সফদর এমন একজন অনন্য সংগ্রামী মানুষ-নাট্যকর্মী-কবি-চিত্রশিল্পী-রাজনৈতিককর্মী-সংগঠক, যাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে মাথা-মেরুদণ্ড-মন-ভাষা-চেতনা সবকিছুই যেন আরও আরও সতেজ-প্রানবন্ত-দৃঢ়-শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দিল্লিতে ১৯৫৪ সালের ১২ এপ্রিল অর্থাৎ আজকের দিনেই জন্ম তাঁর। স্বীকার করতে বাধা নেই, তাঁর জন্মদিন সকলে 'সেলিব্রেট' করে না।
সফদর হাসমি মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো।
02 jan 2023
“এই মৃত্যুশোক
কাঁধ থেকে নামানো যাবে না কোনোদিন।
আর বর্বরতা কি নির্বোধ।
যেন মৃত্যু হলেই মুছে যায়
প্রতিজ্ঞার প্রাণ।
আক্রমণ কোনো নতুন শব্দ নয়।
হিংসা কোনো নতুন শব্দ নয়।
নতুন শব্দ-সফদর হাসমি।
সফদর হাসমি মানে জাগা,
জেগে থাকা, জাগানো।”
কবি পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর রক্তিম বিষয়ে আলোচনার ‘নতুন শব্দ’ কবিতায় এভাবেই বর্ণনা করেছিলেন সফদর হাসমিকে। কবির আবেগ, শব্দচয়ন কখনই নিছক কল্পনা বা বিনোদন হতে পারে না, তার মধ্যে নিহিত থাকে শাশ্বত দূরদর্শিতা। আর সেকারণেই ‘সফদর হাসমি মানে জাগা, জেগে থাকা, জাগানো’ এ কথা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সেকারণেই তাঁর নাটক ‘হাল্লা বোল’ আজও এ দেশ তথা বাংলার ছাত্রযুব আন্দোলনের অন্যতম স্লোগান হয়ে ওঠে; সেকারণেই ‘হাল্লা বোল’ থেকে অনুপ্রাণিত ‘হাল্লা গাড়ি’ ছুটছে বাংলার জেলায় জেলায়। সেকারণেই 'হাল্লা বোল' শব্দজোড়া কোনও নির্দিষ্ট ভাষার আওতায় সীমাবদ্ধ থাকে না। 'হাল্লা বোল' কালের কন্ঠ, দুর্বৃত্তের চোখে চোখ রেখে ব্যারিকেড ভাঙার ঝঙ্কার, রুখে দাঁড়ানো নিপীড়িতদের ঘাম আর রক্তের চিৎকার।
সফদর এমন একজন অনন্য সংগ্রামী মানুষ-নাট্যকর্মী-কবি-চিত্রশিল্পী-রাজনৈতিককর্মী-সংগঠক, যাঁর সম্পর্কে কথা বলতে গেলে মাথা-মেরুদণ্ড-মন-ভাষা-চেতনা সবকিছুই যেন আরও আরও সতেজ-প্রানবন্ত-দৃঢ়-শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দিল্লিতে ১৯৫৪ সালের ১২ এপ্রিল অর্থাৎ আজকের দিনেই জন্ম তাঁর। স্বীকার করতে বাধা নেই, তাঁর জন্মদিন সকলে 'সেলিব্রেট' করে না। কারণ, চটুল বিনোদনে মানুষের মন জয় করার পদ্ধতি রপ্ত করার বদলে তিনি চেয়েছিলেন চটুল বিনোদনের মুখোশের আড়ালে দমিয়ে রাখা সামাজিক-মানবিক অবক্ষয়ের মুখ মানুষের সামনে তুলে ধরতে। এই চাওয়া কি সকলের থাকে?
১৯৭৫-এ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করেন এবং ছাত্রাবস্থাতেই গভীর সমাজ-রাজনৈতিক সচেতনতা বোধ থেকে যোগ দেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন- ভারতের ছাত্র ফেডারেশন(এসএফআই)-এ। পরে যুক্ত হন ‘ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন’ (গণনাট্য সংঘ)-এর সঙ্গে। ১৯৭৩-এ যখন দেশ উত্তপ্ত, সেই পরিস্থিতিতেই ক’জন মিলে গঠন করেন জননাট্য মঞ্চ ‘জনম’।দিল্লিতে পড়াশোনা শেষে কিছু সময় দিল্লির জাকির হোসেন কলেজ এবং শ্রীনগর, গারওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলা এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রেস ইনফর্মেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকার পর ১৯৮৩ সালে তিনি সম্পূর্ণভাবে থিয়েটারে ও রাজনৈতিককর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
বাম রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ গণসঙ্গীত, গণনাট্য, নবনাট্য। যেমনভাবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, বাদল সরকারের মতো ব্যক্তিত্বরা রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছেন, বিকল্প নাটকের ভাষাকে তীক্ষ্ণ করেছেন, তেমনভাবেই বাংলার মানুষ না হয়েও বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সফদর।
‘বিকল্প’ শব্দটার মধ্যেই একটা প্রতিস্পর্ধার গন্ধ পাওয়া যায় সেই সত্তরের দশক থেকেই বাদল সরকারের হাত ধরে ‘শতাব্দী’ নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে বাংলা নাটক প্রসেনিয়ামের গন্ডি অতিক্রম করে পাড়ি জমিয়েছিল নন-প্রসেনিয়ামের আঙিনায়। শুধু বাদল সরকার নন, ভারতীয় থিয়েটারে তার অব্যবহিত পরেই চলে এসেছেন আরও একজন বিকল্পসন্ধানী থিয়েটার কর্মী সফদর হাসমি।
অ্যাজিটপ্রপধর্মী পথ-নাটিকা থেকে বেশ কিছুটা আলাদা হয়ে বাদল সরকার এবং সফদর হাসমি পথে-অঙ্গনে বিকল্প থিয়েটারের নন্দনতত্ত্ব নির্মাণ করলেন। ‘মিছিল’ থেকে ‘মেশিন’, ‘ভোমা’ থেকে ‘আওরত’ কিংবা ‘ভুল রাস্তা’ থেকে ‘হাল্লা বোল’– কাতারে কাতারে মানুষ মঞ্চের বাইরে দাঁড়িয়েই থিয়েটারের মধ্যেই স্বাদ পেয়েছে মুক্তির, সাধ জন্মেছে বদলে দেবার। আর সেই জন্যই কার্জন পার্কে প্রবীর দত্ত থেকে দিল্লিতে সফদর হাসমি, আক্রমণের নিশানা হয়েছে পথনাটকই। কাদের জন্য, কী উপায়ে, কম সময়ে ও কম খরচে কার্যকরভাবে জনগণের বিভিন্ন সমস্যা ও সংগ্রামে প্রতিক্রিয়া জানানো যায় এবং অবহেলিতদের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের সংগঠিত করবার কাজের সহযোগী হিসেবে পথ নাটককে এগিয়ে নিতে হয়, সফদর হাসমি তা তাঁর স্বল্প সময়ের জীবনে দেখিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা, অঙ্গীকার, বিপ্লবের ভাষা সবার মধ্যে জাগিয়ে তোলার অদম্য উদ্দীপনা মানুষের জন্য এক বিরল এবং অতিপ্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত।
সফদরকে নিয়ে অনেক কথাই আমি লিখলাম, এবার এখানে উল্লেখ করব সফদরের নিজস্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মে মাসে উট্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটারকর্মী Eugene van Erven এর কাছে দেওয়া সফদর হাসমির এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ভারতের সংগঠিত গণনাট্য আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন,
“যে ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি আমাদের সমগ্র দেশ দখল করেছে এবং আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে তার থেকে নিজেদের মুক্ত করবার প্রয়োজন আমরা সবাই অনুভব করি। আমরা সবাই এমন আঙ্গিকে কাজ করতে চাই যার সঙ্গে জনগণ পরিচিত এবং যা জনগণ শতশত বছর ধরে নিজেদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি যদি ঐতিহ্যবাহী আঙ্গিক ব্যবহার করতে যাই সেই আঙ্গিকের সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, সামন্ত কাঠামো, এমনকি প্রাক সামন্ত কাঠামোর চিন্তাভাবনা সম্বলিত বিষয়বস্তুও চলে আসে। ঐতিহ্যবাহী ফর্মকে কাঁচি চালিয়ে তার বিষয়বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করে গ্রহণ করা যায় না। কেননা এ দু’টি অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার অনেক গণনাট্য শিল্পী একাজ অনেকখানি সাফল্যের সঙ্গে করতে সক্ষম হয়েছেন। আমাদের থিয়েটারে আমরাও অনেক গান ব্যবহার করি যেগুলো ঐতিহ্যগত ভঙ্গি বা সুরসমৃদ্ধ। কিন্তু তারপরও আমি দাবি করতে পারি না যে তাত্ত্বিক বা প্রায়োগিক দিক থেকে এই প্রশ্নটির সমাধান হয়েছে। আরও উল্লেখ করবার মত বিষয় হচ্ছে যে, সরকারি আধা সরকারি এবং বিদেশী তহবিলপ্রাপ্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যাপক আকারে আমাদের ঐতিহ্যগত লোক ও পাহাড়ি শিল্পধারাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করছে। ঐতিহ্যবাহী জিনিস যখন নতুন করে বিকশিত হচ্ছে তখন একই সঙ্গে হাজাররকম পিছিয়ে পড়ার চিন্তাও তাঁর সঙ্গে বিকশিত হচ্ছে।”
থিয়েটার এবং সচেতনতা নিয়ে তিনি আরও বলেন,
“বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা মনে করেন যে, ভারতীয় ভাব মানে হচ্ছে দেবদেবী, অগ্নি বা বুদ্ধ উপাসনা, তীরধনুক ইত্যাদি। কিন্তু আরও অনেকের সঙ্গে আমিও মনে করি যে, এসব জিনিস থিয়েটারকে ভারতীয় সঠিক চরিত্র দান করবার চাইতে বেশি করে তাকে আরও পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। থিয়েটারকে এ থেকে মুক্ত করা জরুরি। এর মানে এটা নয় যে, আমরা ঐতিহ্যিক শিল্প মাধ্যমগুলো বর্জনের কথা বলছি। দু’ধারার ঐতিহ্য আছে বলে আমরা মনে করি। আসলে ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের একটি সমালোচনামূলক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। দেশের ক্ষমতাশীল মানুষেরা চায় যে আমরা ঐতিহ্যের প্রতি প্রাণহীন আনুগত্য প্রকাশ করি।”
(তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি সংকলিত হয় সফদর হাসমি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রকাশিত ‘দ্য রাইট টু পারফর্ম : সিলেক্টেড রাইটিংস অব সফদর হাসমি’ গ্রন্থে)
তাঁর বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যায়, কখনই ঐতিহ্যবিরোধী ছিলেন না তিনি, ঐতিহ্যকে নিজের ভাষায় প্রাসঙ্গিকভাবে সঙ্গে নিয়ে চলাতেই বিশ্বাসী ছিলেন। সফদর বিশ্বাস করতেন, যদি ঐতিহ্য জীবন্ত হয়, যদি সেটা কারোর মধ্যে থাকে, তাহলে এমনিই তা সৃষ্টিশীল প্রকাশের মধ্যে একটা স্থান করে নেবে। আমাদের উচিত নিজেদের মতো কথা বলা।
নাটককে হাতিয়ার করে তিনি জনগণকে যেভাবে উদ্বুদ্ধ, আলোড়িত ও সংগঠিত করছিলেন ঠিক তেমনভাবেই বিক্ষুব্ধ ও অসহিষ্ণু করে তুলছিলেন একদল অনুচিত-বিরূপ-অসচেতন শ্রেণীকে। তারই ফলাফল তাঁর নির্মম হত্যাকান্ড। ১৯৮৯ সালের ১ জানুয়ারি দিল্লির কাছে শহীদাবাদে শ্রমিক এলাকায় ‘হাল্লা বোল’ নাটক মঞ্চস্থ করতে গিয়ে তিনি একদল রাজনৈতিক গুণ্ডাবাহিনীর হাতে গুরুতর জখম হন এবং নিহত হন পরিযায়ী শ্রমিক রাম বাহাদুর। ২ জানুয়ারি সফদরেরও মৃত্যু হয়।
সফদরেরও মৃত্যুতে ‘জনম’ শোকে পাথর হয়ে থাকেনি। ঘটনার প্রতিবাদে তাঁর মৃত্যুর ঠিক ২ দিন পর ৪ জানুয়ারি হামলার জায়গায় ‘হাল্লা বোল’ মঞ্চস্থ করেন সফদরের স্ত্রী মলয়শ্রী হাসমি। শাসক-শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার যে ধারা সফদর শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, যার অপরাধে তাঁকে খুন হতে হয়, তাঁর মৃত্যু সেই ধারাকে আরও কয়েকগুন শক্তিশালী করে তোলে। সফদর আসলে কেউ নন, কোনও মানুষ নন। সফদর এক সাহসী আলোর নাম। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন নামে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যে আলো নির্মম অন্ধকারে অনিবার্য আঘাত করে। এই বাংলা, এই দেশে, এই পৃথিবীতে যতদিন নৈরাজ্যের আস্ফালন থাকবে, ততদিন ‘একজন’ সফদর হাসমিও বেঁচে থাকবেন মানুষের জন্য।
We hate spam as much as you do