Tranding

03:16 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / ১৭ই জানুয়ারি!জ্যোতি বসুর প্রয়াণ দিবসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য( পুনঃপ্রচারিত)

১৭ই জানুয়ারি!জ্যোতি বসুর প্রয়াণ দিবসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য( পুনঃপ্রচারিত)

স্বাধীনতার পরবর্তীতে আমাদের রাজ্যে উদ্বাস্তু আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন — বহুমুখী আন্দোলনে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা ছিল বিধানসভার ভিতরে এবং বিধানসভার বাইরেও। তিনি এই সমস্ত আন্দোলনকে সংগঠিত করতে প্রথম সারির নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিরোধী দলের যে ভূমিকা আছে সংসদীয় গণতন্ত্রে তা তিনি তাঁর জীবন দিয়ে, তাঁর কর্মপন্থা দিয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিরোধী দলের নেতা হিসাবে তিনি সফলভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৭ই জানুয়ারি!জ্যোতি বসুর প্রয়াণ দিবসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য( পুনঃপ্রচারিত)

১৭ই জানুয়ারি!জ্যোতি বসুর প্রয়াণ দিবসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য( পুনঃপ্রচারিত)

 

সংসদীয় গণতন্ত্র : অদ্বিতীয় জ্যোতি বসু

 

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য 

 

জ্যোতি বসুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন কোনো স্বল্প পরিসরে আলোচনা করতে যাওয়া সম্ভব না। চল্লিশের দশক থেকে তিনি রাজনীতি শুরু করেছেন এবং তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারা, তাঁর পাশে থেকে কাজ শেখা আমার জীবনের এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। এই প্রবন্ধে আমি মূলত সংসদীয় গণতন্ত্রে তাঁর অবদান সম্পর্কে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলব।


তিনি বিধানসভার সদস্য হয়ে এসেছিলেন প্রথম ১৯৪৬ সালে। পরাধীন দেশে যুক্ত বাংলার বিধানসভায় তিনি রেলওয়ে শ্রমিক কনস্টিটিউয়েন্সির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেই ১৯৪৬ সাল থেকে বিধানসভা তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেছে। তখন বাংলাদেশে গ্রামে-গ্রামে চলছে তেভাগা আন্দোলন। তেভাগা সম্পর্কে বিধানসভায় বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন — কিভাবে বাংলার গ্রামে-গ্রামে কৃষকদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম চলেছে, তাদের ফসলের ভাগের জন্য এবং তৎকালীন সরকার কিভাবে সেই কৃষকদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য পুলিস এবং মিলিটারি ব্যবহার করছে। 


পরবর্তীতে স্বাধীনতার পরেও তিনি এ‍‌ই সভায় রাজ্যের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধী নেতা হিসাবে কঠিন দায়িত্ব পালন করে গেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি বরানগর বিধানসভা থেকে নির্বাচিত হয়ে পরে এই সভায় আসেন এবং আবার বিরোধী দলের নেতা হন। স্বাধীনতার পরবর্তীতে আমাদের রাজ্যে উদ্বাস্তু আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন — বহুমুখী আন্দোলনে তাঁর অনবদ্য ভূমিকা ছিল বিধানসভার ভিতরে এবং বিধানসভার বাইরেও। তিনি এই সমস্ত আন্দোলনকে সংগঠিত করতে প্রথম সারির নেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিরোধী দলের যে ভূমিকা আছে সংসদীয় গণতন্ত্রে তা তিনি তাঁর জীবন দিয়ে, তাঁর কর্মপন্থা দিয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিরোধী দলের নেতা হিসাবে তিনি সফলভাবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।

 

পরবর্তীকালে আমরা তাঁকে দেখেছি তাকে দু’টি স্বল্পকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের — (একটা ৯ মাস, একটা ১৩ মাস), উপমুখ্যমন্ত্রী হিসাবে। পরবর্তীতে বাম সরকার আসার পরে তিনি হলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং একটানা ২৩ বছর তিনি সাফল্যের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সংসদীয় রাজনীতির তাঁর কয়েকটি মূল সাফল্য উল্লেখ করতে চাই। সমস্ত কর্মপন্থার মধ্য দিয়ে তিনি রাজ্যের, দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রকে সংহত করা, উন্নত করার চেষ্টা সর্বতোভাবে চালিয়ে গেছেন। তিনি আন্তরিকভাবে গণতন্ত্রকে বিশ্বাস করতেন। 


তাঁর নিজের জীবনে যদিও তিনি বিনাবিচারে জেল খেটেছেন কিন্তু তিনি কখনও অন্যকে বিনাবিচারে জেল খাটাননি — এটাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। তিনি কোনো কালা আইন হাতে নেননি। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করেননি। তিনি আন্তরিকভাবে প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা‌‌য় বিশ্বাস করতেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছেন এবং সেটি প্রমাণ করেছেন। আমরা এটাও ভুলতে পারি না পশ্চিমবাংলা এমন একটা রাজ্য, যেখানে তাঁর নেতৃত্বে সারা দেশের মধ্যে প্রথম হিউম্যান রাইটস কমিশন গঠিত হয়। জাতীয় কমিশন তৈরি হওয়ার পর আমাদের রাজ্যে পশ্চিমবাংলায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম। এই কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর নেতৃত্বে। কারণ তিনি আন্তরিকভাবে যা বিশ্বাস করতেন, সেই কাজ তিনি হাতে-কলমে প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। সারা জীবন ধরে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রকে এইভাবেই প্রস্ফুটিত করার চেষ্টা করেছেন।

 

তাঁর আর একটি দিক সম্পর্কে উল্লেখ করতেই হয় তাঁর জীবন চিন্তায়, তাঁর কর্মধারায়, তাঁর রাজনীতিতে তিনি সর্বাঙ্গীণভাবেই ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। কোনো অবস্থাতেই কোনো ধার্মিক সাম্প্রদায়িক চিন্তা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি, স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি বড় বড় দু’টি ঘটনায় তার প্রমাণ রেখেছেন এই রাজ্যে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর সারা দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও শিখ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটা সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের রাজ্যে সেই আগুনের উত্তেজনার আঁচ আমরা পেয়েছিলাম কিন্তু এই রাজ্যে কোনো অশান্তি হয়নি। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের রাজ্য সেই অবস্থাটা পেরিয়ে আসতে পেরেছিল। ঠিক একইভাবে যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয় তখন সারা দেশে অনেক কাণ্ড হয়েছে, অবাঞ্ছিত কাণ্ড। আমাদের রাজ্যে সেই আগুনের হলকা এসেছে, কিন্তু শান্তির পরিবেশ রাখতে মূলত সক্ষম হয়েছে। নিশ্চয়ই এতে আমাদের রাজ্যের মানুষের কৃতিত্ব আছে। 

 

কিন্তু সবার উপরে ছিলেন জ্যোতি বসু, একজন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন বলে আমাদের রাজ্যে অশান্তি নেমে আসেনি। আজকে সারা দেশের মানুষ জানেন পশ্চিমবাংলায় ধর্মনিরপেক্ষতা সুরক্ষিত। পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িক শক্তির জায়গা নেই। তিনি এই ঐতিহ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।


সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর বিশেষ ভূমিকা রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কি? শ্রমিক আন্দোলন এবং কৃষক আন্দোলনকে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের মঞ্চের মধ্যস্থলে দাঁড় করিয়েছিলেন। এই দুই শ্রেণী আমাদের দেশে বৈপ্লবিক শক্তি। তাদের চিন্তা, তাদের মুক্তি সেই রাজনীতিকেই তিনি সারা জীবন বিশ্বাস করেছিলেন। তাঁর মুখে শোনা তাঁর ভাষায় একটা ঘটনা এখনও মনে পড়ে জলপাইগুড়ি থেকে আসাম যাচ্ছিলাম ট্রেনে, গোটা ট্রেন অন্ধকার। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, জাপানিজরা বোমা ফেলতে পারে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে চলেছি জলপাইগুড়ি থেকে আসামে শ্রমিকদের মিটিং করার জন্য, অন্ধকার রাতে এই বিপদের মধ্যে যেতেই হবে। বিশ্বাস করেছি শ্রমিক‍‌শ্রেণীর মুক্তি। সেই কাজ করে গেছি, কেউ বাধা দিতে পারেনি। শ্রমিকদের এবং কৃষকদের তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঝখানে দাঁড় করিয়েছিলেন।

(বিধানসভায় ১০ই মার্চ ২০১০ তারিখের বক্তৃতাকে ভিত্তি করে গনশক্তিতে ৭ই জুলাই ২০১৩ লিখিত) 

Your Opinion

We hate spam as much as you do