Tranding

01:17 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / সাভারকার - এক প্রবঞ্চক বীরের কাহিনী

সাভারকার - এক প্রবঞ্চক বীরের কাহিনী

সাভারকর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে আসার এক মাস পর, ৩০ আগস্ট ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তার প্রথম ক্ষমার আবেদন জমা দেন। সরকারী চিঠি নং ২০২২ দ্বারা, ৪ এপ্রিল ১৯১১ তারিখে, তার আবেদন ব্রিটিশ সরকার প্রত্যাখ্যান করে। সাভারকর ১৪ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখে তার পরবর্তী ক্ষমার আবেদন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের হোম সদস্য স্যার রেজিনাল্ড ক্র্যাডককে ব্যক্তিগতভাবে পেশ করেন। তার চিঠিতে, তিনি নিজেকে "পিতামাতাসম সরকারের দরজায়" ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষায একজন "উৎসাহী পুত্র" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি আরও বলেছিলেন "এছাড়াও, সাংবিধানিক লাইনে আমার এই পরিবর্তন ভারতে এবং বিদেশের সেই সমস্ত বিপথগামী যুবকদের ফিরিয়ে আনবে যারা একসময় আমাকে তাদের পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখছিল। আমি সরকারের পছন্দমত যে কোনও ক্ষমতায় সরকারকে সেবা করতে প্রস্তুত। যেহেতু আমার এই পরিবর্তন আমি সজ্ঞানে করছি, তাই আমি আশা করি আমার ভবিষ্যত আচরণও তেমনই হবে। আমাকে কারাগারে রেখে কিছুই পাওয়া যাবে না, অন্যথায় যা কিছু পাওয়া যাবে।

সাভারকার - এক প্রবঞ্চক বীরের কাহিনী

সাভারকার - এক প্রবঞ্চক বীরের কাহিনী

পারভেজুর রহমান
২৮ মে ২০২৩

আজ দেশের নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন| হঠাৎ নতুন সংসদ ভবন কেন? কত খরচ হল? প্রয়োজন ছিল কিনা? উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ করা হল না কেন? সে নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে, আরও হবে| আজকের এই আলোচনার বিষয় তা নয়| এই আলোচনার বিষয় হল এই উদ্বোধনের জন্য হটাৎ তথাকথিত 'বীর সাভারকারের' জন্মদিনটিকেই বেছে নেওয়া হল কেন ?
পৃথিবীতে বহু মানুষ তার বংশপ্রদত্ত নাম ছাড়াও বিভিন্ন নামে পরিচিত হন। যেমন মহাত্মা, গুরুদেব, নেতাজি ইত্যাদি | যে নামগুলো কেউ না কেউ তাদের নামের সাথে সম্মান দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে যুক্ত করেছেন| যেমন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে 'মহাত্মা' নামে অভিহিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর| তাঁকে 'জাতির পিতা' নামে অভিহিত করেছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু| রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে 'কবিগুরু' নামে সম্বোধিত করেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী| সুভাষচন্দ্র বসুকে প্রথম 'ফুয়েরার' নামে সম্বোধন করেন হিটলার, সেখান থেকেই ভারতবর্ষের মানুষ তাকে 'নেতাজি' নামে সম্মান দেন| ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় "বিদ্যাসাগর' উপাধি পেয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময় (তৎকালীন সময়ে এটি একটি ডিগ্রির নাম ছিল )| কাজী নজরুল ইসলামকে 'বিদ্রোহী কবি' নামে প্রথম চিহ্নিত করেন মুজফ্ফর আহমেদ| ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড: রাজেন্দ্র প্রাসাদকে 'দেশরত্ন' উপাধিতে ভূষিত করেছে ভারত সরকার |ইন্দিরা গান্ধীকে 'প্রিয়দর্শিনী' নাম দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর| মিলখা সিংহকে ‘ফ্লাইং শিখ’ উপাধি দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান| শেখ আব্দুল্লাকে জওহরলাল নেহেরু 'শের-ই-কাশ্মীর' বলে প্রথম সম্বোধিত করেছেন| তালিকা দীর্ঘ করা এই ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক| এই রকম বহু মানুষ আছেনযাদের নামের সঙ্গে বিভিন্ন কারনে, বিভিন্ন ভাবে এই নামগুলো যুক্ত হয়েছে|

এখন মনে প্রশ্ন জাগে বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে 'বীর সাভারকার' নামে কে প্রথম সম্বোধন করেন? কেনই বা তাকে 'বীর' উপাধিতে ভূষিত করেন দেশের এক বিশেষ মতাদর্শের মানুষ ? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে চেষ্টা করা হোক মূল সূত্রে পৌঁছানোর |

১৯২৬ সালে "চিত্রগুপ্ত" নামক এক লেখকের লেখা বিভিন্ন রোমহর্ষক কাহনী সম্বলিত সাভারকারের একটি জীবনী "ব্যারিস্টার সাভারকারের জীবন" শিরোনামে প্রকাশিত হয়। আশ্চর্য! এই 'চিত্রগুপ্ত' র লেখা এর আগে আর কোনও বই নেই, এর পরও আর কোনও বই নেই| এই বইটিতেই সাভারকারকে 'বীর' উপাধিতে ভূষিত করা হয়| কে এই 'চিত্রগুপ্ত'? হিন্দু মহাসভার ইন্দ্র প্রকাশের সংযোজন সহ ১৯৩৯ সালে একটি সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় এই বইযের। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮৭ সালে বীর সাভারকর প্রকাশন দ্বারা প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকায় রবীন্দ্র বামন রামদাস লেখেন যে, "চিত্রগুপ্ত বীর সাভারকার ছাড়া আর কেউ নন"। অর্থাৎ বীর সাভারকর প্রকাশনের ঘোষণা অনুযায়ী সাভারকার নিজেই নাম বদল করে "চিত্রগুপ্ত" ছদ্মনামে নামে নিজের জীবনী লিখলেন এবং সেখানে নিজেই নিজেকে ' বীর' উপাধিতে ভূষিত করেছেন| এই রকম উদাহরণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বললেও ভুল হবে, এরকম উদাহরণ অনন্য। লজ্জাজনকও বটে| এর সাথে শুধু অদ্ভুতভাবে মিলে যায় আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। যে নিজেকে নিজেই 'সততার প্রতীক' উপাধিতে ভূষিত করে ছিলেন-যদিও এখন আর তা উল্লেখ করার সাহস পান না|

বিনায়ক দামোদর সাভারকার, যার জন্মদিনকে আমাদের দেশের নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধনের জন্য বেছে নেওয়া হল, সেই সাভারকারের এদেশের মানুষের জন্য, দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে তার অবদান কি? একটি মাত্র ঘটনা ছাড়া স্বাধীনতা আন্দোলনে সাভারকারের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না| নাসিকের ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এএমটি জ্যাকসনকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৩ মার্চ ১৯১০-এ সাভারকারকে গ্রেপ্তার করেছিল বৃটিশ পুলিশ। জ্যাকসনকে হত্যার সময় সাভারকর লন্ডনে ছিলেন, কিন্তু তাকে হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত পিস্তল সরবরাহ করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল। এক বছর পর, ১৯১১ সালের ৪ জুলাই, তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে ('কালা পানি') আনা হয়-সাথে তার বড় দাদা গণেশ সাভারকার |

এর পরের ঘটনা ? আন্দামানের সেলুলার জেলে অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন চালু করা 'আলো শব্দের' (Light & Sound Show) মাধ্যমে জানানো হয় যে সাভারকার কত বড় 'বীর' ছিলেন| কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা| আসলে আন্দামানের সেলুলার জেলের সাথে জড়িয়ে থাকা সাভারকারের ইতিহাস হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে ক্ষমা ভিক্ষার ইতিহাস |

সাভারকর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের  সেলুলার জেলে আসার এক মাস পর,  ৩০ আগস্ট ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তার প্রথম ক্ষমার আবেদন জমা দেন। সরকারী চিঠি নং ২০২২ দ্বারা, ৪ এপ্রিল ১৯১১ তারিখে, তার আবেদন ব্রিটিশ সরকার প্রত্যাখ্যান করে। সাভারকর ১৪ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখে তার পরবর্তী ক্ষমার আবেদন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের হোম সদস্য স্যার রেজিনাল্ড ক্র্যাডককে ব্যক্তিগতভাবে পেশ করেন। তার চিঠিতে, তিনি নিজেকে "পিতামাতাসম সরকারের দরজায়" ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষায একজন "উৎসাহী পুত্র" হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন। ওই চিঠিতে তিনি আরও বলেছিলেন "এছাড়াও, সাংবিধানিক লাইনে আমার এই পরিবর্তন ভারতে এবং বিদেশের সেই সমস্ত বিপথগামী যুবকদের ফিরিয়ে আনবে যারা একসময় আমাকে তাদের পথপ্রদর্শক হিসাবে দেখছিল। আমি সরকারের পছন্দমত যে কোনও ক্ষমতায় সরকারকে সেবা করতে প্রস্তুত। যেহেতু আমার এই পরিবর্তন আমি সজ্ঞানে করছি, তাই আমি আশা করি আমার ভবিষ্যত আচরণও তেমনই হবে। আমাকে কারাগারে রেখে কিছুই পাওয়া যাবে না, অন্যথায় যা কিছু পাওয়া যাবে।

১৯১৭ সালে, সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবার আরেকটি ক্ষমার আবেদন জমা দেন, এইবার তিনি এই আবেদনে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের সাধারণ ক্ষমার জন্য আবেদন করেন। ১৯১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সাভারকরকে জানানো হয় যে ক্ষমার আবেদনটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের সামনে রাখা হয়েছিল।

১৯১৯ সালের ডিসেম্বরে,ব্রিটেনের রাজা-সম্রাট জর্জ পঞ্চম দ্বারা একটি রাজকীয় ঘোষণা ছিল। এই ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৬-এ রাজনৈতিক অপরাধীদের প্রতি রাজকীয় ক্ষমার ঘোষণা অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজকীয় ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে, সাভারকর ৩০ মার্চ ১৯২০ সালে ৪র্থ বারের জন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের কাছে তার ক্ষমার আবেদন জমা দেন| যাতে তিনি বলেছিলেন যে "এখন পর্যন্ত নৈরাজ্যবাদী বুকানিনের প্রচারিত জঙ্গি মতাদর্শে বিশ্বাস করা পুরানো আমি এখন আর নই। এমনকি কুরোপাটকিন বা টলস্টয়ের শান্তিপূর্ণ এবং দার্শনিক নৈরাজ্যবাদের আদর্শেও আমার কোনও বিশ্বাস বা অবদান নেই| এমনকি আমার অতীতের বিপ্লবী প্রবণতা সম্পর্কে বলতে হলে বলতে হয় যে, আজকের এই বক্তব্য আজকে আমি শুধুমাত্র ক্ষমা পাওয়ার জন্য বলছি না| এর কয়েক বছর আগেও একথা সরকারকে আমি জানিয়েছি এবং সরকারকে আমার আগের পিটিশনে (১৯১৮, ১৯১৪) আমি সংবিধান মেনে চলার আমার দৃঢ় অভিপ্রাযের কথা লিখেছিলাম এবং মিঃ মন্টাগু কর্তৃক যে সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে তার পাশে দাঁড়ানোর কথা আমি ঘোষণা করেছি এটি প্রস্তাবিত হওয়ার সাথে সাথেই। সেই থেকে আমি সুশৃঙ্খল ও সাংবিধানিক উন্নয়নের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমার বিশ্বাস এবং প্রস্তুতির কথা প্রকাশ্যে প্রকাশ করেছি।" এই আবেদনটি ১২  জুলাই ১৯২০  তারিখে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এই সময় নিজের মুক্তির স্বপ্ন পূরণ করতে সাভারকর তার বিচার, রায় এবং ব্রিটিশ আইনকে সমর্থন করে এবং হিংসা পরিত্যাগ করে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।

১৯২১ সালের ২ মে, সাভারকর ভাইদের রত্নাগিরির একটি কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়। ৬ জানুয়ারী ১৯২৪  সালে তাদের জেল থেকে মুক্তি হয় তাদের গতিবিধি রত্নাগিরি জেলায় সীমাবদ্ধ থাকা এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকার বৃটিশ শর্তে| এই সময় সাভারকার হিন্দু সমাজ বা হিন্দু সংগঠনের একত্রীকরণে কাজ শুরু করেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে থাকার জন্য একটি বাংলো দিয়েছিল| এই সময় থেকেই তিনি মাসিক ৬০ টাকা ভাতা পেতেন ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে | সাভারকরকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল বাইরের মানুষের সাথে দেখা করার। তার বন্দিদশা চলাকালীন, তিনি মহাত্মা গান্ধী এবং আম্বেদকরের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাত করেন। তার সাথে দেখা করতো আসা এবং তার বই প্রকাশ করতে ইচ্ছুক প্রকাশকদের ক্ষেত্রে একটি শর্ত ছিল যে তারা রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগবিহীন হবেন ।

পরবর্তী সময়ে এই লজ্জাকে ঢাকবার জন্য সাভারকারের সমর্থক হিন্দুত্ববাদীরা সাভারকারের আদর্শগত বিরোধী গান্ধীর নামকে এই ক্ষমা ভিক্ষার সাথে জড়িয়ে আর এক মিথ্যা রচনা করেন| ১২ অক্টোবর ২০২২ তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন যে, "তিনি (সাভারকর) কারাগারে থাকাকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে একাধিক করুণার আবেদন করেছিলেন ঠিক। কিন্তু সত্য হলো, তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাণভিক্ষার আবেদন করেননি। করুণার আবেদন করা একজন বন্দীর অধিকার ছিল। আসলে, মহাত্মা গান্ধী তাকে ক্ষমার আবেদন করতে বলেছিলেন।" ইতিহাসের সময় সারণী অন্য কথা বলে। সাভারকর ১৯১১  থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৬ টি করুণার আবেদন করেছিলেন। ১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট জেলে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে তার প্রথম করুণার আবেদন জমা পড়ে। দ্বিতীয় আবেদন জমা দেন, দুই বছর পর, ১৪ নভেম্বর ১৯১৩ তে। এই আবেদনে তিনি তার আগের করুণার আবেদনের কথা উল্লেখ করেন। এবং পরবর্তীকালে ১৯১৪, ১৯১৭, ১৯১৮  এবং ১৯২০ সালে কমপক্ষে ৪ টি পিটিশন দাখিল করেন| মহাত্মা গান্ধী তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন অনুশীলন করছিলেন, তিনি ভারতে ফেরেন  ৯ জানুয়ারী ১৯১৫ সালে, সাভারকর কারাগার থেকে তার প্রথম করুণার আবেদন (১৯১১) করার চার বছর পরে। কি ভয়ঙ্কর মিথ্যা !
পরবর্তীতে, ব্রিটিশ ভারতে দেশব্যাপী প্রাদেশিক নির্বাচনের অংশ হিসাবে ১৯৩৭ সালে বোম্বে প্রেসিডেন্সির দুটি কক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বিধানসভায় ১৭৫টি আসনের মধ্যে ৮৬টি এবং বিধান পরিষদে ৬০টি আসনের মধ্যে ১৩টি জিতে একক বৃহত্তম দল হয়। নির্বাচনের পরে বি.জি. খেরের অধীনে গঠিত কংগ্রেস সরকার তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছিল।

এই ১৩ বছর সাভারকার ব্যয় করেছিলেন "হিন্দুত্বের মতাদর্শে" ভারতীয় হিন্দুদেরকে সংবদ্ধ করতে | ১৯৩৭ সালে মুক্তিলাভের পরে তিনি হিন্দু মহাসভার সভাপতি হন এবং প্রচার করতে থাকেন যে, ভারতের আসল শত্রু মুসলমানদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে প্রয়োজনে ইংরেজদের সহায়তা নিতে হবে| দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিন্দু মহাসভার সভাপতি হিসাবে সাভারকর "সমস্ত রাজনীতিকে হিন্দুকরণ করুন এবং হিন্দুত্বকে সামরিকীকরণ করুন" স্লোগানকে সামনে রেখে হিন্দুদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে ব্রিটিশ যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন।
সাভারকর মুক্তি পাওয়ার পর কোনও দিনও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেননি| এমনকি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন| সাভারকারের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা প্রকাশ্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আহ্বানের বিরোধিতা করে আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করেছিল। সাভারকর "Stick to your Posts" শিরোনামে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তিনি নির্বাচিত হিন্দু সভ্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, যারা "পৌরসভা, স্থানীয় সংস্থা, আইনসভার সদস্য বা যারা সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন ... তারা তাদের পদে থাকুন এবং কোনো মূল্যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেবেন না।" সাভারকর হিন্দুদের যুদ্ধের প্রচেষ্টায় সক্রিয় থাকতে বলেন এবং  বলেন যে তারা যেন সরকারের অবাধ্য না হন| তিনি হিন্দুদেরকে "যুদ্ধের কলা" শেখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার আহ্বান জানান।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৭ সালের ভারতীয় প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভাকে ধ্বংস করে ব্যাপক বিজয় লাভ করেছিল | ১৯৩৯ সালে, ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর ভারতীয় জনগণের সাথে পরামর্শ না করেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতকে যুক্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলি পদত্যাগ করে।

এই সময় সাভারকারের সভাপতিত্বে হিন্দু মহাসভা তাদের ঘোষিত শত্রু মুসলিম লীগের সাথে হাত মিলিয়ে সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, এবং বাংলায় জোট সরকার গঠন করেছিল। সিন্ধুতে হিন্দু মহাসভার সদস্যরা গোলাম হোসেন হিদায়াতুল্লাহর মুসলিম লীগ সরকারে যোগ দেয়। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হিন্দু মহাসভার সদস্যরা ১৯৪৩ সালে সরকার গঠনের জন্য মুসলিম লীগের সরদার আওরঙ্গজেব খানের সাথে হাত মিলিয়েছিল। মন্ত্রিসভার মহাসভা সদস্য ছিলেন অর্থমন্ত্রী মেহের চাঁদ খান্না। বাংলায় হিন্দু মহাসভা ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টির জোট সরকারে যোগদান করে। সাভারকর জোট সরকারের সফল কার্যকারিতার প্রশংসাও করেছিলেন। অথচ দাবি করা হয় মুসলিম লীগের দাবির সাথে হিন্দু মহাসভা কোনওদিন নাকি সহমত হয়নি |
মুসলিম লীগের সাথে একসাথে প্রদেশ সরকার চালানোই নয় | ভারতবর্ষের সবথেকে বড় যন্ত্রনা শেষভাগ - যে তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে, সেই 'দ্বিজাতিতত্ত্ব"কেও সমর্থন জানিয়েছিলেন সাভারকার | ১৯৩৭ এ আহমেদাবাদ (কর্ণাবতী ) অধিবেশনে সভাপতিত্বের ভাষণে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের অবতারণা করেন| ১৯৪১ সালে যখন সাভারকারের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা মুসলিম লীগের সাথে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করছে তার এক বছর আগেই ১৯৪০ সালের ২০ মার্চ লাহোর ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগের সাধারণ অধিবেশনে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে 'পাকিস্তান' নামক দেশ গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়েছে | লীগের সাথে সরকার চালানোর পর ১৯৪৩ এর ১৫ আগস্ট নাগপুরে হিন্দু মহাসভার সভায় সাভারকার বলেন যে, "জিন্নাহ সাহেবের সাথে আমার কোনও ঝগড়া নেই | ঐতিহাসিক ভাবেই হিন্দু আর মুসলমান দুটি আলাদা জাতি "| এমনকি পরবর্তীতে তিনি আলাদা "শিখিস্তান" গঠনেরও দাবি রাখেন |

স্বাধীনতার প্রতি তার তথাকথিত ভালোবাসার কথাকে প্রমান করতে সাভারকারের মতাদর্শীরা আরও বলেন যে, সাভারকারই পৃথিবীতে প্রথম ১৮৫৭ র সিপাহী বিদ্রোহকে স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসাবে উল্লেখ করে "The Indian War of Independence" নামক বই লিখেছিলেন| এক্ষেত্রেও তারা এক বড় মিথ্যা কথা বলেন| ইতিহাস থেকে জানা যায় যে কার্ল  মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস জুলাই ১৮৫৭ থেকে অক্টোবর ১৮৫৮ পর্যন্ত "New-York Daily Tribune" পত্রিকায় প্রায় ৩২ টি প্রবন্ধ লেখেন ভারতবর্ষের তৎকালীন ঘটনাবলীকে নিয়ে, যেখানে তারা সিপাহী বিদ্রোহকে "The First Indian War of Independence (1857-1858)" -স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করেন | আর সাভারকারের "The Indian War of Independence" নামক বইটি প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে| আরও এক ভয়ঙ্কর মিথ্যা |

স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী গান্ধীর হত্যার পর, পুলিশ হত্যাকারী হিন্দু মহাসভা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য নাথুরাম গডসে এবং তার কথিত সহযোগী ও ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তার করে। গডসে "অগ্রণী – হিন্দু রাষ্ট্র" নামক পুনের একটি মারাঠি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, যা "দ্য হিন্দু রাষ্ট্র প্রকাশন লিমিটেড" দ্বারা পরিচালিত হত। এই কোম্পানিতে সাভারকর কোম্পানিতে ১৫০০০ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। হিন্দু মহাসভার প্রাক্তন সভাপতি সাভারকারকে ১৯৪৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী শিবাজি পার্কে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং বোম্বের আর্থার রোড কারাগারে আটক রাখা হয়। তার বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যার ষড়যন্ত্র এবং খুনের প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছিল। পরে প্রমানের অভাবে তিনি মুক্তি পান|
যখন সেলুলার জেলে বন্দী ইন্দুভূষণ রায় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নিজের জামা ছিঁড়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করছেন। যখন উল্লাসকর দত্ত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেলুলার জেলে নির্মম নির্যাতন এবং বারবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার কারণে  এবং বলা হয় যে তিনি তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। তখন সাভারকার একটার পর একটা ক্ষমা ভিক্ষা করে চলেছেন মুক্তির জন্য। আর তাকেই মানুষের সামনে প্রস্তুত করা হচ্ছে 'বীর' হিসাবে। এ এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা। যখন কারাগারের মধ্যে বাবা ভান সিংকে জেলারের নির্দেশ পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তখন সাভারকার একটার পর একটা আবেদন করছেন বৃটিশ সরকারের কাছে।

যখন বিপ্লবী মোহিত মৈত্র সেলুলার জেলে অনশন করে প্রাণ দিচ্ছেন।  সেলুলার জেলে যখন মোহন কিশোর নামদাসকে আমরণ অনশন করা অবস্থায় জোর করে খাওয়াতে গিয়ে কার্যত খুন করছেন বৃটিশ সরকার।

যখন কালাপানির বাইরে লাহোর জেলে ভগৎ সিং, রাজগুরু সুখদেবরা স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির দড়িতে ঝুলে প্রাণ দিচ্ছেন। তখন সাভারকার রত্নাগিরিতে বৃটিশদের দেওয়া বাংলোয় বৃটিশদের দেওয়া ৬০ টাকা মাসোহারায় 'হিন্দুত্ব' চর্চা ও প্রচারের মধ্যে দিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। তাকে 'বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টাকে দেশদ্রোহীতার মতো অপরাধ ছাড়া আর কি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়?

দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যার এরকম ভূমিকা| ক্ষমা ভিক্ষা করে মাসোহারা নিয়ে বৃটিশদের দেওয়া বাংলোয় সুখের জীবন যাপন করে। প্রকাশ্যে বৃটিশদের সমর্থনের কথা ঘোষনা করেন। দেশভাগের প্রশ্নে যে মুসলিম লীগের সাথে এক সুরে কথা বলে | স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সাথে যার নাম যুক্ত| সেই রকম এক মানুষের জন্মদিনকে স্বাধীন ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের সবথেকে বড় প্রতিষ্ঠান সংসদ ভবন উদ্বোধনের দিন হিসাবে বেছে নেওয়া শুধুমাত্র একটা আকস্মিক সমাপতন নয়| অতীতের সমস্ত ইতিহাসকে মুছে ফেলে নিজেদের মতের মত করে নতুন ইতিহাস নির্মাণের যে প্রয়াস কেন্দ্রের এই হিন্দুত্ত্ববাদীরা চালাচ্ছে, এ তারই ভয়ঙ্কর বীভৎস নগ্ন প্রকাশ |

তাই এ দিনটি ভারতবর্ষের ১৪৪ কোটি  মানুষের কাছে এক লজ্জার দিন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে |

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

Your Opinion

We hate spam as much as you do