দোল ঘিরে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে শ্রীচৈতন্য কে ঘিরে একটা সংস্কৃতি বাংলায় চালু হয়েছিল।এই সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক ভাবধারা ছিল।কিন্তু আধাত্মিকতাকে ও ছাপিয়ে ছিল সামাজিক অচলায়নের বেড়া ভাঙবার একটি সোচ্চার অভিব্যক্তি।অতীতে বাঙালি জীবনে , বিশেষ করে দলিত, নিম্নবর্গীয় জীবনে অঃই দোল উৎসবকে ঘিরে একটা যৌন আবেদন মিশ্রিত অভিধারা ছিল।সেই অভিধারাকে কেবলমাত্র যৌনতাতেই সীমাবদ্ধ না রেখে একটা সর্বাঙ্গীন প্রেমের মহোৎসবে রূপান্তরিত করেছিলেন শ্রীচৈতন্য । জাতপাতের বেড়া ভেঙে মানুষের ভিতরে সর্বাঙ্গীন ভাবে প্রেমের জয়গান, দেহজ প্রেমকে অতিক্রম করে , মানবপ্রেমের জয়পতাকা ওড়ানোর যে চেতনায় এই দোলযাত্রাকে বৈষ্ণব আন্দোলন উপস্থাপিত করেছিল , তা মধ্যকালীন বাংলার ভক্তি আন্দোলনের ধারাকে পরিপুষ্ট করে।
বিগত বসন্তে অশোক রক্ত রাগে
জানুয়ারির প্রথম একটা দুটো দিন ভালো ব্যাটিং করেই শীতবাবাজীবন কেমন যেন যাই যাই করছেন।আমরা যারা একটু খেতে পরতে পাই, তারা তো নিজেদের এখন আর মধ্যবিত্ত না ভেবে, বেশ বড়লোক ভাবতেই পছন্দ করি। তাই আমরা যখন কড়াশীত বড়ো ব্যাটিং না করার জন্যে আফশোষ করছি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে বেশ একটু গলাবাজি করার চেষ্টা করছি।বলছি; ভেবেছিলুম, লক ডাউনের জেরে যেহেতু পলিউশন কম ছিল, তাই শীত টা কষিয়েই পড়বে।তখন যে নীলিমা, আমাদের বাড়ির ঝি, যাকে আজকালকার কেতায় পরিচারিকা বলে বেশ আত্মশ্লাঘাই পাই। সে বলছে; টিনের চাল চুইয়ে, বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটার মতো শিশির পরে।কাঁথা ভিজে যায়।তখন শান্তিনিকেতন থেকে কেনা নকশী কাঁথা কতোখানি ওম দেয় আমাকে?
শীতের কড়কড়ানি তে এই বছর মফস্বলের বাজারগুলোতে কমলালেবুর ঢল।গত পঁচিশ বছরে , কি সদর, কি মফস্বল - এমন তরো কমলালেবু দেখে নি।কমলালেবু যে গরিব মানুষ, ফুটপাতবাসী, মফস্বলে রেল ইস্টিশানে পড়ে থাকা মানুষজনের ও হাতের নাগালে আসতে পারে, এই ধারণাটাই যখন আমরা ভুলতে বসেছিলাম, তখন এই শীতে আর কিছু সস্তা হোক বা না হোক, কমলালেবু সর্বত্র ই বেজায় সস্তা। বাজারে এতো অঢেল কমলালেবু, আর দাম মধ্যবিত্ত তো কোন ছাড়, নিম্নবিত্তের মানুষদের ও আয়ত্তের ভিতরে, এই অবস্থায় কেমন আছে এই শীতে কমলালেবু চাষের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষজনেরা, একবার ভেবেছি কি?
দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের ঘিরে সামাজিক , রাজনৈতিক শোরগোল।রাজনীতির প্যাঁচপয়জার না বুঝেও দিল্লির প্রবল শীত কে আরো বেকায়দায় ফেলা বৃষ্টির ভিতরে অবস্থানরত কৃষকদের কথা ভেবে আমরা শিউরে উঠছি।কিন্তু কয়জন ভেবেছি, কমলালেবু চাষে কুন্টুর পদ্ধতিতে মাদা তৈরি করে চাষ করে কৃষি শ্রমিকেরা ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার নায়িকা সুপর্ণা নয়, নিজেরাই শীত কে জানান দেওয়ার সুযোগ করে দেন, কেমন আছেন সেইসব মানুষেরা?
ধান চাষে চুক্তিভিত্তিক ব্যাপার স্যাপার এসে পড়ছে বলে আমরা সবাই ই খুব গম্ভীর মুখে আলোচনা করছি।দিল্লির মলে দুশো টাকা দামের বাঁধা কপি, ফুল কপির ছবি পোস্টিয়ে আমাদের উদ্বেগকে উগরে দিচ্ছি।কিন্তু গোবর, ইউরিয়া , টি এস পি, এম ও পি, চুন -- এইসব।সার জোগার করে শীতের মরশুমি কমলালেবু জোগানো মানুষদের খবর কি সত্য ই আমরা নিই?
নৈহাটির সরস্বতী বুক স্টলে বন্ধু অসীমের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো স্বপন নাথ।পাশের মামণি স্টোর্স থেকে গোল্লা হেঁকে বললে; আসল জয়নগরের মোয়া খাওয়াব স্বপনদা।রসগোল্লার মতো চেহারা বলেই দোকানের মালিকের নাম গোল্লা কি না কে জানে, তবে আসল মোয়ার কথা শুনে বইয়ের দোকানের মালিক অসীম সরকার জোর গলায় হেঁকে উঠলেন; মেড ইন বিজয়নগরের আসল জয়নগরের মোয়া!
দেশভাগের প্রথম ছিন্নমূল মানুষের প্রথম কলোনী নৈহাটির বিজয়নগরের কোনো খ্যাতি ই মোয়ার জন্যে না থাকলেও বিদায়ী শীতে সেখানে এ পাড়া, ও পাড়া খুঁজলে ' আসল জয়নগরের মোয়া' র কারখানা প্রতি দশটা ঘরে একটা মেলা অসম্ভব নয়।তবে সেই সাত , আটের দশকে এই বিজয়নগর থেকে বাঁকে করে ঘি , প্যাঁড়া, শীতের কালে মোয়া নিয়ে আসা নিতাই গোঁসাইরা আর পাড়ায় পাড়ায় ঘোরে না।নিতাইরাই ছিল সেকালের মফস্বলের নিশ্চিন্দিপুরের 'চিনিবাস' । আজকের ছোট ছেলেপিলেরা যদি শুনতো নিতাইয়ের হাঁক; 'এই যে আমি এসে গেছি, জামাইষষ্ঠীর দই ঘি' , তাহলে বরিশালী ঢঙে ' হাউডিয়া ' হতে তাদের আর আপত্তি থাকত না!
শীতের পশরা হালকা করে দোকানগুলো চৈত্রসেলের জিনিষ রাখব রাখব করছে।নদীর উপর দিয়ে বয়ে আসা হাওয়াতে উদাসী সুর বাজছে ।ফুলহাতা সোয়েটারটা অন্য কয়েকবারের মতোই খুব বেশি দিনের জন্যে বাইরে রাখতে হয় নি।তবে বুড়ো বুড়ির জটলায়, অর্থাৎ, মফস্বলী মর্ণিং ওয়াকের আসরে ফুলশ্লিপ সোয়েটার এখনো স্বমহীমায় হাজির।মফস্বলে জোয়ানমদ্দদের প্রাতঃভ্রমণের খুব একটা রেওয়াজ নেই।কারণ, অফিসকাছারি সামলাতে হলে মনিংওয়াক, বিলাসিতাই হয়ে যায়।ট্রেন ধরে মফস্বল থেকে সদরে যাওয়ার তাগিদে বিদায়ী শীতে গিজারের সাইচে হাত পড়ে।
একটা সময়ছিল মফস্বলে যখন ঘরে ঘরে কেন, দশটা বাড়ির একটাতেও গিজার ছিল না।যাদের সকালে স্নানের দরকার হতো, সেইসব।অফিসবাবু ছেলেপুলেদের জন্যে রাতের আঁচ ফেলে মা বড় হাড়িতে জল বসিয়েরাখতেন উনুনে।বেশি রাতে নিভন্ত আঁচের ওমে সকালে সেই হাঁড়ির জল মায়ের উষ্ণতার পরশ মেখে সন্তানের গায়ে শীতের ছোবল লাগতেই দিতো না। এককালে চল ছিল রোদের ভিতর লোহার বালতি তে করে স্নানের জল রেখে দেওয়া।রোদের তাপে সেই জলে কনকনে ঠান্ডা ভাবটা কিছুটা কাটতো।এই রোদে চানের জল রাখার বিষয়টা সাহিত্যে প্রতিভাত না হলেও শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনকেন্দ্রিক আলোচনা গুলিতে তাঁর জন্যে রোদে জল রেখে দেওয়ার কথা দেখা যায়।আর কড়া শীত ই হোক কিংবা বিদায়ী শীত, রোদে বসে গায়ে তেল মাখার বিলাসিতা এখন ও কিন্তু মফস্বলে টিকে আছে।পৈতৃক বাড়ি ফ্ল্যাট হয়ে গেলেও পুরনো অভ্যাস সেই ফ্ল্যাট বাড়ির প্রবীণ বাসিন্দাদের ভিতর অনেকেই এখনো পারেন নি ছাড়তে।ফ্ল্যাটের এক চিলতে ব্যালকনি তে বসেই চলে এই তৈলমর্দন।তবে কলকাতার গঙ্গার ঘাটে, বিশেষ করে বাবু ঘাট , আহিলীটোলা, বাগবাজারের ঘাটে এখন ও যে দু একজন হিন্দিভাষী তেলমালিশের লোক দেখা যায়, মফস্বলে তেমনটা আর নেই।কলকাতাতেও হয়তো নানা ঝড়ঝাপটা সয়ে শেষমেষ এখনো টিকে যাওয়া এইসব তেলমালিশের লোকেদের এটাই বোধহয় শেষ প্রজন্ম।এঁদের ছেলেপুলেরা আর এই পেশায় আসে না। বিলুপ্ত ই হয়ে যাবে গঙ্গার ঘাটে , বিশেষ করে পড়ন্ত শীতের তেলমালিশ পেশা।এখন তো পার্লার,স্পা তে গিয়ে ম্যাসাজের যুগ!
সদর লাগোয়া মফস্বলে এখন শীতের সকালে খেঁজুরের রস প্রায় উধাও ই বলা চলে।সদর হাতছানি ফেলা মফস্বলের আজকের প্রজন্মের মানুষ ' শিউলি' , খেঁজুর রস জানে নরেন্দ্রনাথ মিত্র যদি পড়ে , তবেই।মফস্বলী বাজারে এখন ও যে দু চারজন মানুষ আসে গাঁয়ের পসরা নিয়ে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু বলে তাঁদের আনা পয়রা, পাটালি তেই রসনাতৃপ্তি ঘটাতে হয় এখানকার মানুষদের।
বিভূতিভূষণের গল্পে শিশুদের আটপৌড়ে পোষাক হিশেবে ' দোলুই' শব্দ বহুল প্রচলিত। এখন ও সেই প্রজন্মের দু একজন হাতে গোনা মানুষ মফস্বলে আছেন, যাঁরা এখনো ' ইজের',' পাতলুম' - এসব শব্দ বলেন।এখনো মফস্বলে পড়ন্ত শীতের সকালে বা সন্ধ্যেতে পাড়ার মোড়ে আড্ডায় বসা মানুষ চাদর জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে কার্পেন্টারের দোকান থেকে জোগার করা কাঠকুটো র টুকরো টাকরা জড়ো করে আগুন পোয়ায়।বিশ বছর আগেও এমন করে শীতের দিনে চাদর জড়ানোর নাম ছিল,' গুড়ের নাগরির মতো চাদর জড়ানো'।এসব লব্জ আজকের সদরে তো দূর অস্ত, মফস্বলের মানুষ ও ভুলেই গিয়েছেন।
'বসন্ত' এখন ভুলে যাওয়া লব্জে ক্রমে পরিণত হচ্ছে।তবে 'দোল' শব্দটা কেউ কেউ বললেও ' হোলি' বলতেই বেশিরভাগ মানুষ অভ্যস্থ হয়ে পড়ছেন।হোলি মানেই হিন্দিভাষী সংস্কৃতির আগ্রাসন- এই সরলীকরণে বিশ্বাসী না হয়েও বলতে হয়, দোল ঘিরে আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে শ্রীচৈতন্য কে ঘিরে একটা সংস্কৃতি বাংলায় চালু হয়েছিল।এই সংস্কৃতিতে আধ্যাত্মিক ভাবধারা ছিল।কিন্তু আধাত্মিকতাকে ও ছাপিয়ে ছিল সামাজিক অচলায়নের বেড়া ভাঙবার একটি সোচ্চার অভিব্যক্তি।অতীতে বাঙালি জীবনে , বিশেষ করে দলিত, নিম্নবর্গীয় জীবনে অঃই দোল উৎসবকে ঘিরে একটা যৌন আবেদন মিশ্রিত অভিধারা ছিল।সেই অভিধারাকে কেবলমাত্র যৌনতাতেই সীমাবদ্ধ না রেখে একটা সর্বাঙ্গীন প্রেমের মহোৎসবে রূপান্তরিত করেছিলেন শ্রীচৈতন্য । জাতপাতের বেড়া ভেঙে মানুষের ভিতরে সর্বাঙ্গীন ভাবে প্রেমের জয়গান, দেহজ প্রেমকে অতিক্রম করে , মানবপ্রেমের জয়পতাকা ওড়ানোর যে চেতনায় এই দোলযাত্রাকে বৈষ্ণব আন্দোলন উপস্থাপিত করেছিল , তা মধ্যকালীন বাংলার ভক্তি আন্দোলনের ধারাকে পরিপুষ্ট করে।চিরন্তন ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে সবল করবার লক্ষ্যে বাংলায় চৈতন্যদেব এবং তার সতীর্থরা যে অবদান রেখেছিলেন তার ধারাবাহিকতা বাংলা তথা ভারতের সার্বিক ভিত্তিকে পুষ্ট করেছে।সেই পুষ্টি সাধনের ধারা বহু প্রতিবন্ধকতা স্বত্ত্বেও আজ ও অক্ষুন্ন আছে।
শ্রীচৈতন্যকে তাঁর ভক্তেরা পরবর্তীতে শুধুমাত্র দাস্য মাধুর্যের যে প্রতিমূর্তি হিশেবে মেলে ধরেছিলেন, কোমলতা আর বিনম্র ভাবের প্রতিমূর্তি হিশেবে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন , সেটা তাঁর বীরত্ব আর পৌরুষের জাগ্রত রূপকে অনেকটাই আবৃত করে দিয়েছিল।তিনি যে বীরত্বব্যজ্ঞক প্রেমের নিগড়ে দোলযাত্রার মতো একদা প্রাচীন ভারতে অন্ত্যজ মানুষদের দেহজ দ্যোতনাকে একটা সাম্যের , সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করবার সূচনা করেছিলেন, সেটিকে ধর্ম, আধ্যাত্মিকতার বেড়াজাল অতিক্রম করে মানুষের সমনাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রশ্নে বাংলায় তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নোতুন যুগের সূচনাপর্ব বলে অভিহিত করা যায়।চৈতন্যদেব যে স্ত্রী জাতি, শূদ্র, চন্ডাল, ব্রাত্যের সার্বিক জাগরণ চেয়েছিলেন,সেই লক্ষ্যপথে তিনি দোলযাত্রার মতো একদা নিছক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিশেবে প্রতিপালিত বিষয়কে সার্বিক ভাবে জনতার উৎসবে পরিণত করেছিলেন।অনেক অনেক পরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ দোলকে বসন্তোৎসবে পরিণত করে যে সামাজিক সাম্যের নবরূপায়ণ ঘটিয়েছিলেন, মধ্যকালীন বাংলাতে সেই নবচেতনার উন্মেষ শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে এসেছিল।ধর্মাচারণকে যাঁরা মুখ্য বিষয় হিশেবে দেখেন, তাঁরা চৈতন্যের এই সামাজিক আবেদন এবং অবদানটিকে সেভাবে কখনো গুরুত্ব দেয় নি।সারস্বত সমাজে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, সুখময় মুখোপাধ্যায়রা ছাড়া এই বিষয়টিকে সেভাবে কেউ তুলেও ধরেন নি।
We hate spam as much as you do