Tranding

02:16 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস --দেশে ও রাজ্যে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন

৭৫তম স্বাধীনতা দিবস --দেশে ও রাজ্যে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন

বর্তমানে যে আইনে সব থেকে বেশী মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি হল ইউ এ পি এ (unlawful activities prevention act ) আমাদের দেশে নিবর্তন মূলক আটক আইনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । Defence of India Rule (DIR) , PDAct , ESMA , NASA , TADA – এইসব বিভিন্ন নামে নিবর্তন মূলক আটক আইন প্রয়োগ হয়েছে বারবার । সব ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য একটাই – বিরোধী প্রতিবাদী স্বর রুদ্ধ করা

৭৫তম স্বাধীনতা দিবস --দেশে ও রাজ্যে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন

৭৫তম স্বাধীনতা দিবস --দেশে ও রাজ্যে গণতন্ত্র আজ বিপন্ন

অধ্যাপক চঞ্চল চক্রবর্তী (সাধারন সম্পাদক সেভ ডেমোক্রেসি , পশ্চিমবঙ্গ)

newscopes.in    15th august 2021

স্বাধীন ভারত ২০২১ এর ১৫ই আগস্ট ৭৫ বছরে পা দেবে । ভারতের সার্বিক অবস্থার একটা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করার উপযুক্ত সময় । এক্তা ছোট নিবন্ধে সার্বিক অবস্থার পর্যালোচনা করার অসুবিধা থাকায় এখানে আমি মুলত আলোচনা করবো ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে । সংবিধানের প্রস্তাবনায়  ভারতকে একটি সার্বভৌম , ধর্মনিরপেক্ষ , সমাজতান্ত্রিক , গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, হিসেবে গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে । আমরা আলচনা করার চেষ্টা করব ৭৫ বছরে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কতটা পোক্ত হয়েছে বা আদতে পোক্ত হয়েছে কিনা ! প্রথমেই এটা বলে নেওয়া দরকার যে সাধারণ ভাবে গণতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি অবাধ  ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া । মানুষ অবাধে ও শান্তিতে ভোট দিতে পারলেই মনে করা হয় গণতন্ত্র বেশ বহাল তবিয়তেই আছে । এই ধারনা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল । গণতন্ত্র আছে কি নেই , দুর্বল অবস্থায় আছে না শক্তিশালী অবস্থায় আছে বোঝা যায় নির্বাচনের পর পরবর্তী পাঁচ বছরে প্রশাসন পরিচালনায় সরকার কতটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে তার দ্বারা । নির্বাচনে জয়ীদের বক্তব্য মানুষের ভোটে একবার জিতে এলেই , যা করবে তাই বৈধ । মুখে না বললেও হাবভাবে তাই বোঝানো হয় । তাই নারদা মামলায় হাত পেতে টাকা নেওয়ার অপরাধে সিবিআই রাজ্যের মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করলে মুখ্যমন্ত্রী সিবিআই দপ্তরে ৬ ঘণ্টা ধর্না দিয়ে বসে থাকতে পারেন । বাইরে হাজার হাজার দলীয় সদস্য বিক্ষোভ দেখাতে পারেন , ধৃতদের মুক্তির দাবীতে । সরকারের মতে এ সবটাই গণতান্ত্রিক কারন তারা ভোটে জিতে এসেছেন । আবার অন্য কোনও ক্ষেত্রে তারাই বলবেন আইন আইনের পথেই চলবে ।

এরাজ্যের শাসক দল প্রায়ই বলে থাকে মানুষ আমাদের ভোট দিয়ে জিতিয়েছে , ফলে আমরা যা করছি তাতে মানুষের সমর্থন রয়েছে । কথাটা কি সম্পূর্ণ ভুল ? না তাতো বলা যায় না । সত্যিইতো মানুষ তাদের ভোট দিয়ে জিতিয়েছেন । এখন প্রশ্ন হল ভোট মানুষ কি স্বাধীনভাবে চিন্তা করে ভোট দিতে পেরেছেন ? এর উত্তর না , কারন স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার পরিবেশই থাকছে না । গত দশ বছরে গ্রামে গ্রামে শাসক দলের কর্মীদের যে অত্যাচারের অভিযোগ আছে তারপর তাদের আর ভোট দেওয়ার কথা ? কিন্তু মানুষ তো ভোট দিল । দিল এই কারনে যে অধিকাংশ পঞ্চায়েত তৃনমূলের দখলে । ভোট না দিলে সেই বুথের লোকেরা জবকার্ড পাবে না , পেলেও কাজ পাবেনা , স্বাস্থ্য সাথীর কার্ড থাকলেও সুবিধা পাবে না, আবাস যোজনায় ঘর পাবে না , পাড়ার ক্লাবের সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে ইত্যাদি । এতসব না পাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে গ্রামের গরীব মানুষ কি স্বাধিনভাবে ভোট দিতে পারে ? আর এইসব প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য তৃনমূল কর্মীদের টাকার একটা অংশ দিতে হবে । যে সুবিধা পাচ্ছে সে ভাবছে কিছু তো পেলাম । প্রকৃত অর্থে গ্রামএর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ তৃণমূল কর্মীদের কাছে বাধা পড়েছে । আর অন্যদিকে শাসক দলের কর্মী বাহিনী এখান থেকে যে সরকারি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে যে টাকা পাচ্ছে সেটাই হয়ে উঠেছে তাদের জীবিকা । একদিকে গড়ে উঠেছে এক বিরাট উপভোক্তা শ্রেণী আর অপরদিকে সৃষ্টি হয়েছে একটা নতুন অনুতপাদক পরজীবী শ্রেণী । এই শ্রেণী জানে এই সরকার না থাকলে তাদের জীবিকা থাকবে না । তাই নির্বাচনের আগে এই শ্রেণী মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার রক্ষা করার জন্য । তাই সরকারের পক্ষে এই ভোটদান মানুষের বন্ধনমুক্ত স্বাধীন মতামতের প্রকাশ নয় , সরকারের দাক্ষিণ্যের আশায় বাধা পড়ে থাকা মানুষের মতামত । গণতন্ত্র হল মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটানোর উপযুক্ত পরিবেশ । আর সেই পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব সরকার সহ সমস্ত রাজনৈতিক দলের ।

গণতন্ত্র মানে অনুগ্রহে বেঁচে থাকা নয় । নিজের রোজগারের ওপর বাঁচা । গণতন্ত্র মানে কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা । গণতন্ত্র মানে অফিস আদালত কল কারখানায় স্কুল কলেজে চাকরীর ব্যবস্থা করা । গণতন্ত্র মানে স্বনির্ভরতা । স্বনির্ভরতা থেকে আসে স্বাধীন চিন্তা করার সাহস আর মানুষের মধ্যে এই সাহস সঞ্চারিত হলেই গণতন্ত্র বাঁচে ।

 

এবার আসি দেশের কথায় । দেশ চালাচ্ছে বিজেপি সরকার । বিজেপি মতাদর্শগত ভাবে মৌলবাদী , ফ্যাসিসমে্মের ধারনায় বিশ্বাস করে । এক দেশ এক জাতি এক ধর্ম এক সংস্কৃতি (হিন্দু সংস্কৃতি ) এক ভাষা – এই হচ্ছে বিজেপির মূল মন্ত্র । এই মন্ত্র পাঠ করে গণতন্ত্র কে কবরে পাঠানোর যজ্ঞ বিজেপি জোর কদমে চালাচ্ছে ।

তারাও বলে ভোটে জিতে এসেছি , তাই কৃষক স্বার্থ বিরোধী বিল তারা পাশ করিয়েছে । সরকারের বিরোধিতা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহী বলে জেলে পোরা হচ্ছে । সে জে এন ইউ ছাত্র , তেলেগু কবি ভারভারা রাও , ফাদার স্ত্যান স্বামী , বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সোমা সেন , আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজের মত মানুষও হতে পারেন । এমনকি সাংবাদিকরাও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না । সম্প্রতি এইরকম একটি মামলা প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ – স্রকার বিরোধী হলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলা যায় না । ব্রিটিশ আমলের সেডিসন আইন যা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের বিরুদ্ধে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ রাখার জন্য ছিল , সে আমলে এই আইন মহাত্মা গান্ধী , বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল , স্বাধিনতার ৭৫ বছর পরও কেন স্বাধীন দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হবে ? এই আইন থাকবে কেন ? কেন এই উপনিবেশিক আইঙ্কে বয়ে বেড়াবো ?

প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে কি বোঝায় ? আজ আর এই প্রশ্নকে এড়িয়ে গণতন্ত্রকে আলোচনা করা যায় না । এ প্রশ্নের উত্তর তো সহজ । পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম সংবিধান প্রদান করে গেছেন আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এবং তাঁদের আশা ছিল নাগরিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এই সংবিধান হবে রক্ষাকবজ । কিন্তু শর্ষের মধ্যেই যদি ভুত থাকে তাহলে সেই শর্ষে দিয়ে আর ভুত তাড়ানো যায় ? সংবিধানে মৌলিক অধিকারের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে । এমন কি পুলিশ যাতে নাগরিকদের ইচ্ছেমত গ্রেপ্তার করতে না পারে তার বিধানও রাখা হয়েছে ২২ নম্বর ধারায় । কিন্তু এইসব কোনও অধিকারই নাগরিকদের থাকবে না যদি তাদের নিবর্তন মূলক আটক আইনে গ্রেপ্তার করা হয় । সংবিধান লাগু হওয়ার পর থেকেই বারে বারে নাগ্রিক অধিকার খর্বিত হয়েছে নিবর্তন মূলক আটক আইন প্রয়োগের দ্বারা ।

 

বর্তমানে যে আইঙ্কে সব থেকে বেশী মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি হল ইউ এ পি এ (unlawful activities prevention act ) আমাদের দেশে নিবর্তন মূলক আটক আইনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে । Defence of India Rule (DIR) , PDAct , ESMA , NASA , TADA – এইসব বিভিন্ন নামে নিবর্তন মূলক আটক আইন প্রয়োগ হয়েছে বারবার । সব ক্ষেত্রেই মূল উদ্দেশ্য একটাই – বিরোধী প্রতিবাদী স্বর রুদ্ধ করা । সাধারণ বিচার প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে বিনাবিচারে অনির্দিষ্ট কাল জেল বন্দী করে রাখা । এখণ সবচেয়ে বেশী UAPA  প্রয়োগ হচ্ছে । মোদী সরকারের সময় বেড়েছে অনেকগুণ । জণ অধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে । একদিকে প্রতিবাদী সাংবাদিক দের বিরুদ্ধে , অন্যদিকে রাজ্যে ভাঙড় আন্দোলনের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে । এক্ষেত্রে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোণো ফারাক নেই ।

স্বাধীনতার ৭৫ বছর শুরুর প্রাক মুহূর্তে আমরা লক্ষ করছি ভারত ক্রমশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে সামগ্রিকতাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে । এই কাজ সংবিধান প্রণেতাদের চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিরোধী । তাই সংবিধানকে রক্ষা করার পাশাপাশি এর গণতান্ত্রিক সংশোধনও জরুরী হয়ে পড়েছে ।

স্বাধীনতার ৭৫ বছরের অঙ্গীকার হোক – রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল করতে হবে । UAPA  সহ সমস্ত রকম নিবর্তন মূলক আইন খারিজ করতে হবে । গণতান্ত্রিক ভারতের কণ্ঠস্বরকে জোরদার করার দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে ।

 

Your Opinion

We hate spam as much as you do