প্রথম দিকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিবছর একটি করে বিশ্ব কংগ্রেস ডাকত (১৯১৯, ১৯২০, ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৪)। ১৯২১-এর তৃতীয় কংগ্রেসে উপনিবেশ-আধা উপনিবেশের কমিউনিস্টরা দলিল-দস্তাবেজ লিখলেও সেগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১০১. এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষনে প্রতিষ্ঠা
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার শতবর্ষ নিয়ে বাম মহলে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। অথচ বিস্ময়করভাবে, ভারতের জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারা এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সংযুক্তি ঘটিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার চিন্তা ও অনুপ্রেরণা এসেছিল যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং মুলত সোভিয়েত বিপ্লব থেকে, তা নিয়ে আলোচনা, সেই ঐতিহ্যের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা বা কোনও ধরনের গভীর চর্চা কার্যত অনুপস্থিত।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে নরমপন্থী ও বিপ্লবী, এই ভাগ নানা আকারে বহুকাল ধরেই ছিল। বিপ্লবীরাও অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের তত্ত্ব ও অনুশীলনের উন্নতি করতে থাকেন। তাই এ কথা আশ্চর্যের নয় যে ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে কড়া সমালোচনা প্রথম এসেছিল ১৮৫৭-র ভারতীয় মহাবিদ্রোহের পর। মার্ক্সের বন্ধু, চার্টিস্ট আন্দোলন নামে বিখ্যাত ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের বামপন্থী নেতা আর্নেস্ট জোন্স এই সমালোচনাটি করেন। কিন্তু সংগঠনগতভাবে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেড়ে ওঠার পর, তার মধ্যে লড়াই বাধে। দ্বিতীয় বা সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক ছিল বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ও জাপানের সমাজতন্ত্রীরা এখানে একত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু জাপান বাদে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশ এখানে অনুপস্থিত ছিল। এই আন্তর্জাতিকের ১৯০৭ সালে অনুষ্ঠিত স্টুটগার্ট কংগ্রেসে দেখা গেল যে সংগঠনের নরমপন্থীরা চাইছেন “সমাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক নীতি”— অর্থাৎ উপনিবেশ থাকবে, কিন্তু শাসক দেশ শাসিতের “উন্নতির জন্য” কাজ করবে। বামপন্থীরা এর বিরুদ্ধে দাবি করেছিলেন যে উপনিবেশবাদ হল পুঁজির শাসনের এক উৎকট রূপ তাই সরাসরি এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ১৯১৪ সালে যখন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল তখন ওই নরমপন্থীরা নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের পক্ষে অবস্থান নিলেন। আর বামপন্থীদের মধ্যে ফাটল ধরল। একটা অংশ ঐক্যের ধুয়ো তুলে চুপ করে গেলেন।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পরে বলশেভিক নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবে মনে করতেন পুঁজিবাদের চেয়ে উন্নত সমাজ সমাজতন্ত্র গড়তে চাই বিশ্ব বিপ্লব। তাই রাশিয়ার স্বার্থে নয়, আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির স্বার্থে তাঁরা এক নতুন বিপ্লবী আন্তর্জাতিক গড়ার ডাক দিলেন। তাঁরা যে নীতিগুলো সামনে রাখলেন তার মধ্যে ছিল সবার ঐক্য নয়, বিপ্লবীদের ঐক্য; নির্বাচন আর ট্রেড ইউনিয়ন— এই দুই কৌশলের বাইরেও কীভাবে বিপ্লবী রণনীতি গড়া যায় তা দেখা, শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই; সমাজের অন্যান্য শোষিতের সঙ্গে জোট গড়া।
প্রথম কংগ্রেস ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট একটা সভা। কিন্তু ১৯২০-র দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতির সময় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সচেতনভাবে আজ যেসব দেশকে “তৃতীয় বিশ্ব” বা “দক্ষিণের দেশ” বলা হয়, সেই সমস্ত দেশগুলি থেকে বিপ্লবীদের একজোট করার প্রয়াস নেয়। দ্বিতীয় কংগ্রেস একটি প্রস্তাবে বলে পূর্ববর্তী আন্তর্জাতিক (দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক) কার্যত শ্বেতাঙ্গ মানুষের অস্তিত্ব স্বীকারে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই কংগ্রেসে, মেক্সিকোর নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়। তিনি বলেন ১৯১৪-র আগে আন্তর্জাতিকের কাছে ইউরোপের বাইরে জগত ছিল না।
ওই দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় থেকে উপনিবেশ-আধা উপনিবেশগুলোতে কমিউনিস্ট দল গড়ার উপরে জোর দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে গ্রহণ করা হয় এক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। একদিকে উপনিবেশের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কীভাবে তা করা হবে তা নিয়ে লেনিন এবং মানবেন্দ্রনাথ রায় বেশ কিছুটা ভিন্ন মতামত রেখেছিলেন। ভারতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রায়ের বক্তব্য ছিল উপনিবেশের বুর্জোয়ারাও বুর্জোয়া, শ্রমিক বিরোধী। বলশেভিকরা রুশ বুর্জোয়া শ্রেণির তীব্র বিরোধিতা করলেও মনে করেছিলেন যে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে বুর্জোয়া-গণতন্ত্রীদের ভূমিকা থাকবে। লেনিন ও রায়ের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে দুজনের দলিলে পরিবর্তন করা হয়। লেনিন বলেন, তিনি “বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক” কথাটা পাল্টে জাতীয়-বিপ্লবী করছেন কারণ যে বুর্জোয়া মুক্তি আন্দোলন বাস্তবে বিপ্লবী, এবং যারা শ্রমিক-কৃষককে বিপ্লবী চেতনায় সচেতন করার প্রচেষ্টায় বাধা দেবে না, কেবল তাদেরই সমর্থন করা যায়।
অন্যদিকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রবলভাবে চাপ দিল উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নীতিনিষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হতে হবে। শোভনলাল দত্তগুপ্ত এবং জন রিডেল তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন এই কাজটি কত কঠিন ছিল, কিন্তু বলশেভিক নেতৃত্ব কীভাবে প্রান্তিক দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সেই কাজটি করেছিলেন।
প্রথম দিকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিবছর একটি করে বিশ্ব কংগ্রেস ডাকত (১৯১৯, ১৯২০, ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৪)। ১৯২১-এর তৃতীয় কংগ্রেসে উপনিবেশ-আধা উপনিবেশের কমিউনিস্টরা দলিল-দস্তাবেজ লিখলেও সেগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। কিন্তু ১৯২২-এর চতুর্থ কংগ্রেসে ভারত, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, পারস্য সহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে আলোচনার জন্য চাপ দেন। ফরাসি কমিউনিস্টদের তিরস্কার করা হল, কারণ আলজিরিয়া সহ ফ্রান্সের উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে তাঁদের পার্টি যথেষ্ট নীতিনিষ্ঠ ও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছিল না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু এইসব চিন্তাভাবনা তো মস্কোতে হচ্ছিল। ভারতে তার কী হল? এ প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি জরুরি কথা বলতে পারি। প্রথম কথা হল, প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদী সংগঠন গড়া এবং বিপ্লবী নীতি ও কৌশলের তালিম। এই কাজ সচেতনভাবে প্রতিটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রেই করা হত। আমরা একটা বিখ্যাত ইউরোপীয় ঘটনার কথা ভাবতে পারি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ হিসেবে জার্মানির উপর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়েছিল। জার্মানি ক্রমেই তা দিতে অক্ষম হলে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী সরকার চাপ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জার্মানির রূর অঞ্চল দখল করে ১৯২৩-এর গোড়ায়। এর জবাবে জার্মান সরকার রাইখ্স্টাগে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আহ্বান করে, প্রলেতারীয় শ্রেণিগত স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তিতে লড়াই করতে হবে। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করে। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা রোটে ফাহন্ বুর্জোয়া দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের বিরোধিতা স্পষ্ট করে। চান্সেলর উইলহেলম কুনোর সরকার ফ্যাসিবাদী ধাঁচের সংগঠনগুলিকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার করে। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল (সংস্কারপন্থী এবং জার্মানির বৃহত্তম বামপন্থী দল) কার্যত এসব সমর্থন করে। কমিউনিস্ট পার্টি, তার বদলে, ডাক দেয় যে ফরাসি দখলদার ও বার্লিনের দক্ষিণপন্থী সরকার— এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হবে। কুনোর সরকার “জাতীয় সঙ্কটের” ধুয়ো তুলে সামাজিক ব্যয় কমানো, এবং শ্রমিক শ্রেণির ওপর আক্রমণ বাড়ায়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সাধারণ ধর্মঘট হয় যাতে তিরিশ লাখ শ্রমিক অংশ নেন। ইতিহাসবিদ আর্থার রোসেনবার্গ লিখেছেন, ১৯২৩ সালে জার্মানি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে যতটা এগিয়ে ছিল তা আর কখনও ঘটেনি।
এই ইতিহাস দেখার কারণ, একটা আপাত জটিল পরিস্থিতিতে বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদ কীভাবে শ্রেণিসংগ্রামের মোড় ঘোরাতে পারে তা বুঝতে সহায়ক হবে। একই চেষ্টা করা হয়েছিল ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন যখন বলেছিলেন ‘বুর্জোয়া-গণতন্ত্রী’ নয়, কেবল জাতীয় বিপ্লববাদীদের সমর্থন করা যেতে পারে তখন তিনি এবং রায় একমত ছিলেন যে ভারতের মতো উপনিবেশেও বুর্জোয়াদের সবসময় সমর্থন করা যাবে না।
চতুর্থ কংগ্রেসে বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশের পার্টিগুলির সমালোচনা করা হয়, তারা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার হচ্ছেন না বলে। সুতরাং আন্তর্জাতিক যে ধরনের বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতার উপর জোর দিয়েছিল তা থেকে আজকের দিনে কয়েকটা সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি।
প্রথমত, কোনও অবস্থাতেই, এমনকি দেশ যদি সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের দখলে থাকে, তাহলেও নিজের দেশের বুর্জোয়া শ্রেণিকে নিঃশর্ত সমর্থন করা যায় না। প্রথম দরকার, শ্রমিক শ্রেণির এবং বিপ্লবী দলের স্বাধীনতা। তারপর ব্যাপকতর নিপীড়িত মানুষের মধ্যে তার মতাদর্শ নিয়ে যাওয়া। এ থেকে যে কথা আরও বোঝা যায়, তা হল, শ্রমিক শ্রেণির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা আর বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ কর্তৃক প্রচারিত দেশপ্রেম এক নয়। তৃতীয় যে কথা এর সঙ্গে জড়িত তা হল বেশি ক্ষমতাশালী আধিপত্যবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণির এবং কমিউনিস্ট পার্টির কর্তব্য। তাদের ‘নিজেদের’ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি।
আমরা যদি আজকের বিশ্ব বা ভারতের দিকে তাকাই তাহলে বুঝব, স্তালিন যুগে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের গোড়ার দিকের নীতির বর্জন এবং তারপর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের বিলুপ্তি কীভাবে ক্ষতি করেছে। আন্তর্জাতিকতাবাদ যখন পার্টির চেতনা থেকে হারিয়ে যায় তখন প্রতিদিনের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ তাকে নানাভাবে ঘিরে ধরে।
গত শতাব্দীতে ভারতের বামপন্থী রাজনীতিও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে, আর তাতে অক্টোবর বিপ্লব তথা সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আগাগোড়াই।
রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বা তার উত্তরসূরী স্তালিন একটা পর্বে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন, কিন্তু পরে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মাও জে দংয়ের আবেদনই যে ভারতের বামপন্থীদের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাতেও বোধহয় কোনও ভুল নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিসেব করলে দেখা যায় শুধু কমিউনিস্ট নয় রুশ বিপ্লবের প্রভাব ভারতীয় তৎকালীন বিশিষ্ট ইনটেলেকচুয়ালদেরও প্রভাবিত করছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমনকি জাতীয় কংগ্রেস তাদের কার্যপদ্ধতির বদল ঘটায় গান্ধীজীর নেতৃত্বে।
সবচেয়ে বড় কথা, অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব শুধু ভারতে তার পরের কয়েক বছরেই সীমাবদ্ধ ছিল না - বস্তুত গত একশো বছর ধরেই তা এদেশের রাজনৈতিক দর্শনকে প্রভাবিত করে এসেছে,
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গড়ে ওঠা নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সন্ধিক্ষনে।
মতামত লেখকের নিজস্ব
We hate spam as much as you do