Tranding

01:18 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / জন্মদিবসে ভগৎ সিং! ফাঁসির পর শতগুণ বেশি জীবন্ত ।

জন্মদিবসে ভগৎ সিং! ফাঁসির পর শতগুণ বেশি জীবন্ত ।

ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির ব্যাপারে গান্ধিজির আপাত নীরবতা এবং তা রোধ করতে তাঁর নিরুৎসাহ নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। বিয়য়টি, যতদূর সম্ভব, মন দিয়ে আমি পড়েছি। এমন নয়, গান্ধিজি অহিংস সত্যাগ্ৰহী ছিলেন বলে, ভিন্ন পথের দেশসেবীদের আত্মবলিদানে তিনি বিচলিত হতেন না। তিনি 'অমানবিক' ছিলেন, এমন কথা ভাবা বা বলা অসঙ্গত। ১৯৩০-এ গান্ধি-আরউইন চুক্তি সই হয়, এর আগে ও পরে ভাইসরয় আরউইনের সঙ্গে তাঁর ভগতের ফাঁসির বিষয়ে কথা হয়েছে , কিন্তু আরউইন গান্ধির অনুরোধ রাখেননি। ভগৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর গান্ধিজি কাগজে লিখিত বিবৃতি দিয়ে ব্রিটিশের কড়া নিন্দা এবং ভগতের দেশপ্রেমের প্রতি প্রগাঢ় ও অকুন্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

জন্মদিবসে ভগৎ সিং! ফাঁসির পর শতগুণ বেশি জীবন্ত ।

জন্মদিবসে ভগৎ সিং! ফাঁসির পর শতগুণ বেশি জীবন্ত ।
    
অধ্যাপক সুদীন চট‍্যোপাধ‍্যায় এর পেজ থেকে

 ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২


ভগৎ সিংয়ের জন্ম অবিভক্ত পঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বঙ্গা শহরে, ২৮ সেপ্টেম্বর (মতান্তরে ২৭ সেপ্টেম্বর), ১৯০৭ সালে। বঙ্গা এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত। তাঁর বাবা সর্দার কিসান সিংহ সান্ধু ও মা বিদ্যাবতী। "ভগৎ" নামের অর্থ "ভক্ত"। তিনি যে পরিবারে জন্মেছিলেন সেটি ছিল এক দেশপ্রেমিক শিখ পরিবার। তাই 'দেশভক্ত' নাম নিয়েই তাঁর জন্ম, জ্বলন্ত দেশপ্রেম , অনন্ত আবেগ ও অফুরন্ত অনুপ্রেরণার নাম ভগৎ সিং।
ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব ও অগ্নিযুগের শহিদ বিপ্লবী,  তাঁকে 'শহিদ-ঈ আজম ভগৎ সিং' নামে অভিহিত করা হয়। কৈশোরেই ভগৎ ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে পড়াশোনা করেন এবং কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি একাধিক বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। মাথা নত করে থাকার গ্লানি থেকে মুক্তির জন্যে তখন তিনি অশান্ত... কিন্তু অধৈর্য নন, খুঁজছিলেন শক্ত মাটি, বিশ্বাস ও কর্মোদ্যোগের একটি মজবুত মঞ্চ, যেখান থেকে একটানা লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (এইচআরএ) সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর মনে হলো এই সেই প্রার্থিত প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা যেতে পারে। নিজের মেধা, নিষ্ঠা ও নেতৃত্ব দানের ক্ষমতায় তিনি অচিরেই এই সংগঠনের নেতৃত্বে উঠে আসেন  এবং সংগঠনটিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে তাকে হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে (এইচএসআরএ) রূপান্তরিত করেন। তাঁকে এবং তাঁর সংগঠনকে নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দেওয়া হলে তিনি ক্ষুরধার যুক্তিতে তা খণ্ডন করে নিজেদের বস্তুগত, ইতিবাচক অবস্থানের মানচিত্র হাজির করেছিলেন। 
তিনি এবং বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লিতে ব্যবস্থাপক সভায় 'ভারতীয় পাবলিক সেফটি বিল'-এর আলোচনা চলাকালীন সময়ে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে প্রথম 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' ধ্বনি দেন এবং সারা ভারতে সাড়া ফেলে দেন । প্রাণভয়ে ভীত ত্রস্ত সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ভয় ছেড়ে, সাহসে ভর করে , এবার দেশের মুক্তির কথা ভাবুন, ইংরেজদের পদতল লেহনের হীন মানসিকতার ইতি ঘটুক। বিষ্ফোরণের ধূম্রজাল ভেদ করে সেদিন এক নবীন ভারত, জেগে ওঠা ভারতের বল দৃপ্ত কন্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল। জেলে ভারতীয়  বন্দিদের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে ভগৎ সিং, দীর্ঘদিন অনশন করে বাধ্য করেছিলেন বন্দিদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে। 


মাত্র তেরো বছর বয়সে ভগৎ মহাত্মা গান্ধির অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরোধিতা করেন, কিন্তু চৌরিচৌরার গণ-হিংসার ঘটনায় কয়েকজন পুলিশকর্মীর মৃত্যু হলে গান্ধিজির আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্তে হতাশ  ভগৎ যুব বিপ্লবী আন্দোলনের পথই বেছে নেন। ব্রিটিশের নগ্ন বলপ্রয়োগ নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় গান্ধিজি আক্রান্তদের পরিত্যাগ করলেন -- এই 'বিনীত রাজনীতি', তাঁর পথ নয়, এ সিদ্ধান্ত সেদিনই পাকা হয়ে গেলো। তিনি মার্ক্সবাদের মৌলিক দর্শনে আকৃষ্ট হলেন। শুধুমাত্র আবেগ ও অস্থিরতা নয়, সংগঠন ভিত্তিক ও কর্মসূচি মাফিক দীর্ঘ সংগ্ৰামের পথেই স্থায়ী মানব মুক্তির গন্তব্য প্রতীক্ষমান , এই বিশ্বাস তাঁর মনে  দৃঢ় হলো।

 

প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রায়ের হত্যার প্রতিশোধে এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্স ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর নিহত হলে ভগৎ সিং, সুখদেও এবং রাজগুরু , তিনজনকেই অভিযুক্ত আসামি করে গ্ৰেপ্তার করে পুলিশ। লাহোর সেন্ট্রাল জেলে দুই সহযোগীসহ ভগৎ সিংয়ের বিচার এবং ফাঁসির হুকুম ছিল এক বিকট প্রহসন। ফাঁসির প্রক্রিয়াটিও ছিল মানবতা বিরোধী চরম বর্বরতার নিকৃষ্ট নিদর্শন। ফাঁসির দড়ির সমনে, আসন্ন মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বীর যোদ্ধা কালো কাপড়ে মুখ না ঢেকে স্বদেশের আলো আর আকাশ দেখতে দেখতে মরতে চেয়েছিলেন। আকাশ নিনাদিত করে স্লোগান তুলেছিলেন  'Down, Down   British Union Jack'... 'Up up Indian National Flag'
                       


ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির ব্যাপারে গান্ধিজির আপাত নীরবতা এবং তা রোধ করতে তাঁর নিরুৎসাহ নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। বিয়য়টি, যতদূর সম্ভব, মন দিয়ে আমি পড়েছি। এমন নয়, গান্ধিজি অহিংস সত্যাগ্ৰহী ছিলেন বলে, ভিন্ন পথের দেশসেবীদের আত্মবলিদানে তিনি বিচলিত হতেন না। তিনি 'অমানবিক' ছিলেন, এমন কথা ভাবা বা বলা অসঙ্গত। ১৯৩০-এ গান্ধি-আরউইন চুক্তি সই হয়, এর আগে ও পরে ভাইসরয় আরউইনের সঙ্গে তাঁর ভগতের ফাঁসির বিষয়ে কথা হয়েছে , কিন্তু আরউইন গান্ধির অনুরোধ রাখেননি। ভগৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর গান্ধিজি কাগজে লিখিত বিবৃতি দিয়ে ব্রিটিশের কড়া নিন্দা এবং ভগতের দেশপ্রেমের প্রতি প্রগাঢ় ও অকুন্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।

 

ভগৎ সিংয়ের দৃষ্টান্ত শুধুমাত্র ভারতীয় যুবসমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধই করেনি, ভারতে সমাজতন্ত্রের উত্থানেও প্রভূত সহায়তা করেছে। আজও এদেশে সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুণ সমাজ ভগৎ সিং'কে তাদের প্রেরণা হিসেবে সম্মান প্রদর্শন করে। তাঁর ফাঁসির সাজা জানার পর সারা দেশ উত্তাল, অস্থির হয়ে ওঠে, আইন-শৃঙ্খলা আকাশে উড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদী মানুষের দৃপ্ত মিছিলে গ্ৰাম শহর সরগরম হয়ে উঠতে থাকে। সন্ত্রস্ত সাম্রাজ্যবাদীরা ফাঁসির সময় কিছুটা এগিয়ে নিয়ে এসে আচমকাই কাজ শেষ করে ফেলে। লাহোর জেলে ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসি হয়।

 

প্রয়াত বিপ্লবীদের শবদেহ পরিবারের সদস্যদের বা জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষ রাতের অন্ধকারে রবি নদীর তীরে কেরোসিন তেল ঢেলে দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। অর্ধদগ্ধ অবস্থায় তাঁদের  দেহ রবি নদীর তীরে ফেলে ভাড়াটে সৎকারকারীরা পালিয়ে যায়। দুদিন পর দেশবাসী পূর্ণ মর্যাদায় নূতন চিতায় তাঁদের  সৎকার করেন। ২৬ মার্চ ট্রিবিউন পত্রিকায় এই ব্রিটিশ বর্বরতার মর্মস্পর্শী  বিবরণ প্রকাশিত হয়। 
সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা, পররাষ্ট্রগ্ৰাসী প্রবঞ্চকেরা, তাদের চাটুকার, অনুগত, ইতিহাসকারেরা, চিরকাল চিন্তা করে এসেছে ফাঁসি, মৃত্যু, হত্যা দিয়ে তারা বীরত্ব, বলিদান, অনুপ্রেরণা ও মানব অহংকারের চিরায়ত কাহিনি মুছে ফেলে পদলেহী সরীসৃপদের উপাধি, পদবিতে ভূষিত করে উৎকোচে ও উপহারে একটি বশ্যতায় অবনত সমাজ তৈরি করে পায়ের ওপর পা দিয়ে অত্যাচার চালিয়ে যাবে। কিন্তু মূর্খের এই স্বর্গ দর্শন কখনও সত্য হয়নি। ভগৎ সিং নেই। কিন্তু তাঁর আত্ম বলিদানের অবিস্মরণীয় কাহিনি রয়েই গেছে । নানা কথা, কাহিনি, লোককথা, উপকথা হয়ে পাঞ্জাবের গ্ৰামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। ওরা মুছে ফেলতে চেয়েছিল যে মানুষটাকে, মৃত্যুর পর শতগুণ বেশি জীবন্ত হয়ে সে অত্যাচারীর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। 
          

Your Opinion

We hate spam as much as you do