নিজের রাজনৈতিক সংগঠনের পায়ে মাটি জোগাতে আর এস এস যে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আলাদা দল করবার সময় থেকে মমতাকে সাহায্য করে এসেছে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর ব্রিগেড বক্তৃতার ভিতর দিয়ে তা দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গেল।
মোদির ব্রিগেডের রাজনৈতিক তাৎপর্য
এভাবে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যাবে, এটা বোধহয় কেউ ই ভাবেন নি।না ভেবেছিলেন মমতা।ভাবতে পারেন নি তৃণমূল বা বিজেপির সাধারণ কর্মী , সমর্থকেরাও।ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সটান বলে দিলেন; মমতার গত দশ বছরের শাসন , বিজেপিকে এই রাজ্যে পা ফেলার সুযোগটাকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।আসন্ন বিধানসভার ভোটে বিজেপি ভালো ফল করবে কি করবে না, তা নিয়ে সফোলজিস্টদের বিস্তর হিশেবনিকেশ চলছে।চলবেই।তবে শেষ কথা বলবার সময় তো আসবে আগামী ২ রা মের পর।অতএব , আমরা আপাতত প্রধানমন্ত্রীর শ্রীমুখ নিসৃত এই অমৃতবাণীর দিকে নিজেদের একটু যদি আবিষ্ট করবার চেষ্টা করি, ক্ষতি কি? মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য না হয় নাই বা পড়লাম।যদি শেষ পর্যন্ত ফার্মাকোলজি নিয়ে নেকচার দিতেই হয়, সেই রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে,' ব্যাধি ও প্রতিকারে' র জন্যে, তাই আগে ভাগে একটু প্রাকটিস করে নেওয়া যেতেই পারে।
আর এস এসের নিবেদিত প্রচারক , প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কখনো কোনো আলটপকা কথা বলেন, এটা তাঁর অতি বড়ো শত্রু ও বলবেন না।রেডিও র ' মন কি বাত' ই হোক আর ভোট পাখির কলকাকলিই হোক, মোদি কিন্তু একটিবারের জন্যেও হিশেবের মাপা গন্ডির বাইরে কখনো পা ফেলেন না।তাই ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে মমতার প্রতি তাঁর এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, এটিকে কখনো মোদির মামুলি কথা বলে ধরে নেওয়ার এতোটুকু মানে নেই।নিজের রাজনৈতিক সংগঠনের পায়ে মাটি জোগাতে আর এস এস যে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আলাদা দল করবার সময় থেকে মমতাকে সাহায্য করে এসেছে, খোদ প্রধানমন্ত্রীর ব্রিগেড বক্তৃতার ভিতর দিয়ে তা দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গেল।এতোদিন এই অভিযোগ ধারাবাহিক ভাবে বামপন্থীরা করে আসছিলেন।ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে বামেদের সেই অভিযোগকেই কার্যত স্বীকৃতি দিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।বিজেপির গত ৭ ই মার্চ('২১) ব্রিগেডের এটাই সবথেকে বড়ো রাজনৈতিক পাওনা।
অনেকেই মনে করেন, বামপন্থীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা এখন সীমায়িত।তাই বামপন্থীদের পক্ষে বিজেপিকে ঠেকানো সম্ভব নয়।তাই বিজেপি নামক 'ব্যাধি' র প্রতিকার হিশেবে তাঁরা মমতা নামক ' প্রতিকারে' র কথা বলেন।কোন ছদ্মবেশি বিজেপি বা আর এস এস কর্মী এতোদিন ঘাপটি মেরে তৃণমূলের ভিতরে বসেছিলেন, বসে বসে সর,ননী খাচ্ছিলেন, আর এখন সুযোগ বুঝে কাকের বাসা থেকে কোকিলের নির্গমণের মতো ডানা মেলে দিয়েছেন, সেই গবেষণার আপাতত কোনো দরকার নেই।খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁর দল বিজেপিকে এই রাজ্যে পাখনা মেলবার সুযোগ করে দিতে মমতার অবদানের স্বীকৃতি খোদ ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে করেছেন।এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে কি? মোদির স্বীকৃতির থেকে আর বড়ো কোনো ভূষণ মমতার হতে পারে কি?
বিয়ের প্রথম রাতে বেড়াল মারার আপ্তবাক্যটির মতো কেন ব্রিগেড ভাষণের কার্যত প্রথমেই মমতার এই অবদানের হাড়ি ফাটালেন মোদি? যেসব তারকারা মমতার শিবিরে আর এস এস, বিজেপির হয়ে গোপন অভিসারে ব্যস্ত ছিলেন প্রায় গত আট , দশ বছর ধরে, তাঁরা সব বিজেপির ব্রিগেডে মঞ্চ আলো করে বসে আছেন।এইসব গোপন প্রেমিকদের ',' গোপন কথাটি রবে না গোপনে' - রবীন্দ্রনৃত্যনাট্যের আধুনিক মঞ্চায়নের উদ্দেশেই কি মোদির এই স্বীকারোক্তি? না কি তিনি মমতার প্রতি এই বার্তাই দিতে চাইলেন যে, বেশি তান্ডাই মান্ডাই করবেন না।দেখছেন তো আপনার দলের প্রাক্তন রত্নদের দিয়েই আমার নোতুন নবরত্ন সভা সাজিয়েছি।এরপর ও যদি এই চোরপুলিশ' খেলা হবে' বলে আপনি আস্ফালন করতেই থাকেন, তাহলে হয়তো আপনার গোটা দলটাই পাততাড়ি গুটিয়ে আমার দলে মিশে যাবে।
ব্রিগেডে দাঁড়িয়ে মমতার দুঃশাসন বিজেপির এই রাজ্যে অগ্রগতির কারন হিশেবে ব্যাখ্যা করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।প্রশ্ন হল, মমতার দুঃশাসন ঘিরে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে মোদির ভূমিকা কি ছিল? একবার ও প্রধানমন্ত্রী মমতার অপশাসন ঘিরে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন? সতর্ক করেছেন রাজ্য সরকারকে? আসলে অপশাসনের আড়ালে এই রাজ্যে আর এস এস কে এতোটুকু বিরক্ত না করে মমতার যে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ড, এটাই যে মোদি- মমতার বাইরে কুস্তি, আর ভিতরে দোস্তির এক এবং একমাত্র কারন, সেটাকেই মোদি তাঁর ব্রিগেড বক্তৃতার ভিতর দিয়ে পরিস্কার করে দিয়েছেন। এই উপরে কুস্তি আর ভিতরে দোস্তির সবথেকে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হল, মমতা তাঁর গত দশ বছরের শাসনে প্রয়োজনে , অপ্রয়োজনে বিজেপি সম্পর্কে অনেক মিঠে কড়া কথা বলেছেন।এমন কি নরেন্দ্র মোদিকে কোমরে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর মতো ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক কথা ও বলেছেন।কিন্তু যেটা ভুলেও মমতা কখনো উচ্চারণ করেন নি, সেটা হল আর এস এস বা তাদের শীর্ষ ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে একটিও নেতিবাচক শব্দ।মমতা তাঁর গত দশ বছরের শাসন কালে বিপক্ষ রাজনৈতিক পক্ষের সভা সমিতি করবার ক্ষেত্রে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন।কিন্তু একটিবারের জন্যে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের কলকাতার সভা বা রাজ্যের অন্য প্রান্তে কোনো সভা সমিতির ক্ষেত্রে এতোটুকু বাঁধা সৃষ্টি করেন নি।শুধু মোহন ভাগবত ই নয়, সঙ্ঘের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের এই রাজ্যে অবাধ কার্যবিধির উপর মমতা তাঁর নিজের দলের কোনো পাল্টা রাজনৈতিক কার্যক্রম যেমন করেন নি, তেমনিই কোনো প্রশাসনিক বাঁধাও সৃষ্টি করেন নি।
আর এস এসের প্রতি মমতার এই নরম মানসিকতাই যে প্রকৃতপক্ষে সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির জন্যে এখানে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে, তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।এই বিষয়টিই ব্রিগেডে মোদির বক্তৃতায় উঠে এসেছে।মোদি এই উপরে কুস্তি, ভিতরে দোস্তির বিষয়টি রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দরুণ যতোটা রেখেঢেকে প্রকাশ্যে আনা সম্ভব , ঠিক ততোটাই রেখেঢেকে সামনে এনেছেন।কিন্তু যতোই আড়াল আবডাল মোদি রাখবার চেষ্টা করুন না কেন, মমতা যে বিজেপির সহায়ক শক্তিসূচক একটি অনুঘটক, সেটি তাঁর ব্রিগেড বক্তৃতার ভিতর দিয়ে দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে গিয়েছে।
বক্তব্য লেখকের নিজস্ব
We hate spam as much as you do