ঔনিবেশিক ভারত, দাঙ্গাবিধ্বস্ত ভারত, বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারত,স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত -- ইতিহাস বলছে এই সমস্ত সময়ে সবথেকে পশ্চাদপদতা, অবজ্ঞা, নির্যাতন, অশিক্ষার শিকার মেয়েরা। ভাবুন না, মহাভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে গৃহযুদ্ধ রদ করতে কেবলমাত্র অর্জুনের দ্বারা লব্ধ দ্রৌপদীকে কিভাবে পঞ্চস্বামীভোগ্যা করে তুলেছিল তার শাশুড়ী মাতা কুন্তীর একটিমাত্র বাক্য! একটা লংজাম্প কাটে চলে আসুন বাংলা টেলিভিশনে প্রদর্শিত সন্ধ্যাকালীন বিনোদনী উপাখ্যানমালায় -- 'শ্রীময়ী', 'মেয়েবেলা', 'মিঠাই', 'অনুরাগের ছোঁয়া', ইত্যাদি প্রত্যেকটি কাহিনীতে মেয়েদের সহিষ্ণুতা, নির্বিরোধী
পুরুষ নয়, নিপাত যাক পুরুষতন্ত্র..
অধ্যাপিকা মল্লিকা রায় সাহা
৮ই মার্চ ২০২৩
মহাভারতে সভাপর্বের যুগান্তকারী কলঙ্কিত অধ্যায় শুধু নয়, আপনার সমস্ত বৈদূর্য দিয়েও নিজের অধিকার, সম্মান, আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থতা প্রায় অধরাই থেকে গিয়েছিল যাজ্ঞসেনীর -- কতটা কষ্ট পেলে, নি:স্ব হলে প্রেমিক দয়িত স্বামী অর্জুন পরজন্মে আর যেন তার পতি না হয়, সেই খেদোক্তি নি:সৃত হয় মৃত্যুপথযাত্রী দ্রৌপদীর মুখ থেকে.... আমরা বলি কৃষ্ণার এ কষ্ট তার যুগের কষ্ট! আর জানকী? জনকনন্দিনী দুখিনী শ্রীরামপত্নী অভিমানিনী সীতা! মৃত্তিকাগর্ভে লীন করে নিয়েছেন আপনাকে, জানা আমাদের। আগুন আর মাটি অর্থাৎ তেজস্বিনী ও ধৈর্যশালিনী এই দুই আইকন নারী ভারতবর্ষীয় সমাজপ্রত্যাখ্যানের যে পরম্পরায় গেঁথে আছেন, যুগ যুগান্তরের লালিত পুরুষতন্ত্রই আছে তার মূলে। ইতিহাস এরপর থেকে যে প্রবণতা দেখিয়েছে আমাদের, তার নানা বাঁকবদল হলেও সমাজের চক্ষু উন্মীলন হল কোথায়! নারীর বস্ত্রহরণের কদর্যতায় আত্মদর্পী পুরুষের উল্লাসে যে দেশের ঐতিহ্য রচিত হয় আজ রক্তবীজের মত তা সমাজের শিরায় শিরায় ঢুকে যাচ্ছে না তো? নাহলে প্রেমিকা শুধু উপভোগের সঙ্গিনী নয়, স্ত্রী হয়ে থাকার সামাজিকতাটা চেয়েছিল বলে তাকে খুন করে, ৫০/৬০ টুকরোয় কেটে, প্রেমিকপুরুষ তার অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা বুনে দেয় মেয়েটির প্রতি? শুধু ঔপনিবেশিকতা বা পুরুষতন্ত্রের আঁধারাচ্ছন্নতাই নয়, আরও এক ভয়াবহ অপরাধমননের ব্যাধি নতুনতর সঙ্কটের আকারে আমাদের আশেপাশেই সরীসৃপের নি:শব্দ চলনে অচেনা নিষ্ঠুরতার ভাষ্য তৈরি করার চেষ্টা করছে। আশঙ্কা টা এখানে।
ঔনিবেশিক ভারত, দাঙ্গাবিধ্বস্ত ভারত, বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারত,স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত -- ইতিহাস বলছে এই সমস্ত সময়ে সবথেকে পশ্চাদপদতা, অবজ্ঞা, নির্যাতন, অশিক্ষার শিকার মেয়েরা। ভাবুন না, মহাভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে গৃহযুদ্ধ রদ করতে কেবলমাত্র অর্জুনের দ্বারা লব্ধ দ্রৌপদীকে কিভাবে পঞ্চস্বামীভোগ্যা করে তুলেছিল তার শাশুড়ী মাতা কুন্তীর একটিমাত্র বাক্য! একটা লংজাম্প কাটে চলে আসুন বাংলা টেলিভিশনে প্রদর্শিত সন্ধ্যাকালীন বিনোদনী উপাখ্যানমালায় -- 'শ্রীময়ী', 'মেয়েবেলা', 'মিঠাই', 'অনুরাগের ছোঁয়া', ইত্যাদি প্রত্যেকটি কাহিনীতে মেয়েদের সহিষ্ণুতা, নির্বিরোধী
কোমলচেতনায় স্থাপন করা হয়েছে। অভিনবত্বটা সেখানে যেখানে চতুর উপস্থাপনায় পুরুষ চরিত্রগুলির মাহাত্ম্য, দর্শকের কারুণ্যবর্ষিত অনুভবে স্বীকৃত হতে চেয়েছে। মেয়েদের জায়গা, তাদের আদর্শ আচরণ কী হওয়া উচিৎ আর পুরুষের জায়গাটাই বা কোথায় তা সুকৌশলে দর্শকের চেতনায় গেঁথে দেওয়ার অভিযান অব্যাহত চলেছে। এরই মধ্যে আমরা সাড়ম্বরে পালন করেছি বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী, আলোচনা করেছি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই মনীষীর পৌরুষদৃপ্ত প্রতিবাদের কর্মকান্ড নিয়ে ; কিন্তু আমাদের মন কোন পথে চলতে চায়, চেয়েছে, চাইবে? মেয়েরা হল গিয়ে মায়ের জাত, সব সইবে, আর বিরোধিতার তেজ দেখালে সমাজ তার দায়িত্ব নেবে না । কেন নেবে? চুপ করে থাকতে পারো না?
বলছিলাম না আরও এক নিহিত ভয় শ্বাপদের মত নি: শব্দ সঞ্চারে সমাজের অলিন্দে ঘাপটি মেরে আছে? দুটো জিনিস কে এক করতে চাইছি --- একদিকে সমাজমনকে ছদ্ম আদর্শের মনভেজানো সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভে ঘুমিয়ে থাকা প্রবণতাগুলো উস্কে দাও অন্যদিকে ধান্দার ধনতন্ত্রের বিকট অর্থনৈতিক অসাম্য ভুলে থাকতে নিষ্ঠুর ভয়ের ভাষ্য রচনা করো আর তার সঙ্গে ধর্মীয় বিভাজন, দলিত নিধন আর নারীনিধনের সংক্রমণ অনুষঙ্গ অমোঘভাবে লেপ্টে দাও।
লিঙ্গবিভাজনের বস্তাপচা রাজনীতির বিরোধিতায় আজ তাই নারীর আলোকায়ন তথা ঊর্ধায়নের অগ্নিশিখা জ্বালানো তখনই সম্ভব যখন এই ভন্ড সময়ের ছদ্ম সংস্কৃতি আর নিষ্ঠুর অবদমনের তীব্র কুটিল রাজনীতিকে ধ্বংস করার সংগ্রাম সূচিত হবে, যে লড়াইয়ে আর পৃথক ভাবে নারীদিবস পালনের প্রয়োজন হবেনা।।
We hate spam as much as you do