Tranding

03:19 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব

হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব

হিন্দুধর্মের বিপরীতে হিন্দুত্ববাদ দাঁড়িয়ে আছে এক্সক্লুসিভ বা বর্জনমূলক অবস্থানের ওপর

হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ব

হিন্দুধর্মের কোনো প্রবর্তক ও নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ নেই । প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে অসংখ্য ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আন্দোলন-পরম্পরাকে আত্তীকরণ-সাঙ্গীকরণের মধ্যে দিয়ে এই ধর্মের মহীরুহটি নির্মিত হয়ে উঠেছে । এই নির্মাণ সচেতনভাবে গড়ে তোলা স্থাপত্যের মতো নয় । তাই তার চিন্তাজগতের বৈচিত্র্য অশেষ । মহীরুহের আসংখ্য শাখপ্রশাখাগুলির মধ্যে এক ধরণের নি:শব্দ আসঞ্জন ও আত্তীকরণ প্রক্রিয়া বিদ্যমান । কারণ হিন্দুধর্মের মধ্যে রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা । ফলে শঙ্করাচার্যের অদ্বৈতবাদ ও ভক্তিবাদীদের দ্বৈতবাদের মতো আপাতবিরোধী দর্শনের মধ্যেও কোনো ভয়ঙ্কর সংঘাত সৃষ্টি হয়না । উচ্চবর্গ, নিম্নবর্গ ও লোকায়ত স্তরগুলির যাপিত জীবনের মধ্যে যে পার্থক্য বিদ্যমান তার পরিণতি হিসেবে তাদের ধর্মীয় জীবনের মধ্যেও কাঠামোগত ভিন্নতা ও মতানৈক্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল । এই সবগুলিকে সমন্বিত কোরে হিন্দুধর্মকে বুঝতে হবে । এই ধর্মের বিকাশধারা ছিল মূলত ইনক্লুসিভ বা আত্তীকরণমূলক ।

 

হিন্দুধর্ম ও হিন্দুত্ববাদ সম্পূর্ণ আলাদা । সাভারকর ‘হিন্দুত্ব’-এর ইংরেজি করেছিলেন ‘হিন্দুনেস’ । তার মতে, হিন্দুধর্ম হল হিন্দুত্বের একটি ‘ডেরিভেটিভ’, ‘ফ্র্যকসন’, ‘এ পার্ট’ মাত্র । ‘Forty centuries, if not more, had been at work to mould it as it is.’ চার হাজার বছর আগে থেকেই তিনি হিন্দুজাতির অস্তিত্বের কল্পনা করেছেন । কিন্তু জাতির ধারণা একটি আধুনিক ধারণা । হিন্দুত্ববাদ একটি ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক নির্মাণ । তা আগামীতে হিন্দুরাষ্ট্রের কল্পনা কোরে বর্তমানকে অতীতের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, অহিন্দুদের আদার বা অপর বলে চিহ্নিত করে, একটি ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় । যার সংবিধান রচিত হবে মনু সংহিতার মডেলে, যার জাতীয় সংগীত হবে বন্দেমাতরম ও জাতীয় পতাকা হবে ভগবা ধ্বজা । যেখানে অহিন্দুদের কোন নাগরিক অধিকার থাকবে না । কারণ হিন্দু সংস্কৃতিই হল ভারতীয় সংস্কৃতি । যে সব ধর্ম, জনগোষ্ঠী হিন্দু সংস্কৃতির বাইরে রয়েছে তারা সঠিক অর্থে ভারতীয় নয় – এমনকি তারা ভারতবিরোধীও বটে । স্বাভাবিকভাবেই হিন্দুরাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকবে বিভেদ ও হিংসার ওপর । হিন্দুধর্মের বিপরীতে হিন্দুত্ববাদ দাঁড়িয়ে আছে এক্সক্লুসিভ বা বর্জনমূলক অবস্থানের ওপর । হিন্দুত্ববাদীরা খুব সচেতনভাবে এই বর্জনমূলক মতাদর্শগত আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে চৈতন্যের সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটায় । তারা হিন্দু-‘রা’মুসলিম-‘রা’ যেন দুটি হোমোজিনাইজড বা সমসত্ত্বধর্মী জনগোষ্ঠী – এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চায় । কিন্তু বাস্তবে হিন্দু ও মুসলিম-‘দের’ মধ্যে অগণিত শাখাপ্রশাখা রয়েছে । বাস্তবে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক বা মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক বলে কিছু নেই । সব ধর্মাবলম্বী মানুষই প্রতিটি নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেন ।

 

জার্মানী, ইতালি, স্পেন ও জাপানে ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বিকাশের গতিপথ ছিল আলাদা আলাদা । ভারতেও ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বিস্তারের পদ্ধতি একেবারেই ভারতীয় । ইয়োরোপে ক্লাসিক্যাল ফ্যাসিজম রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল খুব দ্রুত ও মূলত রাজনৈতিক সমাজকে দখলের মাধ্যমে । তারপরে তারা সিভিল সোসাইটি বা জনসমাজে শিকড় ছড়াতে শুরু করেছিল । কিন্তু ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা প্রায় একশো বছর ধরে জনসমাজে শিকড় ছড়াচ্ছে । সেই সঙ্গে তারা রাজনৈতিক সমাজে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । হিন্দুত্ববাদীরা এখনোও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে পারেনি । কিন্তু ভারতবর্ষ ফ্যাসিবাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে । পুলিশ, মিলিটারি, আইবি, সিবিআই, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, এমনকি বিচার ব্যবস্থার মধ্যেও তারা শিকড় ছড়িয়েছে । তাদের চিরকালের সাধারণ শত্রু হল কমিউনিস্টরা । তাই জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে দাঁড়িয়ে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলিকে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে অটল থেকে, ভারতীয় ফ্যাসিবাদের সঙ্গে কমিউনিস্টদেরই শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে হবে, অবশ্যই সমস্ত ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সংহত করার মধ্যে দিয়ে ।         

Your Opinion

We hate spam as much as you do