সূর্য সেন কৈশাের কালেই বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যখন তিনি জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র , তখন অম্বিকা চক্রবর্তী সহ আরও কিছু বিপ্লবী নেতার সংস্পর্শে আসেন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন হেমেন্দ্রলাল। তিনি ছিলেন বরিশাল যড়যন্ত্র মামলার পলাতক আসামি।তাঁর সংস্পর্শে এসে সূর্য সেন জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে ,তাকে চরিত্র গঠন করতে হবে।
আত্মবলিদান দিবসে বীর বিপ্লবী মাষ্টারদা
১২ই জানুয়ারি ২০২৩
"ওরা বীর! ওরা আকাশে জাগাতো ঝড়!
ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে
গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে
আজও রোমাঞ্চকর"
শোষণ-বঞ্চনা দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষ পীড়িত ভারতবর্ষের বুকে চেপে আছে অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করতে দাঁনা বেঁধে উঠছে আপোষহীন ধারার স্বদেশী আন্দোলন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির মঞ্চে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের নির্ভীক আত্মদান নাড়া দিয়েছিল এদেশের তরুণ-যুবকদের। সেই মন্ত্রণায় উজ্জীবিত এক স্কুল ছাত্র ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে উঠলেন এক মহান বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহানায়ক – আমাদের প্রিয় মাস্টারদা সূর্যসেন।
মাস্টারদা’র জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামে। সূর্য সেন বা সূর্যকুমার সেন যিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর ডাকনাম ছিল কালু। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই বাঙালি বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নিজ জীবন বলিদান করেন। সূর্যসেনের বাহিনী কয়েকদিনের জন্যে ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায় "কে জানতো যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে?
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিশোধ! কে জানতো সেই শীর্ন বাহু ও ততোধিক শীর্ন পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে - তার সমস্ত ক্ষমতাকে উপহাস করে বৎসরের পর বৎসর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?"
ছোটবেলায় বাবাকে হারান; পড়াশোনা চালান টিউশন করে। বড় হয়ে স্কুলের অংকের শিক্ষক হিসেবে যেমন সুনাম তেমনি দেশের মানুষের প্রতি প্রবল ভালবাসা, চরিত্রের বলিষ্ঠতায় ক্রমে আকর্ষণ করে তরুণদের। ক্লাসের ছাত্রদের বলতেন দেশের দুরাবস্থার কথা, দেশপ্রেমের কথা, স্বাধীনতার কথা। সূর্যসেন গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের জমি তৈরি করছিলেন।
সূর্য সেন কৈশাের কালেই বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যখন তিনি জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র , তখন অম্বিকা চক্রবর্তী সহ আরও কিছু বিপ্লবী নেতার সংস্পর্শে আসেন। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন হেমেন্দ্রলাল। তিনি ছিলেন বরিশাল যড়যন্ত্র মামলার পলাতক আসামি।তাঁর সংস্পর্শে এসে সূর্য সেন জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে ,তাকে চরিত্র গঠন করতে হবে। কঠিন কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।বহরমপুর কলেজের অধ্যাপক ছিলেন বিশিষ্ট বিপ্লবী নেতা সতীশ চক্রবর্তী। তার সংস্পর্শে এসে সূর্য সেন আরও প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠেন। বিপ্লব মানে যে একটা সর্বাত্মক চেতনা,এমন একটা ধারণার জন্ম হয় সূর্য সেনের মধ্যে। হটকারী সিদ্ধান্তের দ্বারা বিপ্লবকে দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব নয়।তখন থেকেই সূর্য সেন ভবিষ্যতে বিপ্লবী হবার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের গড়া ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার লড়াই শুরু করে। বিপ্লবীরা রেললাইন উপড়ে ফেলে, টেলিগ্রাফ-টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। একদল বিপ্লবী অক্সিলারী অস্ত্রাগার দখল করেন। সূর্যসেন ও অন্যান্য বিপ্লবীরা আক্রমণ করেন সরকারি অস্ত্রাগার। অস্ত্রাগারের রক্ষীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধরাশায়ী হল। অত্যাচারী ইংরেজরা পালাল গভীর সমুদ্রে। অধিকৃত হল সে অস্ত্রাগার। ব্রিটিশ দাম্ভিকতা, অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতীক ‘ইউনিয়ন জ্যাক’কে বিপ্লবীরা ভূলুণ্ঠিত করে উড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার পতাকা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম স্বাধীন হলো চট্টগ্রাম।
মাস্টারদা জানতেন এ স্বাধীনতা সাময়িক। ব্রিটিশ শক্তি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে বিপ্লবীদের। মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আশ্রয় নিলেন জালালাবাদ পাহাড়ে। ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা পরিকল্পনা করলেন শহরে ঢোকার। হঠাৎ দেখা গেল দু’দিক থেকে আসছে ইংরেজ সৈন্য। পালাবার পথ নেই। সম্মুখ লড়াই শুরু হল। শহীদ হলেন অনেক বিপ্লবী বীর। কিন্ত দেশপ্রেমে বলিয়ান বিপ্লবীদের প্রাণপন লড়াইয়ের কাছে হার মানলো আধুনিক অস্ত্রে সাজানো প্রশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্য। বীর শহীদদের প্রতি শেষ অভিবাদন জানিয়ে পাহাড় ত্যাগ করলেন বিপ্লবীরা।
পরবর্তী অপারেশন ইউরোপীয়ান ক্লাব। ক্লাবের ,ভিতরে চলত মদ, নৃত্য আর বিপ্লবীদের ধরার পরিকল্পনা। মাস্টার দা’র আর এক সহযোদ্ধা প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ক্লাব আক্রমণ করা হয়। অপারেশন শেষে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পটাশিয়াম সায়ানাইড পান করে আত্মাহুতি দেন বীরকন্যা প্রীতিলতা।
সূর্য সেনের বিপ্লবী জীবনের সবথেকে বড়াে কৃতিত্ব হল,চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন। যেজন্য তিনি ইণ্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি গঠন করেছিলেন। তাকে প্রভাবিত করেছিল আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি।
১৯৩০ সালের ১৮ ই এপ্রিল -- আয়ারল্যাণ্ডে ইস্টার বিদ্রোহের দিন। এই দিনটিকেই সূর্য সেন নির্দিষ্ট করলেন অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের জন্য। এই কাজে তিনি যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন। মাষ্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘন্টার জন্য ইংরাজশাসন মুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখােমুখি সংঘর্ষ পরেও তারা টানা শেষ তিন বছর। গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাষ্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাষ্টারদা। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। এক জ্ঞাতি ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় সূর্য সেনকে ধরা পড়তে হয় । ১৯৩৩ সালের ১৬ ই ফেব্রুয়ারি এই দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে। ব্রিটিশ সরকারের আদালতে বিচারের নামে হল প্রহসন। বীর বিপ্লবী সূর্য সেনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হল।
ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিটিয়ে সূর্যসেনকে সংজ্ঞাহীন করা হয়। এরপর নিথর দেহ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এতেই ক্ষান্ত হয়নি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। তাঁর লাশ পাথরে বেঁধে জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। ব্রিটিশরা জীবিত সূর্যসেনকে যতটা ভয় পেত, তার থেকে মৃত সূর্যসেনকে বেশি ভয় পেয়েছে।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই জানুয়ারি সূর্য সেনের ফাঁসি হয়। ফাঁসির আগের দিন সূর্য সেন প্রিয় দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন-......
“ ফাঁসির রজু আমার মাথার ওপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় কড়াঘাত করছে। এই তাে আমার মৃত্যুকে বন্ধুর মতাে আলিঙ্গন করার সময়। আমার ভাইবােন , তােমাদের সবার উদ্দেশ্যে বলছি ,আমার বৈচিত্র্যহীন জীবনের একঘেয়েমিকে তোমরা দাও, আমাকে উৎসাহ দাও। এই আনন্দময় পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আমি তােমাদের জন্য কী রেখে গেলাম, শুধু একটিমাত্র জিনিস, তাহল আমার স্বপ্ন। একটি সােনালি স্বপ্ন। এই শুভ মুহূর্তে আমি প্রথমে স্বপ্ন দেখেছিলাম। উৎসাহ ভরে সারাজীবন তার পেছনে উন্মত্তের মতাে ছুটে ছিলাম। জানি না , এই স্বপ্নকে কতটুকু সফল করতে পেরেছি ।... আমার আসন্ন মৃত্যুর কষ্ট যদি তােমাদের মনকে এতটুকু স্পর্শ করে , তবে আমার এই সাধনাকে তােমরা তােমাদের অনুগামীদের মধ্যে ছড়িয়ে দাও , যেমন আমি ছড়িয়ে দিয়েছিলাম তােমাদের মধ্যে। জয় বন্ধুগণ , এগিয়ে চলাে , কখনও পিছিয়ে যেও না। দাসত্বের দিন যাচ্ছে। স্বাধীনতার লগ্ন আগত , ওঠো , জাগাে। "
We hate spam as much as you do