Tranding

01:19 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / সরস্বতী পুজার ইতিহাস ও অনেক ফেলে আসা কথা যা একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত

সরস্বতী পুজার ইতিহাস ও অনেক ফেলে আসা কথা যা একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত

বসন্তের শুরুতে এই ভ্যালেন্টাইনস ডে আসার অনেক আগে থেকেই স্কুলে, ক্লাবে বাগদেবীর আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে শহরের বুকে অজস্র নির্মল কিশোর 'প্রেম' গড়ে ওঠার সাক্ষী থাকে সরস্বতী পুজো। এই শহরে দুর্গাপুজোর পর বোধহয় সরস্বতী পুজোর জৌলুসই সবচেয়ে বেশি। প্রথম দিকে ছবিটা কিন্তু এরকম ছিল না। টোল-চতুস্পাঠীগুলোতে দেবী পূজিতা হতেন পাতায় পটে। সেখান থেকে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে উত্তরণ ঘটেছে কিন্তু 'বাবু সমাজ'এর হাত ধরেই। ইংরেজি শিক্ষিত বাবু সমাজের নানান কাজের মতোই যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত কলকাতায় সরস্বতী পুজোর ইতিহাস।

সরস্বতী পুজার ইতিহাস ও অনেক ফেলে আসা কথা যা একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত

সরস্বতী পুজার ইতিহাস ও অনেক ফেলে আসা কথা যা একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত 

 

কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। শীতের শেষে বসন্তের শুরুতে আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি হতে চলেছে বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনা। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা আয়োজিত হয়। তিথিটি শ্রীপঞ্চমী বা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িতে ও সর্বজনীন পূজামণ্ডপে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়।


 সরস্বতী পুজার ইতিহাস আসলে কি? কোন পরম্পরা ধরে এই  পূজো বাঙালীর ঘরে এল?
সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজা বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির উপর তালপাতার তাড়ি ও দোয়াতকলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্রেরা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত।

পরে বর্ধমানের মহারাজ এই পুজা বিশেষ সমারোহের আয়োজন করেন। দূর দুরান্ত থেকে মানুষ এই পূজার বিসর্জন দেখতে আসতমানুষ। পূজা উপলক্ষে দুই ঘণ্টা আতসবাজিও পোড়ানো হত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।


শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা যায়। সরস্বতীর পূজা সাধারণ পূজার নিয়মানুসারেই হয়। তবে এই পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়। তা হল অভ্র-আবীর, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ। এই দিন ছোটোদের হাতেখড়ি দিয়ে পড়াশুনা শুরু হয় পুজার শেষে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার প্রথাটি অত্যন্ত জনপ্রিয়।


বাঙালির 'ভ্যালেন্টাইন্স ডে' সরস্বতী পুজোর ধুমধাম শুরু কিন্তু  যৌনপল্লীতে। বসন্তের শুরুতে এই ভ্যালেন্টাইনস ডে আসার অনেক আগে থেকেই স্কুলে, ক্লাবে বাগদেবীর আরাধনার সঙ্গে সঙ্গে শহরের বুকে অজস্র নির্মল কিশোর 'প্রেম' গড়ে ওঠার সাক্ষী থাকে সরস্বতী পুজো। এই শহরে দুর্গাপুজোর পর বোধহয় সরস্বতী পুজোর জৌলুসই সবচেয়ে বেশি। প্রথম দিকে ছবিটা কিন্তু এরকম ছিল না। টোল-চতুস্পাঠীগুলোতে দেবী পূজিতা হতেন পাতায় পটে। সেখান থেকে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে উত্তরণ ঘটেছে কিন্তু 'বাবু সমাজ'এর হাত ধরেই। ইংরেজি শিক্ষিত বাবু সমাজের নানান কাজের মতোই যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত কলকাতায় সরস্বতী পুজোর ইতিহাস।

ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা করে যেসমস্ত বাঙালি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন আর দুহাতে সেসমস্ত অর্থ খরচ করতেন তাঁরাই পরিচিত ছিলেন 'নববাবু' নামে। আর বাবু সমাজে কৌলীন্য নির্ভর করত উপপত্নী পোষণের উপর। এঁরা 'নববিবি' আখ্যা পেয়েছিলেন। আর এভাবেই শহরের বুকে গড়ে ওঠে 'নিষিদ্ধপল্লী'। জাঁকজমকপূর্ণ সরস্বতী পুজোর শুরু এই যৌনপল্লীতেই।

১৮৭২ সালে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের 'বাবু' প্রবন্ধ। আর সেখানে তিনি লিখেছেন, "যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন এবং পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।" এই বাবুদের সৌজন্যে অধিকাংশ পতিতালয়েই খুব জাঁকজমক করে হত সরস্বতী পুজো। পরিস্থিতি এমন যে "কুমোরটুলির নগ্দা সরস্বতীরা বেধড়ক বিক্রি হয়ে মুটের মাথায় উঠ্চেন, কুমোরেরা শেষকালে আর জোগাতে না পেরে, বাড়তি দোমেটে করা জগদ্ধাত্রী ঠাকুরুনের হাতি ও সিঙ্গি ভেঙে দুখানি হাত কেটে ও ঘাড় বেঁকিয়ে সাদা করে স্থান পূর্ণ কচ্চে।" (হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ)।


 
হিন্দু সমাজে গেল গেল রব উঠল। ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 'সমাজ কুচিত্র' নকশায় (১৮৬৫) বলেছেন, "কলকেতা শহরের সকলই সৃষ্টিছাড়া। এখানে গৃহবাড়ির চেয়ে বেশ্যাবাড়িতে সরস্বতী পুজোর সংখ্যা ও জাঁকজমক শতগুণে অধিক।" কিন্তু স্বয়ং কুবেরের হাত আছে যে বাবুদের মাথার উপর তাঁরা চাইলেই তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন। এতে আর বলার কী আছে?

Your Opinion

We hate spam as much as you do