১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি শামসুর রাহমানের রাজধানীর শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করে একদল দুর্বৃত্ত; এতে গুরুতর জখম হলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
জন্মদিনে কবি শামসুর রাহমান অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং জনমানুষের কবি
উত্তপ্ত আজকের বাংলাদেশে কবি শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে কবির আপোষহীনতার কথা।
" তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিত্কার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে এক থুত্থুরে বুড়ো
উদাস দাওয়ায় ব’সে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধ’রে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী ব’লে নৌকা চালায় উদ্দান ঝড়ে
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হ’তে চলেছে —
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।"
(শামসুর রাহমান)
আজ কবি শামসুর রাহমান এর জন্মদিন। (জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯২৯) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর জন্ম ঢাকা শহরের মাহুতটুলিতে।। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে দুই বাংলায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁকে এক জন নাগরিক কবিও বলা হতো ।
তাঁর কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৯-এ, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন – সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয়।
শামসুর রাহমান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন 'হাতির শুঁড়' নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ করে লেখেন অসাধারণ কবিতা 'টেলেমেকাস'। রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে করেছিলেন ।। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাবে ক্ষুদ্ধ হয়ে কবি লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহিদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিক ভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদির পাড়াতলি গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা 'স্বাধীনতা তুমি' এবং ' 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা'। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে 'শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা', দ্বিতীয় বছরে 'স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা', তৃতীয় বছরে 'সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা' এবং চতুর্থ বছরে 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা' লেখেন। ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন 'গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা'। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল।
শামসুর রহমানের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ৬৬। তিনি ৪টি উপন্যাসও লিখেছেন। অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কবি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনন্দ পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং যাদবপুর ও রবিন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট। **
১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি শামসুর রাহমানের রাজধানীর শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করে একদল দুর্বৃত্ত; এতে গুরুতর জখম হলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার শামসুর রাহমানের উপর হামলার সময় বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল না।
সতের বছর আগে কবিকে হত্যাচেষ্টায় ঘটনায় দায়ের করা একটি মামলা পুনরুজ্জীবিত করতে আদালতে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ।
পৃথিবীর প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষ ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমের শীর্ষজুড়ে রয়েছে মানুষের সৃষ্টিশীলতা। সৃজন, মনন ও কর্মের বিশিষ্টতায় এ জন্য মানুষই সৃষ্টির সেরা। মানুষ গড়তে পারে, ভাঙতে পারে এবং মানুষই ইতিহাসের স্রষ্টা। সৃজন, স্বভাবগত মননশীলতা ও কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ অমর হয়ে থাকে। কৃষ্টি, সভ্যতার নিরিখে মানবীয় গুণাবলির ভিত্তিতে সমাজ ও জাতির উন্নতির পেছনেও মানুষই সক্রিয় ও শক্তিমান। মানুষের এসব গুণ মহান স্রষ্টার কাছ থেকে পাওয়া। মানুষই সবচেয়ে বেশি মনন ক্ষমতা ও গুরুমস্তিষ্কের অধিকারী। জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেচনাবোধ আর মেধা ও মননের ফলেই উদ্ভাবনার অমিত শক্তিতে মানুষের সমতুল্য কেউ নেই।
তবে অমর থাকার পেছনে সব মানুষের সাফল্যের দিকটি একরকম নয়। প্রত্যেকের ভিন্নরূপ ও ভিন্নতর আঙিকে তার পরিস্ফুটন ঘটে। কবি শামসুর রাহমানের অবস্থানটি বহুমাত্রিক বিত্তবৈভবে আকীর্ণ। কবিতার স্বর্ণচূড়ায় আরোহনের মাধ্যমে তিনি কৃতিমান হয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে তথা আধুনিক বাংলা কবিতার স্রষ্টাদের অন্যতম। এ ব্যাপারে কোনো রাখঢাক না রেখেই উল্লেখ করতে হবে যে তিনি তাঁর কবিতা ও ঈর্ষণীয় আকাশচুম্বী কাব্যসৃষ্টির কারণেই সাহিত্যভুবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
( ** Rabin kr Das)
We hate spam as much as you do