দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি এয়ার স্ট্রাইক থেকে লাখো শ্রমিকদের ভিনদেশে প্রেরণের এক চলমান ইতিহাস
কলকাতার চলমান ইতিহাসের এক ঐতিহ্যের সাক্ষী আজকের কলকাতা বন্দর এলাকা। যা কমবেশি আমরা খিদিরপুর ডক নামে জেনে থাকি। এই খিদিরপুর এক বিস্তর ইতিহাস রয়েছে। তবে প্রশ্ন জাগতে পারে, খিদিরপুরের এহেন নামকরণের কারণ কি?
ইতিহাস অবশ্য একাধিক তথ্য প্রদান করছে। যেখান থেকে শুরু হয়েছে বিতর্কের। এই অঞ্চলের জন্ম হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী সময়। কলকাতা তখনও কল্লোলিনী হয়ে ওঠেনি। সালটা ১৭৫৭, পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়েছে। কলকাতায় জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে ইংরেজরা। এরপর বক্সারের যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পরে পাকাপাকি ভাবে কলকাতা হয়ে উঠলো সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে ইংরেজদের সবথেকে শক্তিশালী ঘাঁটি কিন্তু তখনো পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষের দখল করে উঠতে পারেনি ইংরেজরা। এরপর ঠিক হল ইংরেজরা কলকাতায় ফোর্ট তৈরি করবে, যা আজকের ফোর্ট উইলিয়াম নামে খ্যাত। যার জন্য জমির বন্দোবস্তও করা হল। ১৭৬৭-৬৯ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন হ্যারি ভেরেস্ট এবং তার দেওয়ান হিসাবে পরিচিত ছিলেন জয়নারায়ন ঘোষাল। যে অঞ্চলটিতে আজকের ফোর্ট উইলিয়াম স্থাপিত হয়েছে সেই জমি ছিল আসলে এই ঘোষাল পরিবারের। গভর্নর সাহেব ঘোষাল পরিবারের থেকে জমি সংগ্রহ করলেন এবং তার বিনিময়ে জয়নারায়ন মহাশয়কে খিদিরপুর অঞ্চলে জমি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তখন অবশ্য খিদিরপুর ছিল জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চল। প্রায় ১০৮ বিঘা জঙ্গল পরিষ্কার করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঘোষালদের রাজবাড়ী। যার নাম দেওয়া হয়েছিল ভূকৈলাশ রাজবাড়ী, সালটা ১৭৮১।
কিন্তু প্রশ্ন হল এই খিদিরপুরের নামকরণ নিয়ে। একদা কিড সাহেব ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে এখানে একটি ছোটখাটো ডক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার থেকে হয়ত এই অঞ্চলের নাম হয়েছিল কিডরপুর, জনমুখে তা ধীরে ধীরে খিদিরপুর-এ পরিণত হয়েছে। আরো এক প্রকার তথ্য অনুযায়ী এখানে নাকি খাজা খিজির নামক জনৈক পির বসবাস করতেন। যাকে কমবেশি দরিয়ার পির বলা হয়ে থাকে। এই খিজির শব্দ থেকেই পরবর্তীকালে খিদির শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা হয়ে থাকে, যেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে খিদিরপুর। বিতর্ক কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি, অনেকের মতে একসময় এই অঞ্চলে খয়েরের রমরমা ব্যবসা ছিল। ঘটনাচক্রে খয়েরের বিশুদ্ধ নাম খদির। সেখান থেকেই নাকি খিদির শব্দের উৎপত্তি।
সবশেষে অবশ্য সুকুমার সেন-এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তিনি তার বাংলার স্থাননামা গ্রন্থে এ বিষয়ে যথার্থই বলেছেন খিদিরপুর নামটি খিঞ্জিরপুর-এর অপভ্রংশ। আরবি শব্দ খিঞ্জির-এর অর্থ হল শুয়োর। একটা সময় ছিল যখন এই গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যাপকহারে শুয়োর দেখা যেত। তা থেকেই হয়ত প্রথমে খিঞ্জিরপুর এবং তা পরে খিদিরপুরে পরিণত। তবে নাম নিয়ে যা বিতর্ক থাকুক না কেন, গঙ্গাপাড়ের এই অঞ্চল কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থান। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়-এর মতো মানুষজন এখানে বসবাস করতেন। উমেশচন্দ্র ব্যানার্জীর কথা জানা আছে? যার ইংরেজি নামের বানানটি বেশ চমৎকার, Womesh Chunder Bonnerjee। যিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি। এই ভদ্রলোক এখানে বসবাস করতেন।
এ নয় গেল নামকরণের ইতিহাস। তবে ডক কবে তৈরি করা হল। উনবিংশ শতকে ভারতবর্ষ ছিল ইংরেজদের ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র। কাঁচামাল সংগ্রহ করে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করা অথবা ইংল্যান্ড থেকে শিল্পজাত পণ্য সামগ্রী ভারতবর্ষে নিয়ে আসা এই ছিল তাদের মূল ব্যবসা। আজকের কলকাতা অবশ্য তখন ভারতের রাজধানী ছিল। ব্যবসা বাণিজ্যের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ছিল একটা আধুনিক বন্দর। বন্দর হওয়ার আগে থেকেই গঙ্গা পাড়ে জাহাজ নোঙর ফেলত ঠিকই কিন্তু ব্যবসার প্রসার ঘটলে প্রয়োজন ছিল বৃহৎ আকৃতির জাহাজের প্রবেশ। আর তার জন্য আধুনিক বন্দরের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল ১৮৪২ সাল থেকে। এই চিন্তাভাবনা অবশ্য বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। ১৮৫৩ সালে বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৮৩৩-৩৪ সাল থেকে মোটামুটিভাবে এরা কাজকর্ম শুরু করেছিল। সময় যত গড়িয়েছে চিন্তাভাবনা বাস্তবতা লাভ করেছে। ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল একটা পোর্ট কমিশন। অবশ্য এর এক বছর আগে থেকেই ভারী যন্ত্রের সাহায্যে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়েছিল খিদিরপুর ডকে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৮৪ সালে খিদিরপুর অঞ্চল বন্দর তৈরি করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। জমি পাওয়ার পর জোর কদমে কাজও শুরু হয়েছিল এবং মোটামুটি ভাবে ১৮৯২ সালে বন্দর নির্মাণ শেষ হয়। এই সময়েই যান্ত্রিক উপায়ে জলের গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতিও শুরু হয়েছিল। দিনটা ২০শে জুন, ১৮৯২ সাল বিশাল আকৃতির ব্রিটিশ জাহাজ "লুসিয়ে" প্রবেশ করেছিল কলকাতা বন্দরে। তখন থেকেই কলকাতা বন্দর হয়ে উঠল ব্যবসা বাণিজ্যের আঁতুড়ঘর। সময় যত এগিয়েছে বন্দর আরো আধুনিক হয়েছে। ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ-এর নামে কলকাতা বন্দরে গড়ে তোলা হয়েছিল আরো একটি বৃহৎ আকৃতির ডক। স্বাধীনতার পর নামকরণ করা হয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র ডক।
এই কলকাতা বন্দর একাধিক ইতিহাসের সাক্ষী। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন উপনিবেশ উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আখ উৎপাদনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। যার জন্য প্রয়োজন ছিল শ্রমিক। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮৩৩ সাল নাগাদ সারা পৃথিবী জুড়ে দাসত্বকে বেআইনী হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। পাকাপোক্তভাবে বন্দর গড়ে ওঠার আগেই ১৮৩৮ সাল থেকে ভারতীয় শ্রমিকদের প্রেরণ করা হত বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশ। বন্দর আধুনিক হয়ে উঠলে শ্রমিক প্রেরণ করার সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। লাখো লাখো শ্রমিককে পাঠানো হয়েছিল মরিশাস, ত্রিনিদাদ, জামাইকা, পূর্ব আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে। এই এই গঙ্গা নদীর পাড়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শ্রমিকদের অন্য দেশে পাঠানোর আগে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ব্যবস্থা ছিল। এই ভাবেই হয়ত ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে কলকাতা বন্দর। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কলকাতা বন্দর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা গ্রাস করেছিল খিদিরপুরকে। আসলে এই বন্দর ছিল দূরপ্রাচ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশদের সাপ্লাই লাইন। জাপান চেয়েছিল সাপ্লাই লাইন বন্ধ করতে। সেই উদ্দেশ্যেই ১৯৪২ সালের ২০শে ডিসেম্বর এয়ার স্ট্রাইক করেছিল জাপানি বোমারু বিমান। এয়ার স্ট্রাইকের মূল লক্ষ্য ছিল কলকাতা বন্দর এলাকা। এরপর বেশ কয়েকবার বোমাবর্ষণ করা হয়। খিদিরপুর ডক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল একাধিক ঘরবাড়ি। মৃত্যুর মিছিল দেখেছিল সেদিনের কলকাতা। অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল সমগ্র খিদিরপুর এলাকাজুড়ে। শুধু একবার নয় ময়দান চত্বর জুড়ে বারবার বোমা বর্ষিত হয়েছিল। এই বোমাবর্ষণ মূলত সূর্য অস্ত যাওয়ার পর সম্পন্ন হত। সারা কলকাতাকে অন্ধকার করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার।
এইভাবেই এক চলমান ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছে এই খিদিরপুর। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে আজকের খিদিরপুরের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় খিদিরপুর ডক অঞ্চলের তাৎপর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
We hate spam as much as you do