এই লেখার মূল অংশে এই রাজ্যে গত পাঁচ বছরে শিশু পুষ্টির(অপুষ্টি) অবস্থা নিয়ে সামান্য কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরাই লক্ষ্য।
আমাদের কৈশোরের পাঠ্য ছিল, ‘অন্নপূর্ণা ও ইশ্বরী পাটনী’। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র লিখেছেন অন্নদামঙ্গল। আর সেই লেখার সাথে আমরা জুড়ে নিচ্ছিলাম নিজেদের স্বল্প আয়ের পরিবারে বড় হয়ে ওঠার শৈশবকে। যেখানে মা, মাতৃস্থানীয়া, প্রত্যেকে চাইছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। এই আকাঙ্ক্ষাটি, এই সামান্য চাওয়াটুকু, আজও এই বাংলার বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ধ্বনিত হতে থাকছে। দুর্ভাগ্য এই, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসক দলটি, এবং কেন্দ্রের সরকার সেই আর্তনাদ শুনে উঠতে পারছেন না। কিংবা হয়তো শুনছেন, আর বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে রয়েছেন অস্বস্তি এড়িয়ে যেতেই।
এই লেখার মূল অংশে, এই রাজ্যে গত পাঁচ বছরে শিশু পুষ্টির(অপুষ্টি) অবস্থা নিয়ে সামান্য কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরাই লক্ষ্য। এর পাশাপাশি অন্য কয়েকটি রাজ্যের সাথে তুলনামূলক কিছু আলোচনার চেষ্টা করব। লেখাতে ব্যবহৃত তথ্যগুলি নিয়েছি ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট থেকে। এই সমীক্ষার ২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২০ সালের দুটি রিপোর্ট থেকে, গত পাঁচ বছরে বাংলার শিশু পুষ্টির বিষয় নিয়েই মূল আলোচনা। কিন্তু মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে, আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে শিশু পুষ্টির গুরুত্বের দিকটি একটু দেখে নেওয়া দরকার।
এই শতকের প্রথম তিন দশককে সামনে রেখে, ইউনাইটেড নেশনস (রাষ্ট্রপুঞ্জ) ৩০টি উন্নয়নের সূচক নির্মাণ করেছেন। অর্থাৎ প্রথম তিরিশ বছরে আমরা এই তিরিশটি উন্নয়ন সূচককে সামনে রেখে নিজেদের দেশ এবং রাজ্যগুলিকে আরো বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করব। ‘সাস্টেনেবল ডেভেলেপমেন্ট গোল’ নামের এই সূচক তালিকায় শিশু পুষ্টির গুরুত্ব বিষয়ে একটি মূল অংশ রয়েছে। একইভাবে ইউনিসেফ শিশু পুষ্টির গুরুত্ব বিষয়টিকে দেশের জনস্বাস্থ্যের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক রূপে চিহ্নিত করছেন। এর মূল কারণ দুটি। প্রথমত, সদ্যজাত এবং দুই বছরের নীচে বয়স এমন শিশুদের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি সুনিশ্চিত করতে পারলে, তাদের শারীরিক বৃদ্ধি স্বাভাবিক হলে, ভবিষ্যৎ এর সুস্থ একটি জীবন এবং তাদের মানসিক বিকাশটি সম্পূর্ণ হয়। দ্বিতীয়ত, শিশু অপুষ্টির অর্থ একদিকে রাজ্যের অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্তিক শ্রেণীর দুরবস্থাকে নির্দেশ করে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যের প্রসারের একটি অবনমনকেও নির্দেশ করে। এই কথাগুলি খুব নতুন নয়। তাই শিশু স্বাস্থ্যের উন্নতির দিকটি একই সাথে একটি মানবিক প্রশ্ন এবং তার পাশাপাশি একটি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নও। এই লেখার পরবর্তী দুইটি অংশে আমরা দেখতে পাই, বর্তমান রাজ্য সরকার, মানবিক এবং আর্থ সামাজিক দুটি প্রশ্নকেই সম্ভবত উপেক্ষা করেছেন।
শিশু-স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির অবস্থাঃ গত পাঁচ বছরের চিত্র
ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের পরিসংখ্যানে শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্যের একটি সংজ্ঞা ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ ছয় মাস থেকে তেইশ মাস (দুবছর) বছর বয়সী শিশুদের আহার্য সমস্ত সামগ্রী, স্তন্য-দুধপান এই ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয় একজন শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টির খাদ্য পাচ্ছে কি না। এই সংজ্ঞাটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞার সাথে সাযুজ্য রেখেই তৈরি। ২০১৯-২০ সালের পরিসংখ্যানে, পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক স্তরে প্রতি ১০০ জন শিশুর মাত্র ২৩ জন এই পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ করে থাকে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে এটি ২৩ জনের চেয়েও কম। শহরাঞ্চলে সামান্য বেশি, ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি চারজন শিশুর মধ্যে তিন জন শিশুই পর্যাপ্ত আহার গ্রহণ করছে না এই রাজ্যে। এর ফলাফল, সরাসরি ভাবে সামনে আসে শিশুদের উচ্চতা, ওজন এবং সার্বিক শারীরিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে।
সারণী ১ঃ বয়স অনুপাতে শিশু উচ্চতার ঘাটতি (stunting), %, পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৫-২০২০,
|
স্থান/ |
২০১৫-১৬ |
২০১৯-২০ |
|
রাজ্য |
৩২.৫ |
৩৩.৮ |
|
গ্রামাঞ্চল |
৩৪ |
৩৪.৪ |
|
শহরাঞ্চল |
২৮.৫ |
৩২.১ |
NFHS 4 এবং NFHS 5.
গত পাঁচ-বছরে এই রাজ্যে, শিশু উচ্চতার বৃদ্ধির অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগের। সারণী ১ থেকে আমরা দেখি, পাঁচ বছরের চেয়ে কম বয়স যে সমস্ত শিশুদের, তাদের এক তৃতীয়াংশের উচ্চতা বয়স অনুপাতে কম। অর্থাৎ পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব এখানে স্পষ্টতই দৃশ্যমান। শহরাঞ্চলে এই পরিমাপকটি ২০১৫-১৬ সালে ছিল ২৮ শতাংশ, যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশে। গ্রামাঞ্চলে প্রতি ১০০ জন শিশুর ৩৪ জনের উচ্চতা বয়স অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। এই সার্বিক অপুষ্টির চিত্রটি আরো প্রকটভাবে চোখে পড়ে ওজন-ঘাটতির নিরিখে। অর্থাৎ একজন শিশুর উচ্চতার অনুপাতে তার ওজন থেকে আমরা অনুমান করতে পারি পুষ্টি পর্যাপ্ত হয়েছে কী না। এই ক্ষেত্রেও গত পাঁচ বছরে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ যে পরিসংখ্যানটি আমাদের এই উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে, তা শিশুদের বয়স-অনুপাতে ওজনের পরিসংখ্যান। রাজ্যের ৩২ শতাংশ শিশু, যারা পাঁচ বছরের কম বয়সী, বয়স অনুপাতে তাদের ওজন যথেষ্ট নয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে, শহরাঞ্চলে এই সংখ্যাটি বেড়েছে, আগে ১০০ জনের মধ্যে ২৬ জন শিশুর এই ওজন ঘাটতি দেখা যেত, এখন তা ২৯ জন।
সারণী ২ঃ শিশুদের মধ্যে ওজন ঘাটতির পরিমাণ (Underweight), %, পশ্চিমবঙ্গ, ২০১৫-২০২০
|
স্থান |
২০১৫-১৬ |
২০১৯-২০ |
|
রাজ্য |
৩১.৬ |
৩২.২ |
|
গ্রামাঞ্চল |
৩৩.৬ |
৩৩.৫ |
|
শহরাঞ্চল |
২৬.২ |
২৮.৭ |
NFHS 4 এবং NFHS 5.
শিশু অপুষ্টি এবং সমস্যার মূল কারণ
রাজ্যে সার্বিক ভাবে এবং মূলত শহরাঞ্চলের এই শিশু অপুষ্টির দুটি মূল কারণ। প্রথমত জনস্বাস্থ্যের অংশ রূপে শিশু টীকাকরণ কিংবা রোগ নিরাময়কে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে, পুষ্টি বিষয়ক কোনো নীতি বর্তমান রাজ্য সরকার নেয়নি। দ্বিতীয়ত, পাঁচ বছরের কম বয়স যে শিশুদের, স্বাভাবিকভাবেই তারা বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী নয়। তাই স্কুলের প্রকল্পভিত্তিক পুষ্টির যে সুবিধাগুলি, মিড-ডে মিল ইত্যাদি থেকে প্রাপ্য, তার বাইরেই রয়ে গেছে এই শিশুরা। মাননীয়া বিভিন্ন শ্রী প্রকল্পের বিজ্ঞাপনে নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠছেন, কিন্তু সেই অনুপ্রেরণা শিশু পুষ্টির জন্য যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সার্বজনীন শিশু স্বাস্থ্য প্রকল্পের। প্রয়োজন বিনামূল্যে সার্বিক ভাবে শিশুদের আহার্য পৌঁছে দেবার একটি নীতির। গত পাঁচ বছরে আমরা রেশনের চাল, আম্ফানের পর ত্রিপল, মিড-ডে মিলের ডিম চুরি হতে দেখেছি। দুর্নীতির সাথে সমার্থক হয়ে উঠেছে নীল সাদা পোস্টার। তাই সরকারী প্রকল্পের সাথে প্রয়োজন জনস্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দুর্নীতি হ্রাসও।
লেখা শুরু করেছিলাম কৈশোর পাঠ্য একটি কবিতা দিয়ে। শেষে আরেকটি কবিতার অবতারণা করতে বাধ্য হচ্ছি। এটি আরেকটু বড়বেলার পাঠ। বীরেন্দ্র চটোপাধ্যায় লিখছেন, অপূর্ব ক্রোধে, অসম্ভব জ্বালায়- “সে অন্নে যে বিষ দেয়, কিংবা তাকে কাড়ে/ ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে”। শিশুদের শৈশবে উদ্ভট কাব্যের সম্ভার না দিয়ে, মাননীয়া ন্যূনতম অন্ন-জল-পুষ্টির ব্যবস্থাটুকু করুন, নইলে রাজ্যের শিশুদের অপুষ্টি এবং তার ভয়াল চিত্রটি, বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢেকে রাখা যাবে না।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিউট, ব্যাঙ্গালোরে, অর্থনীতির গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)
We hate spam as much as you do