Tranding

02:15 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / বিশ্বজুড়ে বিপন্ন মাতৃভাষা, আক্রান্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাঃ কিছু তথ্য ১ম পর্ব

বিশ্বজুড়ে বিপন্ন মাতৃভাষা, আক্রান্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাঃ কিছু তথ্য ১ম পর্ব

এরপর ২১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ-র ঘোষণা, "উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা"। ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ একই ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন বামপন্থী ছাত্র আবদুল মতিন সহ আরো অনেকে। এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবর্তীতে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে পূর্ব বাংলায়। দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের চরম পরিণতি ঘটে একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২য়। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, অলি আহাদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন-এর উদ্যোগে হাজার ছাত্রের মিলিত মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বেরোলে শুরু হয় পুলিশের গুলি বর্ষণ।

বিশ্বজুড়ে বিপন্ন মাতৃভাষা, আক্রান্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাঃ কিছু তথ্য  ১ম পর্ব

বিশ্বজুড়ে বিপন্ন মাতৃভাষা, আক্রান্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাঃ কিছু তথ্য  ১ম পর্ব

 

সুমন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক 
২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২৩

 

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট:
১৪ ই আগস্ট ১৯৪৭ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু সমস্যা নিরসনের "উদ্দেশ্যে" পাকিস্তান নামক এক নতুন দেশ জন্ম নেয়। ১৫ ই আগস্ট খণ্ডিত চেহারায় স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ। তার মাত্র দুদিন আগে, ১২ই আগস্ট, ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান-এ দমদমের বাসিন্দা এম.এস. আলী নামক এক ব্যক্তি একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে নতুন দেশের রাষ্ট্রভাষা এবং শিক্ষার ভাষা নিয়ে পত্রলেখক তাঁর চিন্তা ও অভিমত ব্যক্ত করেন এই  মর্মে: “Sir, — Pakistan State will consist of five provinces — each of which has a distinct language of its own. Of these Bengali is most advanced, its vocabulary is rich and flexible, compared with it the others are poor languages.
“Urdu, though highly advanced and rich, is not a language of the masses of India or of Pakistan. Its use is confined to the educated north-west Indian Muslims. It should not therefore be made Pakistan’s State language, far less, the medium of instruction in the Pakistan universities. If a foreign language, European or Indian, is thrust upon Pakistan’s provinces, a set of people speaking that language will get the upper hand over others. This will greatly hamper the progress of Pakistan as a whole.
বস্তুতপক্ষে, সংখ্যালঘু সমস্যা দূরীকরণের পরিবর্তে দুটি পৃথক এবং আরো দৃঢ়ভাবে সংখ্যাগুরুবাদী (majoritarian) দেশের জন্ম হয় সাতচল্লিশের আগস্টে। 
পাকিস্তান রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সেই দেশের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে বিস্তর তর্কবিতর্ক শুরু হয়। ২৯ শে জুলাই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি পেশ করেন।
আব্দুল হক তার 'ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি' প্রবন্ধে লেখেন, "১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষনার সময় ভাবি পূর্ববঙ্গ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত লেখক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিরাট অংশই ছিলেন কলকাতায়। পাকিস্তানের সমর্থক সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রপত্রিকায় এবং বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত লেখক ও সাংবাদিকরাও ছিলেন ওই মহানগরীতে। বামপন্থী মুসলিম তরুণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী নেতৃস্থানীয় অংশ ছিলেন সেখানেই। … মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘোষণার পরে-পরেই আসন্ন পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যা তাঁদের দৈনন্দিন উত্তেজনাময় আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এসব আলোচনার একটা প্রধান বিষয় ছিল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন; কেননা ইতিমধ্যেই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চলছে। সচেতন লেখক বৃন্দ তখনই এ প্রয়াসের বিরোধিতা করার এবং বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নিয়েছিলেন।" 
এরপর ২১ মার্চ ১৯৪৮ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ-র ঘোষণা, "উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা"। ২৪ শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ একই ঘোষণা করলে তীব্র প্রতিবাদ করে ওঠেন বামপন্থী ছাত্র আবদুল মতিন সহ আরো অনেকে। এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। ১৯৪৮ এর ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবর্তীতে একের পর এক আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে পূর্ব বাংলায়। দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের চরম পরিণতি ঘটে একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২য়। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, অলি আহাদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আব্দুল মতিন-এর উদ্যোগে হাজার ছাত্রের মিলিত মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বেরোলে শুরু হয় পুলিশের গুলি বর্ষণ। শহীদ হন আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদ এবং আব্দুস সালাম। দেশজুড়ে শুরু হয় তীব্র বিক্ষোভ। এরই পরিণতিতে মুক্তি সংগ্রাম, স্বাধীনতা এবং পরিশেষে শেখ মুজিবের ঘোষণা, বাংলাই হবে নতুন দেশের রাষ্ট্রভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম। মাতৃভাষার জন্য এই সংগ্রামকে কুর্নিশ জানিয়ে ১৭ ই নভেম্বর ১৯৯৯ রাষ্ট্রসংঘ একুশে ফেব্রুয়ারির তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

UNESCO-র মাতৃভাষা দিবসের থিম:
বিশ্বব্যাপী আজ আক্রান্ত মাতৃভাষা, বিশেষতঃ দেশীয় ভাষাগুলি। পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা আজও থেকে গেছে। পাঠ্যক্রম থেকে শুরু করে পাঠ দানের ভাষা – সর্বত্র পড়েছে বিশ্বায়নের প্রভাব। বেড়েছে কেন্দ্রিকতা, যার প্রভাব পড়েছে মাতৃভাষা শিক্ষার উপর। এর ফলে শুধুমাত্র যে ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনাই ব্যাহত হবে তা নয়। তাদের সামাজিক মানসিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে এই প্রবণতা। বিপন্ন হবে দেশীয় ভাষাগুলি। তাই UNESCO ২০২২ থেকে বর্তমান দশকটিকে International Decade of Indigenous Languages হিসেবে ঘোষণা করেছে। এবছর তাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিষয় (Theme): "Multilingual Education – A Necessity to Transform Education"। তাদের উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে জোরালো প্রচার সংঘটিত করা যাতে করে বিভিন্ন দেশে বহু ভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি শিশুর মাতৃভাষায় পাঠের পরিসর তৈরি হয়। তাদের লক্ষ্য বহুভাষায় শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে শৈশব এবং তারও পরে প্রতিটি ছাত্রের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং যে ভাষা গুলি বিশ্ব মানচিত্র থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বা বিলুপ্তির মুখোমুখি সেই সমস্ত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করা।

 

 

বিশ্বজুড়ে কত ভাষা?
ভাষা সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা Ethnologue-র সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী জীবন্ত ভাষার সংখ্যা অর্থাৎ যে ভাষায় মানুষ কথা বলেন তার সংখ্যা ৭১৫১। এর মধ্যে মাত্র ২০০ টি ভাষা পৃথিবীর প্রায় ৮৮ শতাংশ মানুষের কথ্যভাষা। সবচেয়ে বেশি (১৫০ কোটি) মানুষ কথা বলেন ইংরেজি ভাষায়। দ্বিতীয় স্থানে ম্যান্ডারিন চাইনিজ সে ভাষায় কথা বলেন ১১০ কোটি মানুষ। ৬০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা হিন্দি তৃতীয় স্থানে। বাংলায় কথা বলেন ২৭ কোটি মানুষ। সংখ্যার নিরিখে বাংলা সারা বিশ্বে সপ্তম স্থানে অবস্থান করছে।
মাত্র কোটিরও রকম জনসংখ্যার দেশ পাপুয়া নিউগিনিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীবন্ত ভাষার অবস্থান (৮৪০)। গোটা ইউরোপ মহাদেশে যত ভাষা ব্যবহৃত হয় তার দ্বিগুণ রয়েছে পাপুয়া নিউগিনিতে। পার্শ্ববর্তী দেশ ইন্দোনেশিয়াও (দ্বিতীয়) পিছিয়ে নেই। সেখানে জীবন্ত দেশীয় ভাষার সংখ্যা ৭১৫। ভাষার সংখ্যায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত বর্ষ (৪৫৬)। পঞ্চম স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (৩৩৭)।

(বাকি অংশ পরের পোষ্টে)

 

Your Opinion

We hate spam as much as you do