রাজদ্রোহ আইনের বিলোপ ঘটিয়ে আরও কড়া দেশদ্রোহ আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের দমনের নামে যা প্রয়োগ হতে পারে সরকারের বিরোধিতা করলেই। একইভাবে বিরোধীশূন্য সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে বিতর্কিত টেলিকম বিল। সংসদের দুই কক্ষে পাস হওয়ার পর এটা এখন আইন হওয়ার পথে। নয়া টেলিকম আইনের বলে, সরকার যে কোনও টেলি পরিষেবা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে পারবে। ই-মেল ও হোয়াটসঅ্যাপের গোপনীয়তা আংশিকভাবে সরকার ভাঙতে পারবে।
রেকর্ড ১৪৬ সাংসদ বহিষ্কার! বিতর্কিত বিল পাশ! দেশজুড়ে উত্তাল বিক্ষোভ
December 24, 2023
ভারতীয় সংসদে যা ঘটলো এই শীতকালীন অধিবেশনে তা নিঃসন্দেহে একটি যথেষ্ট উদ্বেগ জনক আমাদের দেশের গর্ব করার জন্য যে গণতন্ত্র এবং যে সংবিধান তাকে অস্বীকার করবার এবং অনেকটা ফ্যাসিস্ট কায়দায় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার একটি নদীর বিহীন ঘটনা দেখতে পাওয়া গেল ইতিপূর্বে ভারতবর্ষের সংসদে কোনদিন এমন ঘটনা ঘটেনি সরকারের ন্যূনতম ধৈর্য শালীনতাবোধ সম্পর্কে গোটা বিশ্বে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল এজন্য দেশ জুড়ে বিক্ষোভ অব্যাহত স্বাভাবিকভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্লোগান সংসদের অভ্যন্তরে না হলে রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।
দিল্লিতে বিক্ষোভ সমাবেশে ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, দলের নেতা রাহুল গান্ধীও।
ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘কেউ কখনও শোনেনি ১৪৬ সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এরা ফের জিতে এলে সংসদ থাকবে কিনা প্রশ্ন রয়েছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘সংবিধানের প্রথম শব্দ আমরা, মানে জনতা। জনতাই সার্ভভৌমত্ব প্রয়োগ করে। জনতা সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে। সাংসদরা সরকার ঠিক করে। সরকার সংসদে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। সাংসদরা জনতার কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে। সংবিধানই এই ব্যবস্থা করেছে। তাকে ভাঙা হচ্ছে।’’
ইয়েচুরি বলেন, ‘‘আজ সংসদ বন্ধ করে রেখেছে, সাংসদদের বহিষ্কার করছে। আসলে সংবিধান ধ্বংস করা হচ্ছে।’
বিহারে মহাগোট বন্ধন এর পক্ষ থেকে পাটনায় বিরাট বিক্ষোভ জানানো হয়। বিক্রমে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন
প্রশ্ন হচ্ছে বেশ কিছু বিতর্কিত বিল আলোচনা ছাড়াই পাশ করিয়ে নেওয়ার জন্যই এমন হল? এই সময়ে ১৪৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করে চলল অধিবেশন। তার আগে বহিষ্কার করা হয়েছিল মহুয়া মৈত্রকে। অথচ এই নজিরবিহীন ও ঐতিহাসিক অধিবেশনে এমন কয়েকটি বিল পাস হল, যা স্বাধীনোত্তর ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোতে আমূল বদল ঘটাতে পারে।
ঘটনাচক্রে সংসদের এই অধিবেশনেই ধোঁয়াকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটে গেল। সংসদের দীর্ঘ ইতিহাসে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গাফিলতি প্রথম নয়। কিন্তু, ১৩ ডিসেম্বরই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এত বড় ঘাটতি হাড়হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঠিক ২২ বছর আগে ১৩ ডিসেম্বরই সংসদে হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। আবার সেই ১৩ ডিসেম্বরই নয়া সংসদ ভবনে গ্যালারি থেকে ঝাঁপ দিল দুই তরুণ। কী উদ্দেশে এই দুই তরুণ এত বড় ঝুঁকি নিয়ে গ্যালারি থেকে সংসদে ঝাঁপ দিয়ে ধোঁয়া ছড়াল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এদের পিছনে কোন শক্তি কাজ করেছে, তার এখনও পর্যন্ত কোনও বিশ্বাসযোগ্য উত্তর মিলছে না। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার এতবড় ঘটনাটি সংসদে পথ তৈরি করে দিল সাসপেনশনের নজির সৃষ্টির।
সংসদে ঝাঁপিয়ে পড়া দুই যুবককে পাস দেওয়ায় অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার বহিষ্কার ও ধোঁয়াকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে অমিত শাহ-র বিবৃতি চেয়ে লোকসভায় ৯৯ জন এবং রাজ্যসভায় ৪৭ জন সাংসদ সাসপেন্ড হয়েছেন। এই রেকর্ড সাসপেনশনের পরেও লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা জানিয়েছেন, সংসদের নিম্নকক্ষে এই অধিবেশনে ৭৪ শতাংশ কাজ হয়েছে। লোকসভায় পাস হয়েছে মোট ১৮টি বিল এবং রাজ্যসভায় পাস হয়েছে মোট ১৭টি বিল। এর মধ্যে রয়েছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দণ্ডসংহিতার তিনটি বিল, টেলিকম বিল, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগপদ্ধতি সংক্রান্ত বিল, পোস্টাল বিল ইত্যাদি। এই সবক’টি বিল দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা পি. চিদম্বরমের মতে, সংসদের শীতকালীন অধিবেশন দেখল এমন একটি ক্রিকেট ম্যাচ, যেখানে বিপক্ষকে ব্যাট করতেই দেওয়া হল না। বাস্তবিকই একেবারে ফাঁকা মাঠে নেমে গোল করে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ জিতে নিলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ-রা। দণ্ডসংহিতার যে তিনটি বিল বিরোধীহীন সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হল, তার প্রভাব দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সুদূরপ্রসারী। এই তিনটি বিলের মাধ্যমে শতাব্দীপ্রাচীন আইপিসি, সিআরপিসি এবং ভারতীয় সাক্ষ্য আইনের সম্পূর্ণ সংস্কার করা হয়েছে। ঔপনিবেশিক আইনের খোলনলচে বদলে দেওয়ার নামে দেশে পুলিশরাজ প্রবর্তনের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে বলে বিরোধীদের অভিযোগ। রাজদ্রোহ আইনের বিলোপ ঘটিয়ে আরও কড়া দেশদ্রোহ আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের দমনের নামে যা প্রয়োগ হতে পারে সরকারের বিরোধিতা করলেই। একইভাবে বিরোধীশূন্য সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে বিতর্কিত টেলিকম বিল। সংসদের দুই কক্ষে পাস হওয়ার পর এটা এখন আইন হওয়ার পথে। নয়া টেলিকম আইনের বলে, সরকার যে কোনও টেলি পরিষেবা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে পারবে। ই-মেল ও হোয়াটসঅ্যাপের গোপনীয়তা আংশিকভাবে সরকার ভাঙতে পারবে। নয়া টেলিকম আইনে নিলাম ছাড়াই সরকার কোনও বেসরকারি সংস্থাকে স্যাটেলাইটের স্পেকট্রাম বণ্টন করতে পারবে। এই সময় পাস হওয়া নয়া পোস্টাল বিলে ডাক বিভাগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ডাকে আসা যে কোনও চিঠি ও সামগ্রী খুলে দেখার। কার্যত বিনা বিতর্কে সংসদের দুই কক্ষে পাস হয়েছে মুখ্যনির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ সংক্রান্ত বিল। এই বিলের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের পূর্ণক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছে। অর্থাৎ, সদ্য পাস হওয়া সবক’টি বিলই আইনে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের এতকালের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে খর্ব করার ক্ষমতা রাখে।
প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্কিত এই বিলগুলি পাস করিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যেই কি সংসদ থেকে রেকর্ড সংখ্যক সাংসদকে বহিষ্কার করা হল? সংসদের ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ বা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অধিবেশনে ঢোকার অভিযোগে সাসপেন্ড হওয়া একেবারেই বেনজির। এটা লঘুপাপে গুরুদণ্ড! ওয়েলে নেমে প্রতিবাদ বা অধিবেশনে কোনও ইস্যুতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে ঢোকা ভারতীয় সংসদে বিরোধী দলের বরাবরের দস্তুর। সংসদ অচল করাই বিরোধীদের কাজ বলে সাত দশক ধরে ভারতীয় গণতন্ত্র জেনে এসেছে। সেই কাজের জন্যই এবার সাংসদদের ঝাঁকে ঝাঁকে সাসপেন্ড করে দেওয়া গোটা বিশ্বকেই বিস্মিত করেছে। অনেকেই সে কারণে তুলনা টানছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারের নাৎসি জার্মানির রাইখস্ট্যাগের ঘটনার।
তবে ১৪৬ জনকে সাসপেন্ড করে সংসদে একটার পর একটা বিতর্কিত আইন তৈরি করে নেওয়ার পর হিটলারের সঙ্গে তুলনায় আসায় নির্বিকার নরেন্দ্র মোদি সরকার।
এদিকে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। বিরোধী দলগুলির দেশব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে ত্রিপুরার ধলাই জেলার কমলপুরে গত শুক্রবার প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন সংগঠিত করেছে বামেরা।
গত শনিবার পশ্চিমবঙ্গের বামেদের পক্ষ থেকে লোকসভা এবং রাজ্যসভা থেকে বিরোধী সাংসদদের সাসপেন্ড করার প্রতিবাদে ধর্মতলা থেকে এন্টালি মার্কেট পর্যন্ত মিছিল কলকাতায় বামফ্রন্টের ডাকে। দেশের সর্বত্র হয়েছে প্রতিবাদ। সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা অংশ নিয়েছেন সর্বত্র। লক্ষ্ণৌয়ে জমায়েতে ছিলেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য সুভাষিণী আলি। ছিল ‘ইন্ডিয়া’-র অন্য দলগুলিও। বিজয়ওয়াড়া, হায়দরাবাদেও হয়েছে বিক্ষোভ সমাবেশ। ঝাড়খণ্ডের দেওঘরে বক্তব্য রেখেছেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত।
We hate spam as much as you do