Tranding

02:20 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীর হুঙ্কার

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীর হুঙ্কার

বিশ্ব উশ্নায়ন সম্পর্কিত উপরোক্ত কারণগুলিতে আর্কটিক অঞ্চলে জাহাজের চলাচল বিগত এক দশকে প্রায় ৩৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। বরফের স্তর যত কমবে তত খুলে যাবে বাণিজ্যের রাস্তা। সমস্ত ব্যাপারটাই একটি ফিডব্যাক লুপ বা ভিসিয়াস সাইকেলের মতো কাজ করছে। যত গলবে বরফ তত বাড়বে বাণিজ্য পথে যাতায়াত। তত আরও কমবে বরফের স্তর। বাণিজ্য পথে জাহাজ চলাচল আরও ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনছে। বেশিরভাগ জাহাজের নকশাই আর্কটিকের উপযুক্ত নয়। ফলতই তেল এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক আর্কটিকে ছড়িয়ে পড়ছে, মিশে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আর্কটিক এর বাণিজ্যপথেও পরিবর্তন হচ্ছে।

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীর হুঙ্কার

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীর হুঙ্কার

অয়ন চট্টোপাধ্যায়
০৫/০১/২০২৫

মার্কিন মুলুকের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প  হুঙ্কার ছাড়লেন, পানামা কানাল দিয়ে পণ্য পরিবহনে অনেক খরচ হচ্ছে। জিমি কার্টার বুদ্ধুর মতো পানামা কানাল কে পানামার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সব থেকে ভালো উপায় হচ্ছে আমরা পানামা কানালটা নিয়ে নেবো। পানামাকে কোনও প্রশ্ন ছাড়াই নিঃশর্ত ভাবে আমাদেরকে পানামা কানাল হস্তান্তর করতে হবে। পানামার আধিকারিকদের বলছি, আপনারা চুপচাপ আমার কথা শুনে চলুন এবং দ্রুত পানামা কানাল আমাদেরকে হস্তান্তর করুন।

অন্যদিকে নিজের সামাজিক প্রচার মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল এ ট্রাম্প বললেন, "জাতীয় সুরক্ষা ও পৃথিবী জুড়ে মুক্তভাবে চলাচলের জন্য গ্রিনল্যান্ডের দখল ও তার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা আমেরিকার জন্য জরুরি। এছাড়াও, ডেনমার্ক গ্রিনল্যান্ডের ঠিকঠাক দেখভাল করতে পারছে না৷ আমরা করব। আমরা গ্রিনল্যান্ডকে কিনে নেব।" ভাবখানা অনেকটা গুপী গাইন বাঘা বাইনের হাল্লা রাজ্যের মন্ত্রী মশাইয়ের মতো। যিনি শুণ্ডি রাজ্য সম্পর্কে বলেছিলেন, "শুণ্ডি রাজ্য দখল আবশ্যক হয়ে পড়েছে। একেবারে হাতের কাছের পাকা ফল৷ শুধু পেড়ে নিলেই হল।"

বিচ্ছিন্ন ভাবে এই মন্তব্যগুলি শুনলে অনেকেই পাগলের প্রলাপ বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা আদৌ তা নয়৷ পানামা কানাল এবং গ্রিনল্যান্ড দুইই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। উভয়েই ভৌগোলিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ফলস্বরূপ জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা এমনই চূড়ান্ত নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত, যা কিনা জলপরিবহণ ও বিশ্ব বাণিজ্যকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আগামীদিনে উষ্ণ তথা চূড়ান্ত শুষ্ক জলবায়ুর কথা মাথায় রেখে ট্রাম্প সুপরিকল্পিত ভাবে তাঁর দাবার চালটা চলেছেন।

ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার কারণে, বিগত তিন দশকে গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ১১,০০০ বর্গকিলোমিটার হিমবাহ তথা বরফের আচ্ছাদন নিঃশেষিত হয়েছে। এর প্রভাব বোধহয় আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। নাসার হিসেব অনুযায়ী গ্রিনল্যান্ডের সম্পূর্ণ বরফ যদি গলে যায়, তাহলে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস  প্রায় ২৩ ফুট বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মানবসভ্যতার থেকে ব্যবসায়িক স্বার্থকে যাঁরা এগিয়ে রাখে তাদের কাছে এটি মুনাফা অর্জনের একটি অতি লোভনীয় হাতছানি। গ্রিনল্যান্ড জীবাশ্ম জ্বালানী ও বেশ কিছু দুর্লভ খনিজে সমৃদ্ধ। এই খনিজগুলি বিকল্প শক্তির জন্য অপরিহার্য। বিকল্প শক্তির চাহিদা বিগত কয়েক দশকে বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে  এবং সেই চাহিদা যে সময়ের সাথে সাথে আরও বৃদ্ধি পাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বরফের স্তর হ্রাস পাওয়ার সাথে সাথে সুযোগ এসে যাবে জীবাশ্ম জ্বালানি তথা গুরুত্বপূর্ণ দামি খনিজের জন্য যত্রতত্র খননের। বহুজাতিক তেলের কোম্পানি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মুনাফাখোরদের  বহুদিন থেকেই লোভাতুর দৃষ্টি এই গ্রিনল্যান্ডের দিকে। ট্রাম্পের ধামাধারিরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে গ্রিনল্যান্ডকে কিনে নিয়ে তারা চুপচাপ বসে থাকবেন না। তারা খুঁজে বার করবেন তেলের সন্ধান, দুর্লভ খনিজ।

বিশ্ব উশ্নায়ন সম্পর্কিত উপরোক্ত কারণগুলিতে আর্কটিক অঞ্চলে জাহাজের চলাচল বিগত এক দশকে প্রায় ৩৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। বরফের স্তর যত কমবে তত খুলে যাবে বাণিজ্যের রাস্তা। সমস্ত ব্যাপারটাই একটি ফিডব্যাক লুপ বা ভিসিয়াস সাইকেলের মতো কাজ করছে। যত গলবে  বরফ তত বাড়বে বাণিজ্য পথে যাতায়াত। তত আরও কমবে বরফের স্তর। বাণিজ্য পথে জাহাজ চলাচল আরও ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনছে। বেশিরভাগ জাহাজের নকশাই আর্কটিকের উপযুক্ত নয়। ফলতই তেল এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক আর্কটিকে ছড়িয়ে পড়ছে,  মিশে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আর্কটিক এর বাণিজ্যপথেও পরিবর্তন হচ্ছে।

তার বিগত মেয়াদকালের প্রথম থেকেই ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনকে অলীক, ভাঁওতা বা ধাপ্পাবাজি বলে আসছেন। কিন্তু তাঁর পানামা ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে হুঙ্কার এর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনই কাজ করছে। দক্ষিণপন্থী ও ট্রাম্প ঘেঁষা, ফক্স নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে  ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, গ্রিনল্যান্ড, আর্কটিক থেকে উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত একটি প্রশস্ত ভৌগোলিক যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতে পারে। ভবিষ্যতে পৃথিবীর উষ্ণতা যত বাড়বে আর্কটিক ততই বাণিজ্য৷ চলাচলে কৌশলগত গুরুত্ব লাভ করবে, যা কিনা পরিশেষে পানামা কানাল এর ব্যবহার হ্রাস করবে। কারণ গ্রিনল্যান্ড দিয়ে বাণিজ্যিক যাতায়াত চালু করা গেলে সেই রাস্তা হবে সংক্ষিপ্ততম, কানালের মাধ্যমে যাতায়াতের থেকেও কম এবং কানালের ভাড়াও দিতে হবে না। পানামা কানাল অতলান্তিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। প্রতিবছর ২৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্যের যাতায়াত হয় এই জলপথে। এশিয়া আর মার্কিন মুলুকের পূর্ব উপকূলের মূল যোগসূত্র এটি । প্রতি মাসে ১০০০ টি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। প্রতি বছর প্রায় পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব আদায় হয়। পানামা ক্যানাল থাকার দরুণ জাহাজগুলোকে কেপ হর্নের মত বিপজ্জনক জলপথ ব্যবহার করতে হয় না। প্রায় ৭০০০ মাইলের মতো যাত্রা বেঁচে যায় তাদের। সব মিলিয়ে যা কিনা বেশ কিছুটা খরচ বাঁচিয়ে দেয়। তা ছাড়া কেপ হর্নের হিমশীতল, চূড়ান্ত অনিশ্চিত আবহাওয়া, সামুদ্রিক স্রোত, জলোচ্ছ্বাস, হিমশৈল যে কোনও নাবিকের কাছেই দুঃস্বপ্ন। কিন্তু ২০২৩ এর দীর্ঘস্থায়ী খরা পানামা খালের সর্বনাশ ঘটায়। ঘাঁটুন লেক যা কিনা ক্যানালের প্রধান জলাধার তাঁর জলস্তর রেকর্ড পরিমাণ নীচে নেমে যায়। পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে আধিকারিকরা হ্রদের মিঠা জলকে বাঁচানোর জন্য জল পরিবহণের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি করেন। হপ্তার পর হপ্তা ধরে অপেক্ষমান জাহাজের সারি আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেন, বা সরবরাহে ডমিনো প্রভাব ফেলে। এল নিনোর মতো পর্যায়ক্রমিক প্রাকৃতিক ঘটনা এই দুর্দশার অন্যতম প্রধান কারণ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনও এই শুখা উষ্ণ আবহাওয়া দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সমানভাবে দায়ী। আধিকারিকরা ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ইন্ডিও নদীতে বাঁধ দিয়ে মিষ্টি জল সংরক্ষণের পরিকল্পনা করছেন। জলবায়ু পরিবর্তন পানামা ক্যানালকে আরো বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পানামা ক্যানাল এ সারি দেওয়া প্রবেশদ্বার সহ অনেকগুলি চেম্বার্স আছে। যাকে কিনা লক সিস্টেম বলে। লক সিস্টেম জাহাজগুলিকে দরকার মতো উপরে তুলে বা নীচে নামিয়ে, অতলান্তিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের উচ্চতার যে ব্যবধান আছে তা যাতে জাহাজগুলির মসৃণ চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করতে পারে তা সুনিশ্চিত করে। সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান জলস্তর, লক সিস্টেমের পক্ষে আশঙ্কাজনক। ২০২৩ এর নিদারুণ খরার সময় পানামা খালের জলস্তর নেমে যাওয়ায় জাহাজ চলাচলের পক্ষে তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। চলাচলকারী জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায়, জাহাজ-প্রতি মাসুল বৃদ্ধি পায়। পানামা ক্যানেলের ট্র্যাফিকের ৪০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের । আবার মার্কিন মুলুকের ৭৫% জলপথ পরিবহণ হয় পানামা ক্যানাল এর মধ্য দিয়ে। ট্রাম্প এটাকেই হাতিয়ার করতে চেয়েছেন। কিন্তু এই মাশুল বৃদ্ধি শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর সমস্ত দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
 

সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে শুষ্ক ও উষ্ণ পৃথিবীতে গ্রিনল্যান্ড ও পানামা ক্যানাল যে ভৌগোলিকভাবে, কূটনৈতিকভাবে, ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে তা ট্রাম্পের মতো, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিধারী ব্যবসাদার লোকের পক্ষে বোঝা একেবারেই অসুবিধাজনক নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে গা গরম করতে শুরু করে দিয়েছে। তাঁর আস্ফালনের জবাব ট্রুম্প ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন। আস্ফালন এর প্রত্যুত্তরে পানামার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, পানামা খালের প্রতিটি স্কোয়ার মিটার ও তার সংলগ্ন এলাকা পানামার ছিল, আছে ও থাকবে। পানামার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনও আপস করা হবে না। একই রকম উত্তর এসেছে ডেনমার্কের কাছ থেকে। ডেনমার্ক তথা গ্রিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপ্রধানরা পরিষ্কার বলছেন, গ্রিনল্যান্ড একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল। এটি বিক্রির বস্তু নয়  গ্রিনল্যান্ডের মতো স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের স্বাধীনচেতা মানুষজন কখনওই মার্কিনী নিয়ন্ত্রণে যেতে চাইবেন না। নিজ দেশে চূড়ান্ত দক্ষিন পন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করলেও,   যুদ্ধবিধ্বস্ত বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ট্রাম্পের এই সকল কৌশলগত মন্তব্য, অতিরিক্ত উত্তেজনা বৃদ্ধি ছাড়া বর্তমানে আর কিছু করেনি। বিশ্ব রাজনীতি, বাণিজ্য ও কূটনীতির পক্ষে এটি কতটা স্বাস্থ্যকর হবে তা সময়ই বলবে।

Your Opinion

We hate spam as much as you do