আজ সমাজতান্ত্রিক কিউবা কদিন আগে বিশ্বের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশি নাগরিককে করোনা দুই ডোজ টিকা দেবার কৃতিত্ব অর্জণ করেছে। শুধু তাই নয় সারা বিশ্বের বহু দেশে কিউবার চিকিৎসক দল মহামারির লড়াইয়ে সামনের সারিতে। এমনকি তৃতীয় ডোজ দেবার রেকর্ড করেছে।
" নতজানু হয়ে সারা জীবন বাঁচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত'' ৯ অক্টোবর চে গুয়েভারা শহীদ দিবস
"চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-"
কিউবা বিপ্লবের মহানায়ক চে গুয়েভারার আজ ৫৪তম মৃত্যুদিবস। বিপ্লবের অগ্নিপুরুষ হিসেবে, গেরিলা নেতা হিসেবে বিশ্ব জুড়ে তার নামই ধ্বনিত হয়। চে গুয়েভারা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে খ্যাতিমান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীদের অন্যতম।
এই মহান বিপ্লবীর মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন বিপ্লবের মুখচ্ছবি হিসেবে বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়। এই মহান বিপ্লবীর জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে সফল বিপ্লবের পর চে বলিভিয়ায় গিয়েছিলেন আরেকটি বিপ্লবের প্রত্যয় নিয়ে। বলিভিয়াতে থাকার সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন।
১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর, বলিভিয়ার শহর লা হিগুয়েরাতে বলিভিয়ার সেনাবাহিনী তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। মৃত্যুর পর তিনি সমাজতন্ত্র অনুসারীদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হন। চে গুয়েভারার পুরো নাম ‘এর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা’। জন্মসূত্রে চে গুয়েভারা আর্জেন্টিনার নাগরিক। পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার এবং ফিদেল কাস্ত্রোর দলে চিকিত্সক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি অনুকরণীয় এক বিপ্লবীতে পরিণত হন।
চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তার চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার মৃত্যুর ৫০ বছর পরেও ২০১৮ টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তার নাম প্রকাশিত হয়। আবার গেরিলা যোদ্ধার পোশাকে ১৯৬০ সালের ৫ মার্চ ‘গেরিলেরো হেরোইকো নামে’ আলবের্তো কোর্দার তোলা চে’র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে ‘বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
খুব শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত, অসহায় ও দরিদ্রদের প্রতি ছিল তার গভীর মমত্ববোধ। একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে খুব অল্প বয়সেই রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন চে।
সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা চের পরিবারে ছিল ৩ হাজারেরও বেশি বই। যা চে-কে করে তোলে সমাজ সচেতন। সে সময় তিনি কার্ল মার্কস, উইলিয়াম ফকনার, এমিলিও সরগারির বইয়ের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, আলবার্ট ক্যামাস, ভ্লাদিমির লেলিন, রবার্ট ফ্রস্টের বইও পড়েছেন। কোনো ধর্মে বিশ্বাসী না হয়ে এভাবেই নিজেকে একজন সমাজ সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন।
যুবক বয়সে ডাক্তারি বিষয়ে পড়ার সময় চে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেন, যা তাকে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবন করার সুযোগ এনে দেয়। চে বুঝতে পারেন ধনী-গরিবের এই ব্যবধান ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য বিপ্লব ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তখন থেকেই তিনি মার্কসবাদ নিয়ে পড়ালেখা শুরু করেন এবং স্বচক্ষে এর বাস্তব প্রয়োগ দেখার জন্য গুয়াতেমালা ভ্রমণ করেন।
এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে’র বৈপ্লবিক আদর্শ চেতনা বদ্ধমূল হয়। পরবর্তী সময়ে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তার সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন।
মার্কিন-মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উত্খাত করার জন্য সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন।
তিনি ছিলেন ফিদেল কাস্ত্রোর প্রকৃত সহযোগী।
খুব অল্পদিনেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে তার পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উত্খাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন করেন।
এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান। এর ফলে এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালাস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এই সময় তিনি বিভিন্ন নিবন্ধ ও বই রচনা করেন। গেরিলা যুদ্ধের ওপর তিনি একটি ম্যানুয়েল রচনা করেন। পরে ১৯৬৫ সালে চে মেক্সিকো ত্যাগ করেন। তার ইচ্ছা ছিল কঙ্গো-কিনশাসা ও বলিভিয়াতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সরকারের মন্ত্রীর জীবন পরিত্যাগ করে তিনি আবার বিপজ্জনক বিপ্লবী জীবনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
শুধু কিউবা নয় গোটা লাতিন আমেরিকার শোষিত নিপীড়িত মানুষের মুক্তি তার লক্ষ ছিল। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ।
বলিভিয়াতে থাকার সময় তিনি সিআইএ মদদপুষ্ট বলিভিয়ান বাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট বলিভিয়ার তত্কালীন সামরিক জান্তা বারিয়েন্তোসের স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চে সহযোদ্ধাদের নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। সামরিক জান্তার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় চে গুরুতর আহত হয়ে ধরা পড়েন।
ব্যক্তি বা মানুষ চে মারা গেছেন পাঁচ দশকের বেশি সময় আগে। কিন্তু আমরা আজও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, তিনি আরও বেশি করে মানুষের অভাব, শোষণ, বঞ্চনা, হত্যা, রাহাজানির, নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নতুন শক্তি হিসেবে সবাইকে সাহস জোগাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আবার যেন আজন্ম বিপ্লবীর পুনর্জন্ম হচ্ছে। তিনি যেন বার বার ফিরে ফিরে আসছেন বিপ্লবে। কারণ আর্জেন্টিনায় বা লাতিন আমেরিকায় এখন তাকে সত্যিকার অর্থেই অনুস্মরণ করা হচ্ছে। চে গুয়েভারাকে জীবন্ত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় কাজটি করেছেন তার বন্ধু ও বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। সেই ফিদেল কাস্ত্রোকেও মাত্র কয়েক বছর আগে আমরা হারিয়েছি।
আজ সমাজতান্ত্রিক কিউবা কদিন আগে বিশ্বের মধ্যে দেশের সবচেয়ে বেশি নাগরিককে করোনা দুই ডোজ টিকা দেবার কৃতিত্ব অর্জণ করেছে। শুধু তাই নয় সারা বিশ্বের বহু দেশে কিউবার চিকিৎসক দল মহামারির লড়াইয়ে সামনের সারিতে। এমনকি তৃতীয় ডোজ দেবার রেকর্ড করেছে।
চে র কিউবা আজ উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্তের সাক্ষর রেখেছে। তার শহীদ হওয়ার দিনে মনে পড়ে হাত, পা বাঁধা অবস্থায় একে একে নয়টি গুলি চালিয়ে আর্জেন্টাইন সেই নিরস্ত্র বিপ্লবীকে মেরে ফেলতে পেরেছে এক মদ্যপ সৈনিক। বলিভিয়া সেনাবাহিনীর এমন তথাকথিত মহাসাহসী কর্মকাণ্ডে উল্লসিত, আনন্দিত মার্কিন গণমাধ্যম সেদিন লিখেছিল, একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি মিথ বা রূপকথা চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল। সেদিনের সেই লেখক-সাংবাদিক আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই তার মত বদলাতেন। কারণ সেই মানুষটি আসলে মরেনি, মরেনি তার মতাদর্শ, তার বিপ্লবী চেতনা। খোদ ইউরোপ, আমেরিকা, বলিভিয়া, কিউবা, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, কানাডা, ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে নেপাল, ভারত, চীন এমনকি বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের দিনবদলের স্বপ্ন হয়ে আছে অমর চে গুয়েভারার আদর্শ, তার মিথ। চে গুয়েভারা আজও তাই বিপ্লবের প্রতীক।
We hate spam as much as you do