...সোমেন চন্দের ' বন্যা' তে শ্রেণীসচেতনতা
সোমেন চন্দ ( ১৯২০, ২৪ শে মে -- ১৯৪২, ৮ ই মার্চ)
তাঁর সৃষ্টির প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন শ্রেণীচেতনার তীব্র অথচ শান্ত , কিন্তু সংকল্পে স্থির, দৃঢ় গম্ভীর বাস্তব বোধ কে।বাংলা সাহিত্যে শ্রমিক - কৃষক - মেহনতী জনতা এবং কি বুদ্ধিশ্রমিকদের ,' সকল দ্বন্দ বিরোধ মাঝে জাগ্রহ যে ভালো' সেই ভালোর সন্ধানেই নিজের জীবন, রাজনৈতিক গতিময়তায় নিজের জীবন আর সৃষ্টিকে তিনি গেঁথেছিলেন।মদনমোহন তর্কালঙ্কার থেকে মীর মোশারফ হোসেন হয়ে রবীন্দ্রনাথ, সকলের ই সৃষ্টিতে শ্রেণী সচেতনতা এসেছে তাঁরা যে শ্রেণীতে অবস্থান করেন, সেই শ্রেণীর অবস্থানের বাস্তবতার নিগড়ে।বঙ্কিম থেকে বিদ্যাসাগর, ফয়জুন্নেসা থেকে রোকেয়া-- এঁরা সকলেই পরম মানবপ্রেমী হয়েও নিজেদের শ্রেণী অবস্থান ঘিরে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।কাজী আবদুল ওদুদের মতো মুক্তবুদ্ধির উপাসক ' মীর পরিবার' বা ' নদী বক্ষে' সমাজের নীচতলার মানুষদের অত্যন্ত মরমী মন নিয়ে ঠাঁই দিলেও ' শ্রেণী' র প্রশ্নে তাঁরা নিজেদের অবস্থান থেকে কখনো বিশেষ সরে আসেন নি।
এই দিক থেকে নজরুল , মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষ, যাঁরা বাংলা সাহিত্যে কেবল শ্রমিক , কৃষককে নিজেদের শ্রেণী চেতনার নিগড়েই স্থান দেন নি, শ্রেণী দ্বন্দের ভিতর দিয়ে, শ্রেণী সংগ্রামকে প্রসারিত করে, শ্রেণী শোষণের অবসানের লক্ষ্যে নিজেদের মেধা আর কলম কে পরিচালিত করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হওয়ার স্পর্ধা রাখে সোমেন চন্দের নাম।
স্পেনের ফ্যাসিস্ট ফ্রাঙ্কোর বিরুদ্ধে লড়াই করে ফ্যাসিস্টদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল।তাঁর রক্তে স্পেনের জারামা নদীর নীল জল রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। জন কনফোর্ডের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল কর্ডোভার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য , তেমন ই ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আর এস পির র সেই সময়ের উগ্র জাতীয়তাবাদ, যা কেবল ফ্যাসিস্টদের সঙ্গেই সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না, ছিল আজকের রাজনৈতিক হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গির ও খুব কাছের, তাদের হাতে শহিদ হয়েছিলেন সোমেন।তাঁর শহিদত্ববরণ বাংলার লেখকসমাজকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল, তা ভারতীয় উপমহাদেশে র সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।
সময়- সমাজ- সভ্যতা আর ইতিহাসবোধের সংমিশ্রণে সোমেন যে ভাবে তাঁর শ্রেণীচেতনার বোধকে প্রসারিত করেছিলেন, সেটিই তাঁর কলম কে অনন্যতা দান করেছিল।ঢাকা রেডিও থেকে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান গুলিতে সোমেনের আলোচনার স্মৃতিচারণ করে পরবর্তী কালে তাঁর সহযোদ্ধা রণেশ দাশগুপ্ত এই নিবন্ধকার কে বলেছিলেন; ১৯৩৮ সালের ভিতরে, সোমেন আঠারো বছর বয়সেই নিজেদের পড়াশুনার ব্যাপ্তি কে যেভাবে প্রসারিত করেছিলেন, ভাবতে পারা যায় না।এলিয়ট , অডেন, স্টিফেন স্পেন্ডার, ভার্জিনিয়া উলফ , হাক্সলি, ই এম ফষ্ট্মার, হেমিংওয়ে, গোর্কি, আদ্রে জাদ, রালফ ফক্স, ক্রিস্টোফার কডওয়েল, আপটন সিনক্লোয়ার , কিংবা মার্কসের 'দাস ক্যাপিটালে'র সঙ্গে যোসেফ ম্যাজিনির ' Dulites of Man' - এসবের একটা আশ্চর্য সমন্বয় তিনি করেছিলেন।
সৃজনকর্মের উষালগ্ন থেকেই শোষিত মানুষ জনের আপসহীন সংগ্রামের ভিতর থেকেই সৃজনশীলতার উয়সরণ ছিল সোমেনের জীবনধর্ম।সৃষ্টিকেও তিনি ব্যাপৃত করেছিলেন, শ্রমিক- কৃষক- মেহনতী জনতার বিজয় বৈজয়ন্তিকে আকাশে মেলে ধরতেই।এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, শোষাত বঞ্চিতের সংগ্রামকে কখনো আপোষের বেড়াজালে বাঁধবার কথা স্বপ্নেও সোমেন ভাবতে পারেন নি।এই দিক থেকে বিচার করে বলতে হয়, একাত্তরের বিপ্লবীবীর শহিদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন্ত প্রেরণা হয়ে সোমেন মুক্তিযোদ্ধের শিরা উপশিরাতেও ছিলেন ভীষণ রকম জীবন্ত।
অবিভক্ত ভারতের, বিশেষ করে বাংলার শ্রেণী বিভাজিত সমাজে সর্বহারার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিকে সবল করতে প্রাথমিক কাজ হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষতা-- এটা সোমেন তাঁর রাজনৈতিক বোধের দ্বারা প্রথম থেকেই খুব গভীর ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।তাই ' বন্যা' (১৩৪৬-৪৭ বঙ্গাব্দের আশেপাশে এই উপন্যাসটি সোমেন লেখেন।সেই সময়ের আগে পরে ' বালিগঞ্জ' নামক একটি পত্রিকায় উপন্যাস টি ছাপা হয়।গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়'৭৫ সালে। শোনা যায় ; পত্রিকায় উপন্যাস টি প্রকাশিত হওয়ার পর সেটি জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে উপন্যাসের দ্বিতীয় খন্ড ও সোমেন লিখেছিলেন।তবে সেটি কখনো ছাপার মুখ দেখে নি।সেটির আর খোঁজ ও পাওয়া যায় না) উপন্যাসে শ্রেণী চেতনার স্বপক্ষে নিজের বোধ কে মেলে ধরা শিল্পীর ই ' দাঙ্গা' গল্পে (' দাঙ্গা ' গল্পটি চারের দশকের একদম শেষ প্রান্তে রচিত। সোমেনের মৃত্যুর পর ' সংকেত ও অন্যান্য গল্পে' এই ' দাঙ্গা' গল্পটি সঙ্কলিত হয়ে প্রকাশিত হয়) যে অসাম্প্রদায়িক মানসলোক উদ্ভাষিত হয়েছে- যা রাজনৈতিক বোধের এক চরম পরাকাষ্ঠা , সেইদিকে আমাদের একটু নজর দেওয়া দরকার।
ধর্মচিন্তার কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক বেড়াজালে সোমেন কখনো আবদ্ধ হন নি।সেই সোমেন ই ' বন্যা' র ' দয়াময়ী ' চরিত্রের ভিতর দিয়ে ধর্মকে ধারণমন্ত্রের এক বোধিস্বত্ত্ব বৃক্ষের রূপদান করেছিলেন।শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি ই ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ও সোমেনের ছিল অন্তরঙ্গ সম্পর্ক।সেই সময়ের আগুনখেকো ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে ছাত্র আন্দোলনে, এক ই সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার সন্মিলন ঘটাতে সোমেনের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার সপ্রশংস উল্লেখ বর্তমান নিবন্ধকার শুনেছেন।
ছাত্র আন্দোলনে বামপন্থী স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা সোমেনের সৃষ্টিতে শ্রেণীচেতনার ভিত প্রস্তুত করেছিল-- বিশ্বনাথ মুখার্জী, সোমেনের উল্লেখে এই কথা সবসময়েই বলতেন।গত শতাব্দীর তিন - চারের দশকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচিন্তার সঙ্কীর্ণতার ক্রমবর্ধমান রাহুগ্রাস থেকে বাংলার ছাত্র সমাজকে , বিশেষ করে তরুণ, যুব সমাজকে একটা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত রক্ষা করেছিল কমিউনিস্ট মতাদর্শ।আর সেই মতাদর্শের আঁতুরঘর হিশেবে ছাত্র ফেডারেশনের ভূমিকা র কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়।দাঙ্গা প্রতিরোধে সোমেন ব্যক্তি অঞমভিজ্ঞতার ফসল ই যে তাঁর 'দাঙ্গা' গল্পটি রচনার উৎসস্রোত তা দ্বিধাহীন কন্ঠে বলতেন রণেশ দাশগুপ্ত। এই নিবন্ধকার কে তিনি বলেছিলেন; সোমেন সহ আমাদের সকলের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্খা তীব্র হয়ে ওঠার সাথে সাথেই এই আশঙ্কাও ক্রমশঃ তীব্র হতে থাকে যে, স্বাধীনতা এলেপরে সাম্প্রদায়িকতার বিষে আমরা নীল হয়ে যাব না তো?
রণেশ দাশগুপ্ত বলেছিলেন; সোমেন খুব উজ্জ্বল ভাবে ' দাঙ্গা' গল্পে রয়েছেন।দাঙ্গার কালে সব বন্ধুবান্ধবদের খোঁজ খবর নেওয়ার তাগিদে প্রাণহাতে করে সাইকেল করে গোটা ঢাকা শহর চোষে বেড়ানোর যে দৃষ্টান্ত সে নিজে স্থাপন করেছিল, সেই ছবি ই যেন ওই গল্পে সাইকেল আরোহির চরিত্রচিত্রণের ভিতর দিয়ে আমরা পাই।
রণেশ দাশগুপ্তের এই কথার সূত্র ধরেই মনেহয়; এই গল্পের মুখ্য চরিত্র ' অশোক' কি সোমেন চন্দই? ' দাঙ্গা' তে সোমেন লিখছেন;
" অশোকের মা খালি মাটিতে ভয়ানক ঘুমুচ্ছিলেন, ছেলের ডাকে ঘুম থেকে উঠে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন,' যা শীগ্ গির, বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা বলছি।একশোবার বলেছি যে, যা বাপু মামাবাড়ী কিছুদিন ঘুরে আয়, মারামারিটা কিছু থামলে পরে আসিস, না তবু এখানে পড়ে থাকা চাই, একটা ছেলেও যদি কথা শোনে! মাটি কামড়ে পড়ে থাকা চাই, শহরের মাটি এমন মিষ্টি, না?' অশোক হেসে বললে,' এত কাজ ফেলে কোথায় যাই বলো?'
-- ' হু, কাজ না ছাই।কাজের আর অন্ত নেই কী না।তোদের কথা শুনবে কে রে? কেউ না।বুঝতে পেরেছি তোদের কতখানি জোর , কেবল মুখেই পট্ পটি, হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা।'
--'জানো কংগ্রেস মিনিস্ট্রির সময় কানপুরে কী হয়েছিল? আমরা দাঙ্গা থামিয়ে দিয়েছিলুম।'
মা দুই হাত তুলে বললেন,' হয়েছে।অমন ঢের বড় বড় কথা শুনেছি।তোদের রাশিয়ার কি হল শুনি? পারবে জার্মানীর সঙ্গে? পারবে?'
অশোক বাইরের দিকে চেয়ে বললে,' পারবে না কেন মা? বিপ্লবের কখনো মরণ হয়।"
অশোকের এই দ্যোতনাই যেন শ্রেণী চিন্তার এক অসীম কাল সাগরে ভেসে ' বন্যা' তে রজতের কন্ঠে উচ্চারিত হয় অসংবদ্ধতার সঙ্গবন্ধচেতনার যুগসন্ধিতে দাঁড়িয়ে এক মহামন্ত্র।যুগসন্ধির মেলবন্ধনকে ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত করবার লক্ষ্যে সোমেন যেমন নিজের জীবন কে প্রবাহিত করেছিলেন, জীবনের সমস্ত বোধকে প্রবাহিত করেছিলেন, ঠিক সেই আঙ্গিকেই পরিচালিত করেছিলেন নিজের সৃষ্টিকেও।সেই সৃষ্টির অভিঘাতে একটি বারের জন্যে ও অভিজ্ঞতার বাইরে আলোপিত কোনো বিষয় কখনোই আমরা দেখতে পাই না।রাজনৈতিক বোধের দ্বারা পরিচালিত জীবনের সুর কে সোমেনের সমসাময়িক মানিক বা তাঁর কিছুটা পরে সমরেশ বসু , কিছুটা হলেও ননী ভৌমিক বা দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।কিন্তু বিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্বে সোমেনের কলম থেকে এই শ্রেণী চেতনার বিকাশ একটা অনন্য নজির হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক পরিমন্ডলেই।
শ্রেণী সংগ্রামকে সৃষ্টির মুখ্য উপজীব্য হিসেবে স্থাপন করা -- এই বৈশিষ্ট্যই কাল থেকে কালোত্তরে সোমেন চন্দের নিজের অনন্যতা কে প্রতিষ্ঠা র ক্ষেত্রে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল।মার্কসীয় বীক্ষায় একজন কর্মী এবং সংগঠকের জীবনবোধে, জীবন দৃষ্টিতে, মৌল বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে ওঠা দরকার -- এই পরিপূর্ণতা ই সোমেনের সমস্ত সৃষ্টিতে খুব সুন্দর ভাবে আমরা দেখতে পাই। সমাজবিজ্ঞানকে মার্কসীয় বীক্ষায় স্ফুরিত করে, সেই চেতনাকে একটা বিশ্ববীক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত করার ভেতর দিয়ে, জগৎ এবং জীবনকে দেখা - এই বৈশিষ্ট্য সোমেনের আগে বাংলা সাহিত্যে ছিল না।জীবনবীক্ষার বিচার বিবেচনার প্রয়োগের ভেতরে একটা শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বকে সবসময়ে ই শিল্প সুষমার ভিতর দিয়ে উপস্থাপিত করা , এই বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে সোমেন যেভাবে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে পরিচালিত করেছিলেন, সমকালীন যুগে মুষ্টিমেয় কয়েকজনের ভেতরেই তেমনটা পাওয়া যায় ।
কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সংযোগ এবং মার্কসীয় দর্শনের প্রতি তাঁর একটা অন্তরের অন্তস্থলৃর ভালবাসা আর বিশ্বাস , এই নিয়ে বস্তুবাদী জীবনকে সৃষ্টির ক্ষেত্রে উদ্ভাসিত করে ,এক গুরুত্বপূর্ণ বীক্ষণ হিশেবে স্থাপন করেছিলেন সোমেন । সামগ্রিক সেই বোধের উদ্ভাসনে ,বস্তুবাদী জীবন সৃষ্টির ভেতর দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর ভূমিকাকে একটা অনন্য সাধারণ ভূমিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল।
বৈশ্বিক মাত্রাকে জীবন দৃষ্টিতে কিভাবে দেখে একজন মার্কসীয় বিজ্ঞানের ছাত্র তথা কর্মী তথা স্রষ্টা , সেইটির ধারক-বাহক হয়ে উঠে, সেই বোধকে তাঁর নিজের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনার জগতে পরিচালিত করবে শ্রেণীসংগ্রামের লক্ষ্যে ,এই বিষয়টি কিন্তু সোমেন চন্দের যাবতীয় সৃষ্টির সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য মতার দাবি করে ।এই দিক থেকে বিচার করে বলতে হয় ; সাম্যবাদী চিন্তার প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত সচেতন এবং পরিপূর্ণতার ভেতর দিয়ে প্রথম নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু সোমেন চন্দ ।গত শতকের চার- পাঁচ- ছয়ের দশকে এই বীক্ষা নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে ।কিন্তু সেই উদ্ভাসনের অনেক আগে, বিশ শতকের তিনের দশকেই সোমেন যেভাবে এই বোধের একটা পরিপূর্ণতা দিয়েছিলেন তা নজিরবিহীন।
চিন্তা-চেতনার স্ফুরণ কে, বিশেষ করে শ্রেণীসংগ্রামের দ্বান্দ্বিক চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য কে বাংলা সাহিত্যে সোমেনের আগে এত সার্থকভাবে, এত পরিপূর্ণভাবে কিন্তু দেখতে পাওয়া যায় না ।এই প্রসঙ্গে রণেশ দাশগুপ্ত অত্যন্ত যথার্থভাবেই বলেছেন; গ্রাম বাংলার মানুষকে সোমেন চন্দ খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন ছোটবেলা থেকেই। ঢাকা শহরে পড়ালেখা করলে ও সোমেন চন্দ ছুটির দিনগুলো কাটিয়েছেন গ্রামে ।সেখানে তিনি দেখেছিলেন গ্রামের সমস্ত স্তরের মানুষকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ।কিন্তু তাঁর' স্বপ্ন 'এবং' গান ' নামক দুটি গল্পে যেসব ছবি এঁকেছেন , তাতে মনে হয় , বাংলার গ্রাম কে তিনি বুঝিবা নখাগ্রে ধারণ করেছিলেন। ১৯৪০ ঢাকা শহরের রেল শ্রমিক সংগঠনের কাজে নামেন একজন কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে, তখন গভীরভাবে অন্তরঙ্গ পরিচয় পেলেন শ্রমিক জীবনের। তিনি দেখলেন শ্রমিকদের মধ্যে তাঁর চেনা গ্রামীণ মানুষের মর্মরূপটিকে যা তখন কৃষি থেকে এসে ঢালাই হতে শুরু করেছে পরিবর্তনের ছ্যাঁচে। ' সংকেত' গল্পটিতে রয়েছে এর পরিচয় ।"( বাংলা ছোটগল্পের সুকান্ত সোমেন চন্দ।আবুল হাসনাত সম্পাদিত ' গণ সাহিত্য' ।১৯৮৭) ।
এই যে কৃষিভিত্তিক সমাজে কৃষির সমস্ত পরিকাঠামো কে বজায় রেখে আধুনিক শিল্পায়নের দিকে হাঁটবার উপক্রম , গত শতাব্দীর তিন এবং চারের দশকের প্রেক্ষাপটে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে যে অদ্ভুত মরমী দৃষ্টিভঙ্গি , সমাজতান্ত্রিক বৃত্ত এবং শ্রেণি চেতনার একটা পরিপূর্ণ আভাস সোমেন চন্দ্র দেখেছিলেন, এবং সেই দেখাকে তিনি একটি সার্থক রূপ দান করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভেতরে, তেমনটা কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের জীবন সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে পরিচালনার একটা ইঙ্গিত হিসেবে দেখা দিয়েছে ।
সেই ইঙ্গিত যেন আমরা পেয়েছি সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে কৃষি এবং শিল্প কেন্দ্রিক যে দ্বন্দ্ব , যে বিরোধ, যে সংঘাত এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কৃষিকে অবহেলা করা ঘিরে বামপন্থীদের সম্পর্কে যে ধরনের অপপ্রচার এবং সেই অপপ্রচারের নিরিখে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা , বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বিবর্তন আর বেকার সমস্যা-- ইত্যাদির নিরিখে শিল্পের যে প্রয়োজনীয়তা, কৃষির যাবতীয় ভিত্তিকে বজায় রেখে তারই ইঙ্গিত , তার সুস্পষ্ট ধারাভাষ্য যেন গত শতকের তিনের দশকের শেষ প্রান্ত থেকে চারের দশকে সূচনার যে সামান্য অংশটুকু সোমেন পেয়েছিলেন, তার ভেতর দিয়ে তিনি এক সার্থকভাবে ইঙ্গিত করে গিয়েছিলেন ।
আগামীর সংকট, আগামীর সংঘাতের একটা ধারাবাহিকতার ভিত্তিকে, যে ধারাবাহিকতার বৃত্তের ভেতর দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক শিক্ষা, রাজনৈতিক সচেতনার ধারা-উপধারা গুলি পরিচালিত হতে পারে তাকে বাঙ্ময় করেছিলেন সোমেন। সমাজবিজ্ঞানের গভীর অনুশীলন ,মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখা এবং শ্রেণী চেতনার ভিত্তিতে মানুষের বিবর্তন , অর্থনৈতিক দিক পরিবর্তন-- এইসব ঘিরে মানুষের যে তৃষ্ণা , সেই তৃষ্ণার প্রতি একটি শ্রদ্ধেয় দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে যে এমন একটা সৃষ্টি, এমন একটা বাস্তবমুখী ধারণা এবং এমন ভবিষ্যতের চিত্র অঙ্কনের একটি আভাস দেওয়া সম্ভব নয় , তা সোমেন চন্দের সামগ্রিক জীবন এবং তাঁর সৃষ্টিকে আণুবীক্ষণিক ভাবে যদি আমরা বিচার- বিশ্লেষণ করি, আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় ।
মাত্র আঠারো বছর বয়সে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা লিখতে গিয়ে সোমেন বলেছিলেন;
গ্রাম্য অভিজ্ঞতা আমার প্রচুর। এমন কি , যা কেন্দ্র করে শরৎচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে অনেকে ই কতগুলো sweet উপন্যাস রচনা করেছেন , বৈষ্ণবদের সেই আখড়ার সাথে ও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত আমি, এতদিন সে- সব সম্বন্ধে কিছু লিখিনি এই ভেবে যে , এসব পুরোনো হয়ে গেছে , এখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার। কিন্তু বছর খানেক সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির কোন পথে খুঁজে পেতাম না , এখন কতকটা পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে ..."( সাহিত্য পত্রিকা- মুহম্মদ মণিরুজ্জামান সম্পাদিত।তিরিশ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা।ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭, পৃ১৪৪) এই আত্মোপলব্ধির কথা সোমেন যখন লিখছি তখন কিন্তু তিনি তাঁর 'বন্যা' উপন্যাস শেষ করে এনেছে
মাত্র আঠারো বছর বয়সে একটি চিঠিতে সোমেন চন্দ লিখছেন;
অর্থনৈতিক পীড়নের দুঃসহ ক্লেশ যাদের মনে সৃষ্টি করেছে কোন প্রচণ্ড ক্ষোভ - যে ক্ষোভ ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির লাভা প্রভাবে এক এক দিন আত্মপ্রকাশ করে- নিমেষের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অসাম্য ও বঞ্চনার অহমিকা , যৌবনের পথনির্দেশ তো তারাই দেবে। আর মানুষের সমাজ গড়ে ওঠবার পর থেকে আজ অবধি প্রায় একই নীতি সর্বদেশে অনুসৃত হয়ে এসেছে। এর ফলে সর্বসাধারণের কল্যাণ হয়ে থাকুক আর নাই থাকুক, একথা অনস্বীকার্য যে লাভ ও সুবিধের কথা বলতে গেলেই আঠারো আনার ই মালিকানা জনকয়েক লোকের হাতে গিয়ে পড়েছে ।আজ বিপ্লবের প্রয়োজন হয়েছে-- যে বিপ্লব দেব আমূল সংস্কার। খুবই ভালো লাগলো , আমি নিজেই অনুভব করছি যেন । আমার এই বিপ্লবের অনুভূতি আমার সাহিত্যসাধনার সর্বাঙ্গে যেন জড়িয়ে থাকে।( নির্মল কুমার ঘোষ কে লেখা সোমেনের চিঠি।মুহম্মদ মণিরুজ্জামান সম্পাদিত পূর্বোল্লিখিত গ্রন্থ) ।
বিপ্লবের এই স্পন্দিত উপলব্ধি কিন্তু সোমেনের সৃষ্টিকে একটা স্বতন্ত্রতা দিয়েছিল ।একটা অনন্যতা দিয়েছিল। জনমানুষের মুক্তিসংগ্রামের অস্ত্র হিসেবে সাহিত্য কিভাবে উঠে আসতে পারে , তার জন্য একটা অনুপম দিকনির্দেশ সৃষ্টির ভেতর দিয়ে সোমেন করে গিয়েছিলেন ।যুদ্ধবিক্ষত আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় সোমেন চন্দের সাহিত্য ভাবনা এটাই ছিল কিন্তু মূল কথা।
শ্রমিক কৃষক মেহনতী মানুষ --সমগ্রভাবে সেই মানুষকে উপলব্ধি করে ,তাঁদের জীবন সংগ্রামকে আত্মস্থ করে, আসন্ন বিপ্লবের জন্য তাঁদের তৈরি করার ব্রত নিয়ে যেন সোমেন শুরু করেছিলেন তাঁর সাহিত্যচর্চা কে ।এই বোধ থেকেই সোমেনের বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ভাবনা যে ; কেবল এভাবেই একজন লেখক হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃত প্রগতিশীল এবং বিপ্লবী সাহিত্যিক।
সোমেন চন্দের কমিউনিস্ট রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল সতীশ পাকড়াশী হাত দিয়ে। সেই সতীশ পাকড়াশী পরবর্তীকালে সোমেন সম্পর্কে লিখেছেন;
মহৎ কর্ম প্রেরণা আত্মদান বৃথা যায় না। বিশ্বমানবের কল্যাণে ইংল্যান্ডের তরুণ বিপ্লবী সাহিত্যিক রালফ ফক্সের আত্মদান গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ।... ঢাকার বুড়িগঙ্গা র তীরে বসে তরুণ-যুবক সোমেনের সাথে এই কথাই হচ্ছিল,... সোমেন জিজ্ঞাসুভরা প্রাণে বলে উঠল ,--সাহিত্যিক ও মরণের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ল ।
আমি বললাম , অত্যাচার যখন চরমে ওঠে, মানবতার বিকাশ যখন রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় , তখন কলম ছেড়ে তরবারি ধরতে হয়-- বুকের রক্তে তখন নতুন সাহিত্য তৈরি হয়।ধন- শোষণ- মদমত্ত ফাসিস্ট বর্বরতার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে কবি ও সাহিত্যিকগণ তাই স্পেনের আন্তর্জাতিক বাহিনীতে ছুটে গিয়েছিলেন। সাহিত্যসাধনায় লাঞ্ছিত গণমানবের মর্মকথা ফুটিয়ে তোলবার যে প্রেরণা, সেই প্রেরণাই লেখকে গণ মানবের মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার শক্তি দিয়েছে। সোমেন চুপ করে শুনে একটু পড়ে বললো , এরাই সত্যিকার সাহিত্যেক। রাত্রিতে আমরা ফিরলাম।সোমেন তার গুটি দুই - তিন লেখক বন্ধুদের নিয়ে নতুন সাহিত্যের কথা বলতে বলতে বাড়ি চলে গেল।"( অগ্নিযুগের কথা- সতীশ পাকড়াশী।নবজাতক সঙ্করণ।১৩৩৮ বঙ্গাব্দ।পৃ-২৫৪-২৫৫)।
বন্ধু অমৃত কুমার দত্ত কে লেখা একটি চিঠিতে সোমেন লিখেছেন;
গত কয়েকদিন রেল শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটু সময় পাই না।তবুও লিখতে হবে মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য , আমাদের লিখতে হবে। ফক্সের বই পড়ে আমি অন্তরের অনুপ্রেরণা পাচ্ছি ।কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে ।এই না হলে কি মহৎ সাহিত্যিক হওয়া যায় ।স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের সমর্থনে তাঁদের আত্মবিসর্জন ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আশার কথা বাংলা সাহিত্যের তরুণ লেখকরা এ দিকে সচেতন হচ্ছে।... বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন ।আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে।গোর্কির কথাই চিন্তা করো।শৌখিন সাহিত্য করার আর সময় সময় নেই।" (ঐ)।
এই ভাবনাই যেন সোমেন কে তাঁর প্রথম কিশোর বেলার সৃষ্টিতে সমাজ সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দুতে শ্রেণি সচেতনতা অভিধারা কে প্রতিষ্ঠা করেছিল। আর সেই প্রাতিষ্ঠানিক অভিপ্সা যেন সোমেনকে পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টির ধারা পরিচালিত করেছিল।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে লেখা একটি উপন্যাসে যে মৌলিকত্বের স্বাদ সোমেন চন্দ উঠিয়ে আনতে পেরেছিলেন , তেমনটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রায় দুর্লভ ।এই সময়কালে লেখা উপন্যাসের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ লেখকের রচনাতেই কোনো না কোনো ছায়া এসে উপস্থিত হয় ।বিশেষ করে বিদেশি উপন্যাস পাঠ প্রতিক্রিয়া র বার্তাগুলি খুব বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে ।
এই প্রসঙ্গে শরৎচন্দ্র তাঁর কিশোর বয়স এই লেখা উপন্যাসে কতখানি মৌলিকত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা ঘিরে কিন্তু সাহিত্য সমালোচকদের ভেতরে বেশ কিছু বিতর্ক আছে ।এদিক থেকে বিচার করে বলতে হয় ১৯৩৭-'৩৮, এই সময়কালে লেখা উপন্যাসের ভেতর দিয়ে মাত্র সতের বছর বয়সে যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন সোমেন, সেই জায়গাটি কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে শুধু নয় ,আমাদের সামাজিক -সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সমাজ-সংস্কৃতি- পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রশ্ন বোধক চিহ্ন যেভাবে' বন্যা ' উপন্যাসের ভেতর দিয়ে তুলে এনে মানুষের চিন্তা-চেতনা নিগরকে শ্রেণি সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছিলেন সোমেন, তেমনটা কিন্তু পরবর্তীকালে লেখকদের ভেতরে খুব স্পষ্টভাবে আমরা পাইনা। গত শতকের তিনের দশকের শুরুতে ১৯৩০- '৩২ সাল, এই পর্রায়ক্রম নাগাদ আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতার রেশ গোটা দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণে গভীর হতাশা তৈরি করেছিল ।আর সেই হতাশাজনিত প্রতিক্রিয়া দেশের সামাজিক -সাংস্কৃতিক, এমনকি আর্থিক প্রেক্ষাপট কেও যেভাবে আকীর্ণ করেছিল , সেই আঙ্গিক কে পটভূমিতে উপস্থাপিত 'বন্যা' উপন্যাসে শ্রেণি সচেতনতা কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সোমেন। সেই প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে সোমেন কিন্তু দেখিয়েছিলেন শ্রেণী সংগ্রামের ভেতর দিয়েই মানুষ তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে ।এর জন্য কোনো রকম অতিলৌকিক উপাচার বা কোনো ধরনের ধর্মীয় কাকুতি, দীর্ঘস্থায়ী কোনো স্পন্দন সমাজের বুকে রাখতে পারেনা। সামাজিক চরিত্রের উপরে রাখতে পারে না।
তিনের দশকের শুরুতে আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা জনিত যে রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির উপর আমাদের একটা হতাশা বোধ জাগ্রত করে তুলেছিল, সেই শূন্যের উপর কিভাবে শ্রেণীসংগ্রামের ই একটি বিশেষ ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে মানবসমাজকে পরিচালিত করতে পারে, মানুষের সুখ-দুঃখের উপস্থাপনাকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারে, সেই টি দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন সোমেন এই ' বন্যা' উপন্যাসে। সোমেনের কিশোর বয়সের মননশীলতার এক অনুপম ক্ষেপনের ভেতর দিয়ে, আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা জনিত সামাজিক পরিবেশ, রাজনৈতিক আন্দোলনের সম্পর্কে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় যে একটা হতাশার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল , সেই হতাশা কাটাতে কি ধরণের বিকল্প উঠে আসছিল, সেই ইঙ্গিত আমরা ' বন্যা' উপন্যাসের ভিতর থেকে পাই।
রাজনৈতিক আন্দোলন কিছু মানুষের একটা অদ্ভুতুড়ে কান্ড কারখানা, আর সেই কাণ্ডকারখানার ফলে মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন ,অর্থাৎ; চাকরি-বাকরি, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আঙ্গিক গুলিতে ধ্বংস করে দিচ্ছে --এই রকম একটা মানসিকতা যখন ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করেছিল ভারতীয় সমাজ, বিশেষ করে বাংলার সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ,সেই রকম একটি জায়গায়, শ্রেণী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে, মানবমুক্তি কিভাবে উচ্চারিত হয়; সোমেন চন্দ কিন্তু তাঁর একমাত্র উপন্যাসে তা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অর্থনৈতিক উপযোগিতার নষ্ট হয়ে যাওয়ার দিক গুলিকে অতিক্রম করে, অর্থনৈতিক উপযোগীতার ভিত্তিতে কিভাবে লড়াইকে সফল করা যায় এবং সেই প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শ্রেণী সংগ্রাম ই একমাত্র উপজীব্য পথ , এটা দেখানোর ভেতর দিয়ে ,শুধু সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রেকাষিত কেই নয় ,শুধু সাহিত্যের পরিমণ্ডল কেই নয়, সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডল এবং তার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রতিষ্ঠিত করবার যে চিন্তা, সেই চিন্তাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন' বন্যা' উপন্যাসের ভেতর দিয়ে।
এই থেকে খুব সহজে বুঝতে পারে গিয়েছিল যে; সাহিত্যে সমাজ বদলের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে উপজীব্য করে তোলবার ক্ষেত্রে ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে শুরু করে সমাজ বিপ্লবের অন্যান্য কারিগরদের সঙ্গে কোথায় সোমেন চন্দৃর সাযুজ্য এবং একটা আন্তরিক সখ্যতা রয়েছে, সেই বিষয় টিকে।
মানুষের জীবনে কোনো রকম হতাশা ই যে কখনো স্থায়ী ক্ষত নির্মাণ করতে পারে না-- সেটা সোমেন চন্দ তাঁর মাত্র সতের বছর বয়সে সৃষ্টির ভেতর দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। শ্রেণীসংগ্রাম ই স্পন্দিত মানব জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তনের একমাত্র হাতিয়ার।তাঁর দয়াময়ী থেকে কিংবা নারায়ণ কিংবা রজত, মালতী, প্রিয়-- এই চরিত্রগুলির ভেতর দিয়ে সোমেন চন্দ উপস্থাপিত করেছেন।গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক বিপর্যয় জনিত একটা ভূমিকাকে আলো হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই আলেখ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে নানা ধরনের ইমেজারি তিনি ব্যবহার করছেন।নানা ধরনের রূপকথার পর্যাক্রম কে তিনি ব্যবহার করছেন।বিভিন্ন ধরনের রূপককে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন । অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত করতে সেগুলিকে টেনেছেন।এই যে আতস কাঁচের মধ্যে ফেলে বিভিন্ন ধরনের বেনিয়াসহকলার, রামধনু ছটার মতো, নানা ধরনের রঙের বিন্যাস দিয়ে সমাজকে ,মানুষকে, পরিবেশকে, পরিস্থিতিকে ,অর্থনীতিকে, রাজনীতিকে, এবং সামগ্রিকভাবে দেশদুনিয়া- বিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করা; এর ভেতর দিয়ে কিন্তু সোমেন চন্দ তুলে আনছেন , শুধু সাহিত্যের একটি অনুপম আগামীর সঙ্কতকেই নয় ।সামগ্রিকভাবে মানবসমাজের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের ইতিহাস কে জাগাচ্ছেন তিনি।
যে সময় কাটায় কাল টা আইন অমান্য আন্দোলনের ব্যর্থতা ঘিরে মানুষের মধ্যে ক্রমশ হতাশা তীব্র হয়ে উঠছে ।মানুষ ভাবতে শুরু করেছে, আন্দোলনের কারণে অনেক ক্ষয়ক্ষতি আমাদের জীবনে ,আমাদের সামগ্রিক চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে হয়েছে ।আর সেই ব্যর্থতা আমাদের আগামী দিনের ক্ষেত্রে খুব বেশি রকমের একটা নেতিবাচক প্রভাবের দিকে ঠেলে দিচ্ছে ।--সেই রকম একটা পরিস্থিতিতে ,হতাশা নয় ,আশার আলো এবং সেই আশাকে ভাষাতে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে, কিভাবে শ্রেণীচিন্তা মানুষকে সচেতন করে তোলে, ' বন্যা' সর্বত্র তার ই ছাপ।
মানুষকে শ্রেণীসংগ্রামের লক্ষ্যে পরিচালিত করে ,সেটাকে বাস্তবের নিরিখে প্রতিষ্ঠিত করে দেখার , এই অদ্ভুত সুন্দর, মায়াবী চোখ সোমেন চন্দ যেভাবে মেলে ধরতে পেরেছিলেন, উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন, তেমনটা কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পরবর্তী বহুকাল ধরে মানুষ পারেননি ।মানুষের সেই হতাশাকে একটা ইতিবাচক, অথচ কেবলমাত্র স্বপ্নীল নয় ,তার মধ্যে বাস্তবতা আছে, লড়াইয়ের মানসিকতা আছে, এবং সেই লড়াই কোন উদ্দেশ্যবিহীন লড়াই নয়-- একটা শ্রেণীসংগ্রামের আদর্শবাদের ভিত্তিতে লড়াই ,এটা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে সোমেন যে অসামান্য সমাজ সচেতনতার পরিচয় রেখে গিয়েছিলেন, তা যেন পরবর্তীকালে গোটা ভারতবর্ষে সাম্যবাদী আন্দোলনের একটা নতুন ধারায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল ।
সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর সামন্ততান্ত্রিক শোষণের পারস্পরিক আন্তরিক সম্পর্ক ,সামন্ততান্ত্রিক সমাজে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের একটা সংক্ষিপ্ত রূপ ই ,সামন্ততান্ত্রিক সমাজে অনেক পরিবর্তিত আকারে ,অনেক বিস্তৃত আকারে ,সাম্রাজ্যবাদী উপস্থাপনা হিসেবে নিজের আত্মপরিচয় প্রকাশ করে-- এটা দেখানোর ক্ষেত্রে অদ্ভুত মুন্সিয়ানা সোমেন চন্দ তাঁর উপন্যাসের ভেতরে দেখিয়েছেন ।এই দেখানোটা এককথায় অনবদ্য ভাবে ' বন্যা' য় সর্বোচ্চ মাত্রায় এসেছে। একটি গ্রামের পটভূমিকায় 'বন্যা' উপন্যাসটি কে স্থাপন করেছেন সোমেন ।সেই পটভূমিতে বন্যা ত্রাণ সমিতির একদল মানুষের সাথে আসা রজতের ভেতর দিয়ে নারী-পুরুষের চিরন্তন দ্বন্দ্ব কে ,সমাজ সচেতনতার একটি বৃক্ষ হিশেবে সোমেন প্রতিষ্ঠা করেছেন।আবার সেখানে প্যানপেনে প্রেমের কাহিনী নয় ।স্বপ্ন দেখানোর ভেতর দিয়ে পুরুষের নারীকে বঞ্চনা ঘিরে সহানুভূতি তৈরির , এক ধরনের বাহাদুরি অর্জনের শরৎচন্দ্রীয় কোন ধরনের উপাদান সোমেন আনেন নি।সেবার ভেতর দিয়ে চপলমতি সুন্দরী মেয়ে মালতি সঙ্গে আলাপ রজতের। সেই আলাক কে ঘিরে কোন ধরনের স্বপ্নের মায়া র বর্ণনা নয়। সেই আলাপকে পরিচালিত করা হচ্ছে শ্রেণীসংগ্রাম বিকশিত করবার একটি লক্ষ্যমাত্রায়।
এই যে বৈশিষ্ট্যের উপর 'বন্যা' উপন্যাস কে স্থাপন করা ,তেমন স্থাপনের একটি মাধুর্য , তাকে শুধুমাত্র সাহিত্যিক পরিমণ্ডলের মধ্যে ব্যক্ত করে রাখলে চলবে না। তার ব্যাপ্তি সামগ্রিকভাবে আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক, বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, শোষণমুক্তির জন্য লড়াই, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের লড়াইয়ে প্রতিষ্ঠিত করবার যে উদ্দেশ্য, সেই যাত্রাপথে ই এই উপন্যাসটির কালোত্তীর্ণ ধারা প্রবাহ নির্ভর করছে।সামন্ততন্ত্রের শ্রেণীচরিত্র নির্ধারণে সোমেন চন্দের ' বন্যা' উপন্যাসের ' তারক বিশ্বাস' চরিত্র টি চিরকাল একটা মাইল ফলক হয়ে থাকবে বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে।