জার্মানি ও জাপান দুই দেশের কাছেই নেতাজি সাহায্যলাভের আশায় গেছিলেন। কিন্তু কখনোই তিনি হিটলারের 'অপারেশন বারবারোসাকে' সমর্থন করেননি। ফিলিপন্স, চিনে, বর্মাতে জাপ সৈন্যদের বর্বরতাকেও তিনি মেনে নেননি। সহায়তা পেতে তিনি প্রথমে সোভিয়েত রাশিয়াতেই গেছিলেন। কিন্তু তখন রাশিয়ার সাথে নাৎসি জার্মানির তীব্র লড়াই চলছে। স্তালিনগ্রাদ ও ককেশাসে স্তালিন হিটলারকে কড়া প্রতিরোধের মুখে ফেলে দিয়েছেন। তাই যুদ্ধরত রাশিয়া থেকে তাঁকে খালি হাতেই ফিরতে হল। অতএব তাঁকে শিবির বদল করতেই হল। তিনি জার্মানির স্মরণাপন্ন হলেন। কিন্তু জার্মানি তখন রাশিয়ায় প্রবল প্রতিরোধের মুখে। তাই নাৎসি সরকারের থেকে কোনও সহায়তা তিনি পেলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল ও নথিপত্রে দেখা যায় যে নেতাজির সঙ্গে নাৎসি সরকারের মোটেই সদ্ভাব ছিল না। কারণ কোনও প্ররোচনাতেই তিনি স্তালিনের বিরুদ্ধে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য রাখেননি,
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির ভূমিকা ও অক্ষশক্তিবর্গের সঙ্গে সম্পর্ক
উত্থান দাশ
তিনি ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান আজও ভারত বাসীর হৃদয়ে অমলীন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর মুক্তিসংগ্রাম আজও অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। তিনি দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে ফ্যাসিস্টদের সহায়তা চেয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু কখনোই তাঁদের হাতের পুতুলে পরিণত হননি। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তাঁর তৈরী আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তিসংগ্রামের পথ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্বতন্ত্র এবং তাঁর বাহিনীকে কোনওভাবেই মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে পরিচালিত করা যাবে না। তাঁর একমাত্র লক্ষ ছিল পিতৃভূমিকে ইংরেজ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা। তাই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই চালিয়ে যেতে তাঁর কোনও পদক্ষেপ নিয়ে আজ আর কোনও সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৮৫৭ সিপাহী বিদ্রোহ যেভাবে অমর হয়ে থাকবে ঠিক তেমন ভাবেই উপযুক্ত সমরসম্ভার ও আধুনিক যান্ত্রিক যুদ্ধের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও আজাদ হিন্দ ফৌজের গৌরবগাঁথা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আর সেই মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে অক্ষশক্তিবর্গের সহায়তা নিয়ে আজ আর কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই।
স্বয়ং নাৎসি জার্মানির পররাষ্ট্র - দপ্তরের অফিসার ডাঃ এলেক্সান্ডার ওয়ার্থ লিখেছিলেন : " দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তিবর্গের সঙ্গে নেতাজির সম্পর্ক ও তাঁদের সহায়তায় তাঁর মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্লেষণ করে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে যদিও ১৯৪১ - ১৯৪৫ সাল অব্দি নেতাজি অক্ষশক্তিবর্গের দেশগুলিতে ( AXIS COUNTRIES) আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন 'আপসহীন' সংগ্রামী। এবং তার চেয়েও বড় কথা যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন তিনি দেখতেন সেই স্বাধীন ভারতের কান্ডারি হিসেবে দিন রাত রাত এক করে পরিকল্পনা ও নির্মাণকার্য চালিয়ে গেছেন। অক্ষশক্তিবর্গ যুদ্ধে হেরেছে কিন্তু ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জিতেছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র। এবং আগামী দিনে স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠনে তাঁর পরিকল্পনা, চিন্তাধারা ও আদর্শ অনেক জয়লাভ করবে। "
জার্মানি ও জাপান দুই দেশের কাছেই নেতাজি সাহায্যলাভের আশায় গেছিলেন। কিন্তু কখনোই তিনি হিটলারের 'অপারেশন বারবারোসাকে' সমর্থন করেননি। ফিলিপন্স, চিনে, বর্মাতে জাপ সৈন্যদের বর্বরতাকেও তিনি মেনে নেননি। সহায়তা পেতে তিনি প্রথমে সোভিয়েত রাশিয়াতেই গেছিলেন। কিন্তু তখন রাশিয়ার সাথে নাৎসি জার্মানির তীব্র লড়াই চলছে। স্তালিনগ্রাদ ও ককেশাসে স্তালিন হিটলারকে কড়া প্রতিরোধের মুখে ফেলে দিয়েছেন। তাই যুদ্ধরত রাশিয়া থেকে তাঁকে খালি হাতেই ফিরতে হল। অতএব তাঁকে শিবির বদল করতেই হল। তিনি জার্মানির স্মরণাপন্ন হলেন। কিন্তু জার্মানি তখন রাশিয়ায় প্রবল প্রতিরোধের মুখে। তাই নাৎসি সরকারের থেকে কোনও সহায়তা তিনি পেলেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে যুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল ও নথিপত্রে দেখা যায় যে নেতাজির সঙ্গে নাৎসি সরকারের মোটেই সদ্ভাব ছিল না। কারণ কোনও প্ররোচনাতেই তিনি স্তালিনের বিরুদ্ধে, সোভিয়েতের বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য রাখেননি, কোনও বেতার ভাষণে হিটলারের রাশিয়া আক্রমণকে সমর্থন জানাননি। ফলে ১৯৪১ সালে নেতাজির সঙ্গে সাক্ষাতে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেন্ট্রপ ভালো করে তাঁর সাথে কথা পর্যন্ত বলেননি। এর একবছর পর হিটলারের সঙ্গে প্রথম ও শেষ সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাও নেতাজির খুব একটা ভালো হল না। হিটলার ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি তো দিলেনই না, উল্টে মন্তব্য করে বসলেন যে ভারত আগামী ১৫০ বছরেও যেন স্বাধীনতা লাভের যোগ্যতা অর্জনের স্বপ্ন না দেখে। কারণ 'নর্ডিক্ আরিয়ান' নাৎসিরা ভারতের মত পরাধীন দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। এর প্রমাণ পাওয়া যায় হিটলার রচিত 'Mein Kampf' এ। সেখানে ভারতবর্ষের সম্পর্কে নাৎসি একনায়ক বহু অপমানজনক মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু নেতাজির উদ্যমে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়ল না। এর মধ্যে একটি ঘটনা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জাপান থেকে ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়া রাসবিহারী বসুর বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জীবনদ্বীপ নিভু নিভু। তাই তিনি নেতাজিকে জাপানে ডেকে পাঠান ও যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাটন তাঁর হাতে তুলে দেন টোকিও শহরের ইম্পেরিয়াল হোটেলে। এরপর ১০ ই জুন, ১৯৪৩ সালে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেনেরাল তোজোর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। নেতাজির ব্যক্তিত্ব তোজোকে যারপরনাই মুগ্ধ করে এবং তিনি নেতাজিকে সাহায্যদানের প্রতিশ্রুতিও দেন। এই প্রতিশ্রুতির কথা তিনি জাপানি পার্লামেন্টে ঘোষণাও করেন। কিন্তু বাস্তবে তা আর হল কই?
কিন্তু নেতাজি ব্যক্তিগত মুন্সীয়ানায়, সামরিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার জোরে পরাধীন ভারতের বাইরে প্রথম স্বাধীন ভারত সরকার গঠন করেন ২১শে অক্টবর, ১৯৪৩ সালে ও ইঙ্গ - মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
অক্ষশক্তিবর্গ শুধুমাত্র এই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়। তবে স্বাধীন সরকার চালাতে ও সৈন্যবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ জন্যে দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার বহুদেশের সর্বস্তরের মানুষ এগিয়ে এলেন। এইখানে দক্ষিণ - পূর্ব এশিয়ার সংগ্রামী নেতাজির গ্রহণযোগ্যতার খানিকটা আভাস পাওয়া যায়। ভারত - মায়ানমার সীমান্তে অভিযানের আগে আজাদ হিন্দ সরকারের চুক্তি হয়েছিল যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাপানিদের যুদ্ধ সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পথে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ বাহিনী জাপানিদের অঙ্গুলিহেলনে চলবে না। কিন্তু তাঁর নিন্দুকরা তাঁর নামে বহু মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলেন। এদিকে যুদ্ধ চলাকালীন সঠিক তথ্য পাওয়ার সুযোগ না থাকায় আসল ঘটনা কী, তা কখনোই মানুষ জানতে পারতেন না। কিন্তু ক্রমে মানুষ বুঝতে পেরেছেন যে নেতাজি নিজের পিতৃভূমিকে স্বাধীন করতে এক আপসহীন সংগ্রামীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন যিনি তাঁর দেশকে কারোর কাছে বন্ধক রেখে মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হননি, কোনও খারাপ অভিসন্ধির আভাস কোথাও পাওয়া যায় নি। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দেশপ্রেম ও দক্ষ পরিচালনার সৌজন্যে আজাদ হিন্দ বাহিনী প্রথম জয় ছিনিয়ে নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করল ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৪ সালে। আজাদ বাহিনীর হাতে পরপর চলে এল কোহিমা, ময়রাং ও বিষেণপুর। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে 'GRAND ALLIANCE' এই যুদ্ধকে জাপানিদের যুদ্ধ হিসেবেই দেখেছে.
তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার উইন্সটন চার্চিল তাঁর বইয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের 'তান্ডবের' কথা স্বীকার করেছিলেন। এরপর রাসবিহারী বসুর মৃত্যু এবং তার ফলে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হওয়া, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থতার দায় ঘাড়ে নিয়ে হিদেকি তোজো সহ পুরো জাপ মন্ত্রীসভার পদত্যাগ, ইংগ - মার্কিন বাহিনীর পুনরায় বর্মা দখল, বর্মায় মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জেনেরাল হনের বিদ্রোহ, প্রতিকূল পরিবেশ সহ বহু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় আজাদ বাহিনী ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।
অতঃপর নেতাজি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বর্মা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। সোভিয়েতের আশ্রয় লাভের আশায় তিনি মাঞ্চুরিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু নতুন জাপ প্রধানমন্ত্রী জেনেরাল কুনিয়াকী কইসো নেতাজিকে সম্মতি দিলেন না। তারপরের ইতিহাস রহস্যে মোড়া। তাইপে বিমানবন্দরে প্লেন ক্র্যাশে মৃত্যু, গুমনামী বাবা হয়ে আত্মগোপন... তাঁর অন্তর্ধান রহস্যের আজও কিনারা হয়নি। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, অবদান নিয়ে আজ আর কোনও ধোঁয়াশা নেই। আপামর ভারতবাসীর কাছে ও স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে চিরদিনই অমর হয়ে থাকবেন।
We hate spam as much as you do