ক্ষমতা হস্তান্তরের ভিতর দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম।সেই অর্জনে গৌরবের পাশাপাশি গ্লানি ও ছিল প্রবল।দেশভাগের গ্লানি ই তারমধ্যে সবথেকে বেশি হৃদয়বিদারক।
স্বাধীনোত্তর ভারত: প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তির খতিয়ান (১)
গৌতম রায়
স্বাধীনতা ঘিরে ভারতবাসীর স্বপ্ন যে অখন্ড থাকবে না , সেটা ১৪ ই আগস্ট , ১৯৪৭ সালের আগেই সকলে বুঝে গিয়েছিল। দেশভাগ হিন্দু- মুসলমান অভিজাতকে আনন্দ দিলেও , গরিবগুর্বো , খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, অন্ত্যজ হিন্দু, আতরাফ মুসলমানের কাছে এই বিভাজন কতোখানি যন্ত্রণাবাহী হয়েছিল-- সেই ইতিহাসের স্পর্শ ইতিহাস না জানা একজন মানুষের কাছেও আজ কয়লায় কালো সত্য।
ক্ষমতা হস্তান্তরের ভিতর দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম।সেই অর্জনে গৌরবের পাশাপাশি গ্লানি ও ছিল প্রবল।দেশভাগের গ্লানি ই তারমধ্যে সবথেকে বেশি হৃদয়বিদারক। ঔপনিবেশিক শাসনের সবথেকে বড়ো লক্ষ্য ছিল, ভারতবাসীকে সর্বাত্মক ভাবে ব্রিটিশের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠতে শেখা।এতোটুকু আত্মশক্তির বিকাশ যাতে ভারতের একটি মানুষের ভিতরেও জাগতে না পারে, সেই দিকে নজর দিয়েই ব্রিটিশ তার সবরকমের কর্মকান্ডকে পরিচালিত করেছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম কাজটাই ছিল, এই ঔপনিবেশিক ভূতকে সরিয়ে একটা আধুনিক মননশীলতার নির্মাণ। ঔপনিবেশিক ভারত একটা শক্ত পাথরের মতো স্বাধীন ভারতের চিন্তার সামগ্রিকতার উপরে চেপে বসেছিল। ব্রিটিশ রেল লাইন সহ যে সব সামাজিক উন্নতির জন্যে ভেবেছিলেন, তার প্রত্যেকটির পিছনে ছিল তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ।সেই স্বার্থকে অতিক্রম করে দেশের মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণের প্রশ্নটিকেই উন্নতির সবরকম প্রচেষ্টার সঙ্গে একাত্ম করে তোলাই হল স্বাধীন ভারতের কর্তাব্যক্তিদের কাছে সবথেকে প্রয়োজনীয় কাজ।
পলাশী পূর্ব ভারতের সার্বিক যে ছবি ছিল, তা অটুট থাকবে ব্রিটিশের চলে যাওয়ার নর ও- এটা একটা অলীক ভাবনা।সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের স্বার্থে যে অদলবদল আনবে তা ঘিরে কোনো মতদ্বৈততা থাকতে পারে না।তার পাশাপাশি বলতেই হয়, সময় কোনো স্থির জঙগম বস্তু নয়।মুঘল সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণুতার সময়কালের যে সামাজিক গঠন, অর্থনেতিক বিন্যাস- সেটি যে দুশো বছর পরেও এক ই অবস্থাতেই থেকে যাবে- এমনটা মনে করবার ও কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে না। তবে একটা কথা বলতেই হয় শক, হুণ, পাঠান, মোগলেরা সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতায় নিয়ে এই দেশে এসেছিল - একথা ঠিক।কিন্তু তাঁরা এই দেশ শাসনের বিনিময়ে এইখানকার সম্পদ লুন্ঠন করে বিদেশে পাচার করে নি ব্রিটিশের মতো।এই দেশে শাসনক্ষমতা বিস্তার করে এখানকার সম্পদ লুঠে নিজেদের বৈভব বৃদ্ধি করেছিল।কিন্তু সেই বৈভব এইদেশের মাটিতেই থেকে গিয়েছিল-- এটাই হল অন্যসব শাসক , যারা সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা নিয়ে এই দেশে এসেছে, এই দেশ শাসন করেছে, শাসনের আড়ালে শোষণ ও করেছে, তাঁদের সঙ্গে ব্রিটিশের প্রধানতম মৌলিক পার্থক্য।
স্বাধীন ভারতের সামনে ঔপনিবেশিক যুগের কৃষি পরিকাঠামো একটা বড়ো বিষয় হিশেবে উঠে এলো প্রথমেই।দেশ পরিচালনার ভার যাঁদের হাতে ন্যস্ত হল, তাঁরা খুব গভীর ভাবেই বুঝলেন যে, ব্রিটিশ শাসনের সময়কার যে কৃষি পরিকাঠামো তা স্বাধীন ভারতে প্রয়োগ করতে গেলে ব্রিটিশের ই পদ্ধতির অনুসরণ করতে হবে।অর্থাৎ, শাসকের স্বার্থবাহী হতে হবে কৃষিনীতি।সেই স্বার্থরক্ষার তাগিদে শাসকের পরেই উপকৃত হবে জমিদার, জোতদার, বৃহৎ জমির মালিকেরা।কৃষক আর ও সর্বস্বান্ত হবে ব্রিটিশের কৃষি পরিকাঠামোর অনুসরণ করলে - এটা বুঝেও স্বাধীন ভারতের পরিচালকেরা প্রথম থেকেই তাঁরা নিজেরা যে জমিদার, জোতদার শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেই শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকেই কৃষি পরিকাঠামো নোতুন করে নির্মাণের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
উৎপাদন ব্যবস্থায় ঔপনিবেশিক পরিকাঠামোর সম্পূর্ণ বদল করার মানসিকতা পরিপূর্ণ ভাবে না থাকলেও অনেকটাই অদলবদলের চিন্তা স্বাধীন ভারতের পরিচালকেরা প্রথম থেকেই করতে শুরু করেন।এক্ষেত্রে শিল্পায়নের উপর খুব জোর দেওয়া হয়।কৃষি পরিকাঠামোর বদলের ক্ষেত্রে দরকার ছিল ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন।সেটা রাষ্ট্র পরিচালকেরা কখনোই তাদের শ্রেণী স্বার্থের নিরিখে করে উঠতে পারেন নি।এমন কি জম্মু- কাশ্মীরে নানা সমস্যাকে অতিক্রম করে শেখ আবদুল্লা যখন ভূমি সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন, সেটা দিল্লিতে যারা সরকার পরিচালনা করছিলেন, তারা কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করতে পারেন নি।কারণ, একটি রাজ্য যদি ভূমি সংস্কারে ব্রতী হয়, সেই রাজ্যের হাওয়া অন্য রাজ্য গুলির উপর পড়তে বাধ্য।ভূমি সংস্কারের দাবি দেশের সর্বত্র তখন প্রবল হবে।আর ভূমি সংস্কার ঘটলে শাসকের শ্রেণী স্বার্থ সবথেকে বেশি বিঘ্নিত হবে।এই জায়গা থেকেই শেখ আবদুল্লার প্রতি বৈরি মনোভাব ও দিল্লির শাসকদের অনেকখানিই তীব্র হয়ে উঠেছিল।তবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্পের যে ভাবনা প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু ভেবেছিলেন, সেই ভাবনার বাস্তবায়নে যত্নবান হয়েছিলেন, সেটি ঔপনিবেশেক পরিকাঠামো থেকে স্বাধীন দেশ কে উত্তোরিত করবার প্রশ্নে একটা বিরাট পদক্ষেপ ছিল।সেই সঙ্গে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথাও সশ্রদ্ধ চিত্তে উল্লেখ করতে হয়।
কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রশাসন, শিক্ষা-- প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক যুগের একটা পদক্ষেপ ছিল।তবে সেটা ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থবাহী।দেশের মানুষদের স্বার্থ সেখানে কখনোই ব্রিটিশ শাসকদের স্বার্থের থেকে বেশি গুরুত্ব পায় নি। তবে এইসব প্রয়াস দেশবাসীর পক্ষে একেবারে সদর্থক হয় নি- এমন ধারণা করে নেওয়াটাও কিন্তু ঠিক না। তবে ঔপনিবেশিক প্রবণতার সঙ্গে অনুন্নয়নের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, সেই সম্পর্ক সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠার প্রশ্নে স্বাধীন ভারত প্রথম থেকেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে খুব একটা যত্নশীল ছিল- এমনটাও কিন্তু বলা যায় না। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির প্রভাব স্বাধীন ভারতের উপর প্রথম থেকেই এতোখানি তীব্র ছিল যার জেরে ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরেও অনেকদিন ই সামাজিক ক্ষেত্রের অনেক আঙ্গিকেই ব্রিটিশ নির্ভরতার বিষয়টি বেশ বড়ো হয়েই উঠেছিল।ঔপনিবেশিক আর্থিক পরিকাঠামো টা স্বাধীন ভারতের আর্থিক পরিকাঠামো গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে অনেকসময়েই একটা বড় রকমের অন্তরায় হয়ে উঠেছিল। আর এই ব্রিটিশ অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর অভ্যন্তর থেকে স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো সৃষ্টির প্রবণতাই স্বাধীন ভারতে ব্রিটিশ যুগের মতোই দারিদ্রকে জীবনের সঙ্গে প্রায় আষ্টেপিষ্টে গেঁথে ফেলল। অধীনতা থেকে মুক্ত হয়েও যে অধীনতার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল- সেই পথ ধরেই স্বাধীন ভারতের জয়যাত্রার সূচনা( ক্রমশঃ)
We hate spam as much as you do