দুজনই তাদের (নিজ নিজ) প্রসঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে চিহ্নিত করে আক্রমণ করেছেন—মামদানি স্থানীয় কর্পোরেট-রাজনৈতিক জোট এবং ইসলামোফোবিয়াকে, রাহুল গান্ধী জাতীয় স্তরের ক্রোনি ক্যাপিটালিজম এবং একটি শক্তিশালী নির্বাচনী যন্ত্রকে। মামদানি ইসলামোফোবিয়ার মতো সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়েছেন, রাহুল লড়ছেন বর্ণভিত্তিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক লুটেরার বিরুদ্ধে। দুজনই মুফের বহুমাত্রিক 'জনগণ'-এর ধারণাকে সক্রিয় করেছেন। দুজনেরই 'অন্য' পক্ষ খুবই স্পষ্ট এবং মূর্ত—মামদানির ক্ষেত্রে যা স্থানীয় ক্ষমতার কাঠামো ও ইহুদিবাদী লবি, রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে সেটাই আদানি গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও আরএসএস।
'বাম জনবাদীতা'র জোয়ার: ইসলামোফোবিয়া থেকে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন সময়
অত্রি ভট্টাচার্য্য
৫ নভেম্বর ২০২৫
গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ব রাজনীতিতে দুটি ঘটনা আলাদাভাবে আলোচনায় এসেছে। একদিকে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জোহরা মামদানির অপ্রতিরোধ্য জয়, অন্যদিকে ভারতের নির্বাচনে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ও বিরোধী জোটের শক্তিশালী উপস্থিতি। ভৌগলিক দূরত্ব ও প্রসঙ্গগত পার্থক্য থাকলেও, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক চ্যান্টাল মুফের 'বাম জনবাদ'-এর আলোকে দেখলে দুটির মধ্যেই একটি মিলনরেখা খুঁজে পাওয়া যায়। দুটি ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী, বহুত্ববাদী এবং 'জনগণ বনাম ক্ষমতাশীল অভিজাত'-এর (এক ধরনের দ্বন্দ্ব) গড়ে তোলার কৌশল কার্যকর হয়েছে, যার কেন্দ্রে ছিল মূর্ত ও জীবন-ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ইস্যু, প্রতিষ্ঠিত শক্তির দ্বারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত কুৎসা ও শোষণের বিরুদ্ধে সরাসরি মুখোমুখি হওয়ার কৌশল।
উত্তর - মার্কসবাদী তাত্ত্বিক চ্যান্টাল মুফের মতে,রাজনীতি মৌলিকভাবে 'আমি বনাম অন্য'-এর দ্বন্দ্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মতে, লিবারেল ডেমোক্রেসি 'কনসেনসাস' বা সর্বসম্মতির নামে এই দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে, যা শেষ পর্যন্ত ডানপন্থী পপুলিস্টদের জন্য জায়গা তৈরি করে দেয়। তাঁর প্রস্তাবিত 'বাম জনতাবাদ'-এর কৌশল হলো একটি বিস্তৃত, অন্তর্ভুক্তিমূলক 'জনগণ'কে গড়ে তোলা, যারা 'ক্ষমতাশীল অভিজাত'-দের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এই 'জনগণ'-এর সংহতি গড়ে উঠবে আনুভূমিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক দাবির ভিত্তিতে এবং ক্ষমতাশীলদের দ্বারা পরিচালিত নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মাধ্যমে।
জোহরান মামদানির জয় হল মুফের বাম জনবাদের একটি প্রায়োগিক পাঠ। তিনি তাঁর 'জনগণ'-কে সংজ্ঞায়িত করেছেন বহুসংস্কৃতির মানুষের, শ্রমজীবীর, জায়নবাদ বিরোধীর, এবং—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—সবার জন্য সার্বজনীন শিশু যত্ন (Universal Child Care) এবং সাশ্রয়ী বাসস্থানের দাবিদার একটি জোট হিসেবে।
ইকুইটি ল্যাব (Equity Lab) এবং সিএসওএইচ (CSOH) এর মতো সংস্থার প্রতিবেদনে মামদানির প্রচারণার সময় ব্যাপক ইসলামোফোবিক এবং বর্ণবাদী বিরোধিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই না, একজন মুসলমান হিসেবে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনি অধিকারের একজন স্পষ্টভাষী সমর্থক হিসেবে, লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। মামদানি সরাসরিভাবে এই ইসলামোফোবিয়ার মোকাবেলা করেছেন এবং এটি তাঁর প্রচারণাকে দমিয়ে দিতে পারেনি, বরং তাঁর সমর্থনকে শক্তিশালী করেছে। এটি মুফের তত্ত্বের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে 'জনগণ'-এর মধ্যে শুধু অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিতরাই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে নিপীড়িতরাও অন্তর্ভুক্ত থাকে, এবং তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্বেষের মুখোমুখি হওয়াও রাজনীতির একটি অঙ্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতের নির্বাচনে রাহুল গান্ধী ও ইন্ডিয়া জোট একটি বিশাল 'বাম জনবাদী' জোট গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। যার প্রতিফলন বর্তমানে বিহার নির্বাচনেও তা অটুট রয়েছে। একদিকে বর্ণগত জনগণনার (Caste Census) এর দাবি, যা মুফের বহুত্ববাদী জোট গড়ে তোলার কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ থেকেছে। অন্যদিকে 'ভোট চোরি' (ভোট চুরি) এক্সপোজের মধ্যে দিয়ে এই 'ভোটের চুরি'-র অভিযোগকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানবিরোধী Narrative হিসেবে ভোটার অধিকার যাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে।
এবং এখানে তৃতীয় শক্তিশালী স্তম্ভ হিসাবে যুক্ত হয়েছে : আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের অভিযোগ। রাহুল গান্ধী নির্বাচনী প্রচারে একাধিকবার গৌতম আদানির ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি তুলে ধরছেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, দেশের সম্পদ 'একটি নির্দিষ্ট পরিবার ও তার cronies (আশ্রিতদের)' হাতে কুক্ষিগত হচ্ছে, এবং এটাই হল আধুনিক ভারতের 'লুটেরা' পুঁজিবাদের চিত্র। 'আদানি' এবং 'ক্রোনি ক্যাপিটালিজম' বিরোধী জোটের রাজনৈতিক বক্তব্যের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠছে। এটি 'জনগণ বনাম ক্ষমতাশীল অভিজাত'-এর দ্বন্দ্বকে একটি অত্যন্ত মূর্ত ও জনপ্রিয় রূপ দিচ্ছে, যেখানে 'অভিজাত' বলতে বোঝানো হচ্ছে একটি ক্ষুদ্র, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অভিজাততন্ত্রকে।
দুজনই তাদের (নিজ নিজ) প্রসঙ্গে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুকে চিহ্নিত করে আক্রমণ করেছেন—মামদানি স্থানীয় কর্পোরেট-রাজনৈতিক জোট এবং ইসলামোফোবিয়াকে, রাহুল গান্ধী জাতীয় স্তরের ক্রোনি ক্যাপিটালিজম এবং একটি শক্তিশালী নির্বাচনী যন্ত্রকে। মামদানি ইসলামোফোবিয়ার মতো সাংস্কৃতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়েছেন, রাহুল লড়ছেন বর্ণভিত্তিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক লুটেরার বিরুদ্ধে। দুজনই মুফের বহুমাত্রিক 'জনগণ'-এর ধারণাকে সক্রিয় করেছেন। দুজনেরই 'অন্য' পক্ষ খুবই স্পষ্ট এবং মূর্ত—মামদানির ক্ষেত্রে যা স্থানীয় ক্ষমতার কাঠামো ও ইহুদিবাদী লবি, রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে সেটাই আদানি গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও আরএসএস।
তবে মামদানিকে মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রধানত বাহ্যিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত ইসলামোফোবিয়া এবং স্থানীয় অর্থনৈতিক সমস্যার। রাহুল গান্ধীকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সমস্যা—বর্ণভিত্তিক বৈষম্য এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের সঙ্গে।
জোহরান মামদানি এবং রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক উত্থান দেখিয়ে দেয় যে, সমসাময়িক বাম জনবাদী কৌশলকে অবশ্যই অর্থনৈতিক ন্যায়ের দাবিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ন্যায়ের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে মামদানির লড়াই এবং আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাহুল গান্ধীর 'ক্রোনি ক্যাপিটালিজম'-এর অভিযোগ—দুইই চ্যান্টাল মুফের ভাবকাঠামোতে উপস্থিত 'জনগণ'-এর সংহতিকে শক্তিশালী করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। তারা প্রতিষ্ঠিত শক্তি কর্তৃক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর প্রয়োগ করা নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণ—দুইয়েরই বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এই নয়া রাজনৈতিক গঠন এই বার্তাই দেয় যে, ভবিষ্যতের বাম জনবাদী আন্দোলনগুলিকে অবশ্যই 'জনগণ বনাম অভিজাত'-এর দ্বন্দ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক—সব কটি মাত্রাতেই সক্রিয় হতে হবে।
We hate spam as much as you do