

 

Your Opinion

We hate spam as much as you do