Tranding

05:56 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / 'এক জাতি,এক নির্বাচন ' ভাবনা ভারতের গনপরিষদের চিন্তার পরিপন্থী

'এক জাতি,এক নির্বাচন ' ভাবনা ভারতের গনপরিষদের চিন্তার পরিপন্থী

যে কোন সময় উপ-নির্বাচন হতে পারে সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে সচেতন ছিলেন, তাই তিনি যোগ করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, “পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হতে পারে। ফলস্বরূপ, ভোটার তালিকা সর্বদা আপ টু ডেট রাখতে হবে যাতে কোনও অসুবিধা ছাড়াই নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

'এক জাতি,এক নির্বাচন ' ভাবনা ভারতের গনপরিষদের চিন্তার পরিপন্থী

'এক জাতি,এক নির্বাচন ' ভাবনা ভারতের গনপরিষদের চিন্তার পরিপন্থী 


এস এন সাহু, 3 অক্টোবর, 2024
অনুবাদ চিরন্তন গাঙ্গুলী 

 
ভারতবর্ষের মোদি জমানায় ক্রমাগত গণ পরিষদ এর আইন এবং বি আর আম্বেদকরের দৃষ্টিভঙ্গি কে অবহেলা করা হচ্ছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বাতিল করবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এক দেশ এক ভোট প্রকল্প বা চিন্তাধারা তারই প্রতিফলন
এটা ভেবে দেখা দরকার যে গত ১৮ ই সেপ্টেম্বর ভারতের মন্ত্রিপরিষদ এক দেশ এক ভোটের যে প্রস্তাব রামনাথ কোবিন্দ কমিশনের প্রস্তাব ছিল তা গ্রহণ করা হয়েছে যা অবশ্যই ভারতবর্ষের সংবিধান প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা


যখন গণপরিষদ খসড়া সংবিধানের 289 অনুচ্ছেদ (সংবিধানের অনুচ্ছেদ 324 অনুচ্ছেদ) 15 এবং 16 জুন, 1949-এ ভারতের নির্বাচন কমিশন স্থাপনের বিষয়ে আলোচনা করেছিল, তখন এই জাতীয় প্রস্তাব কখনও আসেনি।

অতএব, কোবিন্দ কমিশনের উল্লিখিত সুপারিশ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা দ্বারা তা নীতিগতভাবে গ্রহণ করা গণপরিষদের আইনী অভিপ্রায়ের স্পষ্ট লঙ্ঘন।


আম্বেদকর কখনই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ধারণাটি কল্পনাও করেননি -----------------------------
১৯৪৯ সালের ১৫ জুন গণপরিষদে ডক্টর বি.আর. আম্বেদকর 289 অনুচ্ছেদটি স্থানান্তরিত করেছিলেন যা অন্যদের মধ্যে প্রদান করা হয়েছিল যে ভোটার তালিকা তৈরির তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা এবং নিয়ন্ত্রণ এবং সংসদ এবং প্রতিটি রাজ্যের আইনসভার সমস্ত নির্বাচন পরিচালনার ভার স্বাধীন পৃথক একটি সংস্থার উপর ন্যস্ত করা হবে। তাকে নির্বাচন কমিশন বলা হয়।

ডাঃ বি.আর.আম্বেদকর সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে  গভীরভাবে সচেতন ছিলেন যে, যে কোনো সময় উপ-নির্বাচন হতে পারে ।

তিনি তখন বলেছিলেন যে নির্বাচন কমিশন একটি স্থায়ী সংস্থা হবে যার একজন প্রধান থাকবে যাকে নির্বাচন কমিশনারকে বলা হবে ও তার হাতে একটি প্রাথমিক ব‍্যবস্থা থাকবে নির্বাচন পরিচালনার জন্য। তিনি বলেছিলেন যে "সাধারণত পাঁচ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে"।

যে কোন সময় উপ-নির্বাচন হতে পারে সেই পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে সচেতন ছিলেন, তাই তিনি যোগ করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, “পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হতে পারে। ফলস্বরূপ, ভোটার তালিকা সর্বদা আপ টু ডেট রাখতে হবে যাতে কোনও অসুবিধা ছাড়াই নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

“অতএব, মনে করা হয়েছিল যে এই প্রয়োজনীয়তাগুলি বিবেচনায় রেখে, মূখ্য  নির্বাচন কমিশনার হিসাবে ডাকা হওয়ার জন্য স্থায়ীভাবে একজন কর্মকর্তাকে অধিবেশনে রাখা যথেষ্ট হবে, যখন নির্বাচন আসছে তখন রাষ্ট্রপতি স্থায়ী ব‍্যবস্থার সাথে আরও কিছু যুক্ত করতে পারেন। এর মধ‍্যে নির্বাচন কমিশনে অন্য সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে ।"

মোটামুটি স্পষ্টতই, ডক্টর আম্বেদকর গণপরিষদে যে উক্তি করেছিলেন যে নির্বাচন সাধারণত পাঁচ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে এবং যদি একটি বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয় তবে পাঁচ বছরের সময়সীমার মধ্যে আরেকটি নির্বাচন পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা দেখা যেতে পারে।  ভারতে সবসময় একসাথে লোকসভা  বিধানসভা নির্বাচন সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না।

শিবন লাল সাক্সেনার বক্তব্য 
-----------------------------------------

গণপরিষদের আর একজন বিশিষ্ট সদস্য শিবন লাল সাক্সেনা 289 ধারার উপর আলোচনায় অংশ নেওয়ার সময় ডঃ আম্বেদকরের করা বিষয় উল্লেখ করেছিলেন, যে নির্বাচন পরিচালনার পরে নির্বাচন কমিশনের পর্যাপ্ত কাজ নাও থাকতে পারে এবং তাই এটি শুধুমাত্র প্রধান নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে প্রয়োজনে কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ করা হবে।

সাক্সেনা আরও বলেন, "আমাদের সংবিধানে, সমস্ত নির্বাচন সুসংগত হবে না তবে সেগুলি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইনসভায় পাস হওয়া অনাস্থা ভোট এবং এর ফলে বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যেতে পারে ।"

এমনকি তিনি এই চিন্তাগুলি প্রকাশ করার আগে তিনি বলেছিলেন, "আমাদের সংবিধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি নির্দিষ্ট চার বছরের সময় পর নির্বাচন করে না।  সম্ভবত প্রায় সারা বছরই কোনো না কোনো রাজ‍্যে নির্বাচন চলতে পারে।”

 

ভারতীয় ইউনিয়নে রাজ্যগুলির একীভূত হওয়ার পরে ভারতের প্রায় ত্রিশটি প্রদেশ থাকবে তা উল্লেখ করে তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে "আমাদের সংবিধানে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে যখন একটি অনাস্থা পাস হয়" এবং প্রাজ্ঞভাবে মন্তব্য করেছিলেন, "তাই এটি খুব সম্ভব যে প্রদেশ এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন আইনসভার নির্বাচন একযোগে হবে না বা হওয়া সম্ভব নয় "

তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, "প্রতিবারই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো নির্বাচন হবেই।" তারপর তিনি খুব ভবিষ্যদ্বাণীমূলকভাবে বলেন, “প্রথম বা প্রথম পাঁচ বা দশ বছরে এমনটা নাও হতে পারে। কিন্তু দশ-বারো বছর পর প্রতি মুহূর্তে কোনো না কোনো প্রদেশে কোনো না কোনো নির্বাচন হবে।”

তিনি বলেন, "অতএব, একটি স্থায়ী নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হলে এটি অনেক বেশি লাভজনক এবং উপযোগী হবে - শুধুমাত্র প্রধান নির্বাচন কমিশনার নয়, কমিশনের তিন বা পাঁচ সদস্য যারা স্থায়ী হওয়া উচিত এবং যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন।"

তিনি এই ধারণাটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন যে নির্বাচন কমিশন কাজের ক্ষেত্রে কোনো সমস‍্যা হবে কারণ, তার মতে, সরকার পতনের পরে আইনসভাগুলির অকাল বিলুপ্তির পরে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে ঘন ঘন নির্বাচন করা যেতে পারে , অন্যদের মধ্যে, তাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাসের ভিত্তিতে।

1949 সালে শিব্বান লাল সাক্সেনার দাবি যে "আমাদের সংবিধান অনুসারে , সমস্ত নির্বাচন একযোগে হবে না" তার এই বক্তব্যই একযোগে নির্বাচন না করার জন্য গণপরিষদের আইনী অভিপ্রায়কে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে।


1949 সালে শিব্বান লাল সাক্সেনার দাবী যে "আমাদের সংবিধানে সমস্ত নির্বাচন একত্রিত হবে না"  এই বক্তব্য 
মোদী সরকারের বর্তমান গৃহীত আইন লোকসভা এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির জন্য একই সাথে  নির্বাচন পরিচালনা করার যে সিদ্ধান্ত তার সাথে স্পষ্টভাবেই এক নয়।


এটি ডঃ আম্বেদকরের উল্লিখিত বিবৃতির সাথে মিলে যায় যিনি বলেছিলেন যে নির্বাচন "সাধারণত পাঁচ বছরের শেষে অনুষ্ঠিত হবে" এই  সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন যে একটি আইনসভা তার নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছরের আগে ভেঙে যেতে পারে এবং এটির জন‍্য আর একটা মধ‍্যবর্তি নির্বাচন  প্রয়োজন হবে। 


আর.কে. সিধওয়ার অবস্থান
-----------------------------------------

আরেকজন বিশিষ্ট সদস্য, আর.কে. সিধওয়া, সাংবিধানিক পরিষদে নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনার সময় বলেছিলেন, “আমাদের এখন সমস্ত প্রদেশে প্রায় 4,000 সদস্য থাকবে এবং সেখানে উপনির্বাচন হবে। নিশ্চয়ই, প্রতি মাসে দু-তিনটি নির্বাচন হবে- কেউ মারা যাবে, কেউ উচ্চ পদে পদোন্নতি পাবে- কেউ এদিক-সেদিক যাবে।"

“এই গণপরিষদে,” তিনি বলেন, “অল্প সময়ের মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি উপ-নির্বাচন করেছি যদিও তাদের সাথে আমাদের কিছু করার ছিল না, কিন্তু তারা যে জায়গা থেকে এসেছে সেখানে বেশ কয়েকটি নির্বাচন হয়েছে। "


তাই তিনি বলেন যে, প্রয়োজনীয়তা এবং নিরপেক্ষতা ছাড়াও, নির্বাচন কমিশনের উচিত একটি ন্যায়সঙ্গত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার জন্য কাজ করা, যা  বিভিন্ন সরকারি  নির্বাহী বিভাগের  যারা ভোটার তালিকায় নাম তোলে তারা প্রায়ই প্রচুর ভূল করে। 

একটি নির্বাচনে ভোটার তালিকাকে প্রধান বিষয় হিসাবে বর্ণনা করে তিনি একাধিক নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠনের আবেদন করেন।


নির্বাচন কমিশনকে একটি ন্যায়সঙ্গত ভোটার তালিকা প্রস্তুত করতে কাজ করা উচিত যা প্রায়শই নির্বাহী বিভাগের সাথে যুক্তভাবে  যারা এতে নাম তোলে তারা অজস্র ভুল করে।

যারা বলেছেন যে এই উদ্দেশ্য আরও ব‍্যায়বহুল,তিনি তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি  এবং নিরপেক্ষতা, ন্যায্যতা এবং সততার সাথে নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি নির্বাচন কমিশনের জন্য বারবার  আবেদন করেছিলেন।

দায়বদ্ধতার সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে
-------------------------------------------

অতএব, মোদীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার ‘এক জাতি, এক নির্বাচন’ প্রকল্প যা কার্যত কোবিন্দ কমিশনের সুপারিশ নীতিগতভাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত তা আসলে  ড. আম্বেদকরের সংবিধান ও গণপরিষদের আইনী অভিপ্রায়কেই অস্বীকার করছে।।

এই ধরনের সুপারিশ আইনসভাকে বেশিরভাগ সময় সরকারের জবাবদিহি করার সংসদীয় গনতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী। যত তাড়াতাড়ি এই সুপারিশ পরিত্যাগ করা হবে, জবাবদিহিতার আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য এটি ততই মঙ্গলজনক হবে যা গত দশ বছরে মারাত্মকভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।

Newsclick এ প্রকাশিতর অনুবাদ

Your Opinion

We hate spam as much as you do