ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইতিহাস দর্শনের আধুনিক গতিপথের দিকে যে সব সময়ে সুবিচার করেছিলেন তা বলা যায় না।জাতীয়তাবাদের আড়ালে উগ্র জাতীয়তাবাদ, যা সেই সময়ে সুপ্ত হিন্দুত্ববাদী চেতনার ধারণার দ্বারা পুষ্ট ছিল, সেই ধারার ইতিহাস রচনার প্রবণতাও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘিরে ক্ষমতা হস্তান্তরের অল্প সময় পর থেকেই তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে।
অতীত মুছতেই স্বাধীনতার ইতিহাসের পুনর্নিমাণ চায় সঙ্ঘ -( প্রবন্ধ )
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের পুনর্নিমাণ চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।সেই ডাক দিয়ে গান্ধীজীর সবরমতী আশ্রম থেকে ১২ ই মার্চ, '২১ ' আজাদি কা অমৃত মহোৎসবে' র সূচনা করলেন মোদি।যে হাত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের মূর্তিতে মালা দিয়েছেন, সেই হাত দিয়েই গান্ধীজীর মূর্তিতে মালা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন; কংগ্রেস এবং নেহরু পরিবারের কীর্তিতে রঞ্জিত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের তিনি পরিবর্তন চান।তিনি তুলে ধরতে চান ইতিহাসে উপেক্ষিতদের ভূমিকা।গান্ধীজীর ডান্ডি অভিযানের অনুকরণে নোতুন করে অভিযানের ভিতর দিয়ে আদিবাসী সহ পাদপ্রদীপের তলায় থাকা মানুষ, যাঁদের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা আছে, সেইসব অবদানগুলিকে আরো গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরবার অঙ্গীকার প্রধানমন্ত্রী করেছেন।
আপাতদৃষ্টিতে মানুষের মনে হতে পারে, জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস চর্চাতে নোতুন গবেষণার ধারাকে উজ্জীবিত করা প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য।কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাস নোতুন করে চর্চার ইচ্ছের ভিতরে ইতিহাস বিকৃতির অভিসন্ধিই সবথেকে বড় হয়ে উঠছে।ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে নেতানেত্রীদের অবদান অপেক্ষা সাধারণ মানুষের লড়াই , সংগ্রামের বিষয়টিকেই সবথেকে বেশি গুরুত্বদিয়ে তুলে আনার ধারাটি প্রথম শুরু করেছিলেন বস্তুবাদী ইতিহাস গবেষকেরা।জাতীয়তাবাদী প্রবণতার ইতিহাসকারেরা ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইতিহাস দর্শনের আধুনিক গতিপথের দিকে যে সব সময়ে সুবিচার করেছিলেন তা বলা যায় না।জাতীয়তাবাদের আড়ালে উগ্র জাতীয়তাবাদ, যা সেই সময়ে সুপ্ত হিন্দুত্ববাদী চেতনার ধারণার দ্বারা পুষ্ট ছিল, সেই ধারার ইতিহাস রচনার প্রবণতাও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘিরে ক্ষমতা হস্তান্তরের অল্প সময় পর থেকেই তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পদলেহনকারী। সেই ভূমিকাকে আড়াল করতে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন সাভারকর।ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের(১৮৫৭) ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন সাভারকর ঘটিয়েছিলেন এ সম্পর্কে লেখা তাঁর গ্রন্থে।দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পন্ডিত নেহরুর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে মহাবিদ্রোহের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাভারকরের দৃষ্টিভঙ্গি র অনুসারী হয়ে প্রথমে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ১৮৫৭ র ইতিহাস লেখায় হাত দেন আর এস এসের ঘরের লোক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার। তাঁর ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সেই ভাবনার প্রকাশ ১৮৫৭ র ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে ঘটতে শুরু করায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ডঃ মজুমদারের তীব্র সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়।ভারত সরকার কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত চেতনাকে সরকারী ইতিহাসের স্বীকৃতি দিতে রাজি হয় না।এই অবস্থায় ডঃ মজুমদারের ই সহপাঠী তথা পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সুরেন্দ্রনাথ সেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করেন।
নিজেদের ব্রিটিশ তোষামোদির ইতিহাস কে চেপে রাখতেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক , মৌলবাদী শিবির আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বিশেষ পরিবারের ইতিহাস হিশেবে তুলে ধরবার অভিযোগ তোলে।এভাবেই তারা মুসলিম সাম্প্রদায়িক শিবিরকে সাহায্য করে ,মুসলিম লীগের দেশভাগের দাবি এবং সেই দাবি পূরণ ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের যে ভূমিকা, তা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চায়।ভুলিয়ে দিতে চায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসরমান সম্প্রদায়ের ধারাবাহিক ঐতিহাসিক অবদানকেও।তাই ই প্রধানমন্ত্রী মোদি সবরমতী আশ্রমে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তির সময়, সেই উপলক্ষে স্বাধীনতার ইতিহাস পুনর্নিমাণ করার যে কথা বলেছেন, সেখানে আদিবাসী সমাজের কথা বললেও একটি বারের জন্যেও উচ্চারণ করেন নি মুসলমান সমাজের ঐতিহাসিক অবদানের কথা।তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার লড়াই থেকে শুরু করে ,ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম(১৮৫৭), দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক স্তরে হলেও যে অসংখ্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হয়েছে , যেগুলিতে কখনো মুসলমানেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, কখনো হিন্দু- মুসলমান যৌথ ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে- সেগুলির কোনো উল্লেখ ই প্রধানমন্ত্রী করেন নি।বহু সীমাবদ্ধতা স্বত্ত্বেও খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন গ্রামীণ ভারতে ব্রিটিশের আর্থ- সামাজিক শোষণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে যে অসামান্য ভূমিকা পালন করেছিল, বলাবাহুল্য প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পুনর্নিমাণের ক্ষেত্রে এগুলির একটির ও নাম বলেন নি।আজাদ হিন্দ ফৌজের ঐতিহাসিক সংগ্রামে হিন্দু- মুসলমানের যৌথ লড়াই ঘিরেও মোদি নিশ্চুপ ই থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটের মুখে দেশপ্রেমের নামে উগ্রতাকে একটা বল্গাহীন জায়গাতে পৌঁছে দিতে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পুনর্নিমাণে প্রধানমন্ত্রী মোদির ইচ্ছা প্রকাশ হল আর এস এসের রাজনৈতিক অভিষ্পার একটি নগ্ন প্রকাশ।অতীতে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে এই চেষ্টাই আর এস এস করেছিল আই সি এইচ আরের যাবতীয় পাঠক্রম বদলে দিয়ে।'টুওয়ার্ড ফ্রিডম' নামক সরকারী গ্রন্থে জাতীয় আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদীদের ইতিবাচক ভাবে দেখিয়ে।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার সদস্যা ছিলেন।একটি প্রতিবাদ ও সেইদিন মমতা করেন নি।আজ ও ঠিক তেমন ভাবেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করে, প্রচারের আলো থেকে দূরে থাকা স্বাধীনতার যোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতির নাম করে, আর এস এস, তাদের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভাসহ আরো বহু সংগঠনের ভূমিকা কে ইতিবাচক ভাবে দেখাবার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে।বলাবাহুল্য, এইঅপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রগলভ মমতা এখনো পর্যন্ত কিন্তু একটি শব্দ ও উচ্চারণ করেন নি।
প্রবন্ধের বক্তব্য বক্তার নিজস্ব ।
ছবি- দ্য ইকোনমিক টাইমস
We hate spam as much as you do