নির্বাচনী পূর্বাভাস বলে যা তুলে ধরা হচ্ছে তাকে অবশ্য বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বরং গোঁজামিলভিত্তিক জ্যোতিষ গণনা পদ্ধতির সঙ্গেই এই মিল তুলনামূলক বেশি।
ভোটের পূর্বাভাস: বিজ্ঞান কম, জ্যোতিষ বেশি
ভোটের দামামা বাজার পর থেকেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ফলাফলের ‘জ্যোতিষ গণনা’ শুরু হয়ে গিয়েছে। অবশ্য ওই সংবাদমাধ্যমগুলি এই পূর্বাভাসকে জনমত সমীক্ষা বলেই তুলে ধরেন। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মত এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক সমীক্ষা এবং জ্যোতিষ গণনার কিছু মূলগত তফাত থাকে। নির্বাচনী পূর্বাভাস বলে যা তুলে ধরা হচ্ছে তাকে অবশ্য বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা বলা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বরং গোঁজামিলভিত্তিক জ্যোতিষ গণনা পদ্ধতির সঙ্গেই এই মিল তুলনামূলক বেশি।
ভোটের বিশ্লেষণ এবং তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণকে একটি নির্দিষ্ট নাম দেওয়া আছে। সেফোলজি। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই বিষয়টির চর্চা বহু মানুষ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই দক্ষতা এবং বিশ্লেষণপদ্ধতি গুণীজন মহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সেখানে কে বিশ্লেষণ করছেন, কী ভাবে বিশ্লেষণ করছেন, সে সবই সামনে থাকত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই বিষয়টিকে একটি ব্যবসার স্তরে নিয়ে আসা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, বিদ্যাচর্চা যদি ব্যবসার স্তরে নামে তা হলে তার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কারণ, চিরাচরিত নিয়ম মেনেই ব্যবসার সঙ্গে লাভ-ক্ষতির সম্পর্ক বিদ্যমান।
এ বারে চলে আসি, নির্বাচনী পূর্বাভাসের প্রসঙ্গে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সুসজ্জিত, চাটুকার মানসিকতাসম্পন্ন সংবাদ পরিবেশক বড় স্ক্রিনে কিছু ব্যবসাভিত্তিক বিশ্লেষক সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট তুলে ধরেন এবং নির্বাচনী পূর্বাভাস ঘোষণা করেন। লেখার শুরুতেই বলে ছিলাম, ‘জ্যোতিষ গণনার’ কথা। সেই গণনার সঙ্গে এই বিশ্লেষণের অদ্ভূত মিল। যে কোনও স্বাভাবিক বোধবুদ্ধির মানুষমাত্রেই জানেন, মানুষের মন বোঝা ভার। তার মধ্যে থেকে নির্বাচনের মতো সংবেদনশীল বিষয়ের আভাস পেতে হলে একটি বিরাট পরিমাণ নমুনা সংগ্রহ দরকার। এ বার প্রশ্ন ওঠে, এই যে সমীক্ষা রিপোর্ট করা হয় তার নমুনার পরিমাণ কী? দ্বিতীয়ত, নমুনারা কারা? অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জনগোষ্ঠীভিত্তিক, এই কোন কোন গোত্রভুক্ত নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে? প্রথম প্রশ্নের যদিও বা বুড়িছোঁয়া উত্তর থাকে, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর মেলে না। যেহেতু নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষের নানাবিধ চাওয়া-পাওয়া, দাবি-দাওয়ার হিসেব থাকে তাই কাকে ভোট দেবেন সেটা অন্যতম বিচার্য বিষয়। ফলে প্রশ্ন ওঠে, এখানে কি র্যান্ডম স্যাম্পেল নেওয়া হয়েছে নাকি নমুনা সংগ্রহের আগে বিভিন্ন গোত্রে ভাগ করা হয়েছে? তার উত্তর কিন্তু অজানা।
নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তার ভৌগোলিক বিস্তার কতটা? কলকাতার নাড়ি টিপে কি পুরুলিয়ার জ্বর মাপার চেষ্টা হয়েছে? মধ্য ত্রিশ পেরিয়ে গিয়েছে আমার। প্রায় আঠেরো বছর ধরে ভোট দিচ্ছি। এ পর্যন্ত কোনও ভোটেই কোনও সংস্থার সমীক্ষকেরা আমাকে প্রশ্ন করেননি। আমার চারপাশে পরিচিত মানুষের সংখ্যাও কম নয়। তাঁদের কাউকে সমীক্ষকেরা প্রশ্ন করেছেন এমনটাও নয়। যদি বিধানসভা ক্ষেত্রের হিসেবে দেখি, তা হলে গত ১৮ বছরে এক বারও কি আমাদের সমীক্ষকের মুখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল না? কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, কেউ কোনও দিন জানতে চায়নি। এ-ও প্রশ্ন ওঠে, কারা নমুনা সংগ্রহ করেন? তাঁরা কি আদৌ পথেঘাটে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে সমীক্ষা করেন?
অনেকেই বলতে পারেন, গত কয়েক বছরে এই ধরনের পূর্বাভাস মিলতে দেখা গিয়েছে। ঠিক। দেখা গিয়েছে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে এটাও বলতে হবে, বাজারে কতগুলি সমীক্ষা সংস্থার রিপোর্ট বেরিয়েছিল এবং কটি সংস্থার রিপোর্ট কাছাকাছি ভাবে মিলেছে। আমরা যদি এ বছর বিধানসভায় এবিপি-আনন্দ প্রকাশিত পূর্বাভাস দেখি, তা হলে দেখব, ভোট যত এগিয়েছে তত রিপোর্ট বদলেছে। পূর্বাভাস বদলাতেই পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টিকে গতিমান বা ডায়নামিক হতে হবে। একইসঙ্গে যে যে পরিপ্রেক্ষিতে বা প্যারামিটারে পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, সেগুলিকেও দ্রুত পরিবর্তনশীল হতে হবে। এ ক্ষেত্রে গত তিন মাসে এমন কী পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তন হয়েছে যা পূর্বাভাসকে বদলে দিতে পারে? এক জন সাধারণ ভোটার হিসেবে কিছু নেতার ‘অসভ্যতা’ বৃদ্ধি, বারবার হেলিকপ্টারে চেপে উড়ে বেড়ানো ছাড়া কোনও বদল চোখে পড়েনি। পূর্বাভাসে বিজেপির আসন সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দামবৃদ্ধি-সহ যা যা উপদ্রব ক্রমাগত বাড়ছে তাতে পরিপ্রেক্ষিতের বিচারে আসন ও ভোট কমার কথা। তা হলে আসন পূর্বাভাসে বাড়ল কী করে? তার ব্যাখ্যা কিন্তু রিপোর্টে অমিল।
আসলে সবই এক টিআরপির খেলা। যদি চটকদারি না থাকে, আচমকা ভেল্কিবাজি না থাকে, তা হলে দর্শকদের মনোরঞ্জন হবে না। কিন্তু একইসঙ্গে পরিসংখ্যানের কারসাজি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করাও অনৈতিক। এর পর থেকে যখনই ভোটের জ্যোতিষভিত্তিক পূর্বাভাস দেখবেন এই কথাগুলি মাথায় রাখবেন।
লেখকের বক্তব্য নিজস্ব
We hate spam as much as you do