গান্ধীজীকে যে দিন হত্যা করা হয় তার ঠিক দিন দশেক আগে ২০ জানুয়ারি,১৯৪৮ দিল্লির বুকে আরও একবার মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বোমা ছোঁড়া হয়, যদিও সেই প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। গান্ধীজী নিজেও বুঝেছিলেন যে হিন্দু মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তাই, ব্যর্থ বোমা বিস্ফোরণ আদতে একটি দুর্ঘটনা কিনা তাঁর এক সহযোগীর এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি দ্ব্যর্থহীণ ভাষায় জানান, ''The fool; don't you see, there is a terrible and widespread conspiracy behind it."
'হায় রাম'
(গান্ধী হত্যার ৭৫ বছরের প্রাক্কালে )
বাসব বসাক
২৯শে জানুয়ারি ২০২৩
৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮। ভারতের স্বাধীনতার বয়স তখন মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস। সেদিনটা ছিল শুক্রবার। ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা বেজে সতেরো। অবাঞ্ছিত দেশভাগ পরবর্তী সাম্প্রদায়িক হানাহানি রুখতে শীতার্ত দিল্লির বিড়লা হাউসের মাঠে প্রতিদিনকার মতই সর্বধর্ম প্রার্থণা সভায় যোগ দিতে জনতার মধ্যে দিয়ে লাঠিতে ভড় ক'রে ঋজু, দৃপ্ত পদক্ষেপে একটা একটা ক'রে সিঁড়ি ভেঙ্গে মূল প্রার্থণা স্থলের দিকে এগিয়ে চলেছেন এক স্বল্পবসন মুন্ডিত মস্তক সন্ন্যাসী। তিনি একে একে শেষ ধাপে এসে পৌঁছালেন। হঠাৎই জনতার মধ্যে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল দুই ব্যক্তি। পথরোধ ক'রে দাঁড়ালো সেই মহাত্মার। উপস্থিত জনতা হতবাক হয়ে দেখলো তাদের একজনের হাতে ততক্ষণে শোভা পাচ্ছে ব্যারেটা থার্টি ফোর সেমি-অটোমেটিক রিভলভার। দু চোখে ওদের তীব্র জিঘাংসা। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে থেকে পরপর তিনটি বুলেট আমূল বিঁধে গেল সেই সন্ন্যাসীর বুকে, পেটে। রক্তাক্ত মানুষটি ওখানেই লুটিয়ে পড়লেন ঘাসের ওপর। একটি সাম্প্রদায়িক দলের ঘৃণ্য চক্রান্তের নীল নকশা অনুযায়ী তাদের একজন একনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবকের হাতে শেষ হয়ে গেল জাতির জনকের জীবন। গোটা দুনিয়াকে হতবাক ক'রে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হয়ে গেলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী; রবীন্দ্রনাথ যাকে মহাত্মা ডেকেছিলেন। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তে, কথিত আছে তাঁর মুখ নিঃসৃত অন্তিম শব্দ দুটি ছিল, 'হায় রাম'।
সন্দেহ নেই আজকের দিনটি স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে কালো অক্ষরে লেখা চরমতম কলঙ্কময় একটি দিন হিসাবে চিহ্নিত হ'য়ে থাকবে।
ঘটনার আকস্মিকতার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সমবেত জনতা ধরে ফেলে জাতির কলঙ্ক ওই দুই কাপুরুষকে। নাথুরাম গডসে আর নারায়ণ আপ্তে। লাল কেল্লায় বিশেষ আদালত গঠন ক'রে ওরা দুজন ছাড়াও বিচার হয় আরো বেশ কয়েকজনের। শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই ফাঁসির আদেশ হয় গডসে ও আপ্তের। কিন্তু এত দ্রুততায় বিচার সম্পন্ন করতে গিয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষী সাবুদের অভাবে চক্রান্তকারীদের মাথা সহ আরো কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারী সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে যায়। তবে পরবর্তীকালে তাদের কারো কারো মৃত্যুর পরে এই নারকীয় হত্যাকান্ডে তাদের জড়িত থাকার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই বৃহৎ ষড়যন্ত্রের মাথাটিকে চিনে নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
গান্ধীহত্যার নেপথ্যে
মনে রাখা ভালো, গান্ধীজীকে যে দিন হত্যা করা হয় তার ঠিক দিন দশেক আগে ২০ জানুয়ারি,১৯৪৮ দিল্লির বুকে আরও একবার মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে বোমা ছোঁড়া হয়, যদিও সেই প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। গান্ধীজী নিজেও বুঝেছিলেন যে হিন্দু মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। তাই, ব্যর্থ বোমা বিস্ফোরণ আদতে একটি দুর্ঘটনা কিনা তাঁর এক সহযোগীর এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি দ্ব্যর্থহীণ ভাষায় জানান, ''The fool; don't you see, there is a terrible and widespread conspiracy behind it." এরও আগে, ১৯৪৭ এর নভেম্বরেই বিহারের তদানীন্তন সিপিআই কৃষক নেতা কার্যানন্দ শর্মা প্রকাশ্য সভায় হিন্দুত্ববাদীদের হিন্দুরাষ্ট্রের দাবিকে একটি অন্যায় দাবি হিসাবে চিহ্নিত ক'রে এই দাবির পিছনে গান্ধী ও নেহরুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। আসলে ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতির ভাষণে তথাকথিত 'দ্বিজাতি তত্বের' প্রবক্তা সাভারকারের মুসলিম কাউন্টারপার্ট জিন্নাহ্ ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকলেও, এবং শেষ পর্যন্ত স্বাধীন পাকিস্তান আদায় করে ছাড়লেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু আধুনিক ভারতকে ধর্মের নাগপাশে বাঁধতে চান নি। ধর্মনিরপেক্ষ, গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবেই স্বাধীন ভারত আত্মপ্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। সেই কারনে বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই আধুনিক মনস্ক নতুন ভারতবর্ষ হিন্দু মৌলবাদীদের একেবারেই না-পসন্দ্ ছিল। আর তারা বুঝেছিল তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন মনুবাদী হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন গান্ধীর জীবদ্দশায় কখনোই সফল হবে না। গান্ধী ও নেহরুকে এবং সেই সঙ্গে কমিউনিস্টদের তারা তাদের পথের কাঁটা হিসাবেই দেখে এসেছে। তাই গান্ধী হত্যার এমন সুগভীর চক্রান্ত। মুম্বাই পুলিশের ডিজিপি নাগরভালার দেওয়া রিপোর্টে জানা যায় জনৈক মানিকলাল ও কারকারে এই বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে মুম্বাইতে যার সঙ্গে শেষবারের মত দেখা করতে গেছিল তিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা তথাকথিত 'বীর' সাভারকার। এই সাভারকারই যে আসলে গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারন আছে।
ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড
গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রের দুই খলনায়ক গোলওয়ালকার ও সাভারকারকে বাঁচাতে নাথুরাম গডসে সমগ্র বিচার পর্ব জুড়ে আরএসএস বা হিন্দু মহাসভার সঙ্গে তার যোগাযোগ অস্বীকার করে গেলেও গডসের সঙ্গে সাভারকারের নিবিড় সখ্যতা গোপন রাখা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। আরএসএস, হিন্দু মহাসভা অথবা পরবর্তী কালে তাদের উত্তরসূরী বিজেপি গডসেকে যতই আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্কহীণ এক উন্মাদ হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করুক না কেন এ কথা আজ সবার জানা যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নাথুরাম গডসে একজন আরএসএস কর্মী ছিলেন। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী গান্ধী হত্যার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে তারা তাদের গুরু সাভারকারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি মারাঠি ভাষায় তাদের 'যশস্বী হুনান আয়ে' (যশ অর্জন ক'রে ফিরে এসো) ব'লে আশীর্ব্বাদ করেন। যদিও বিচার চলাকালীণ সময়ে একদা ইংরেজদের কাছে ছ'ছ খানা মুচলেকা দেওয়া সাভারকার তাঁর স্বভাব কাপুরষতার পরিচয় দিয়ে এমন ভান করেন যেন গডসেকে তিনি চেনেনই না। গডসে এই ব্যবহারে যারপরনায় ব্যথিত হয়েছিলেন এবং অন্যদের সে কথা জানিয়েওছিলেন।
সাভারকারের মৃত্যুর পর ১৯৬৫ তে গঠিত হয় বিচারপতি জীবনলাল কাপুর কমিশন। কাপুর কমিশনের সামনে সাভারকারের দুই অনুচর এপি কাসর এবং জিডি দামলে স্পষ্টতই গান্ধী হত্যা ষড়যন্ত্রে সাভারকারের প্রত্যক্ষ সংযোগের কথা স্বীকার করে নেন। ওই দুজনকে লালকেল্লায় বিচার চলাকালীণ উইটনেস বক্সে তোলা গেলে সাভারকারের যাবজ্জীবন কারাদন্ড একরকম নিশ্চিত ছিল।
গডসে ও আপ্তে সাভারকারের হিন্দু মহাসভার হিন্দুত্ববাদী কার্যক্রমের অঙ্গ হিসাবে অগ্রণী নামে একটি সংবাদপত্র পরিচালনা করতেন। পরে সেটির নাম বদলে হয় হিন্দুরাষ্ট্র। গডসের এই সংবাদপত্রদুটিতেই প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সাভারকার। তিনিই গডসেকে অগ্রণীর সম্পাদক করেছিলেন। গডসে ও সাভারকারের মধ্যে বিনিময় হওয়া একাধিক চিঠিও তাদের সখ্যতার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে। নাথুরামের সেজভাই গোপাল গডসে ১৯৯২ সালে দ্ব্যর্থহীণ ভাষায় তাদের চার ভাইয়েরই আরএসএস যোগের কথা স্পষ্ট করেছেন। সম্প্রতি প্রায় ৩০০০ কোটি টাকা দিয়ে নরেন্দ্র মোদী যে বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি নির্মান করলেন, সেই প্যাটেলও তদানীন্তন হিন্দু মহাসভার নেতা (পরবর্তী কালে বিজেপির পূর্বসূরী জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা) ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে কড়া ভাষায় চিঠি লিখে জানান, "We cannot shut our eyes to the fact that an aappreciable number of the members of the Mahasabha gloated over the tragedy and distributed sweets. On this matter, reliable reports have come to us from all parts of the country. Further militant communalism, which was preached until only a few months ago by many spokesmen of Mahasabha...could not but be regarded as a danger to public security. The same would apply to RSS, with the additional danger inherent in an organization run in secret on military and semi-military lines."
সমস্ত তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমান খতিয়ে দেখে কাপুর কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, "All these facts taken together were destructive of any theory other than the conspiracy to murder by Savarkar and his group."
গান্ধী হত্যার নয়া উদ্যোগ
না। মহাত্মা গান্ধীকে নির্মম ভাবে হত্যা ক'রেও আপামর দেশবাসীর হৃদয় থেকে গান্ধীজীর ভারত চেতনার দেদীপ্যমান আলোকশিখা নেভানো যায় নি। তাই কেবল নির্গুণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নতুন উদ্যমে জাতির জনক ও তার যাবতীয় চিন্তাকে দ্বিতীয়বার হত্যার অশ্লীল চক্রান্ত শুরু হয়েছে। বুলেটবিদ্ধ গান্ধীজী মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মুহূর্তে তাঁর চোখ থেকে খুলে পড়া চশমার কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল কিনা জানি না। শুধু এটুকু জানি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর চশমা নিয়েছেন, কাঁচ নেন নি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল, গান্ধী হত্যার অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী সাভারকারের মত কাপুরুষকে তাই আজ 'বীর' বানানোর চেষ্টা চলছে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পদধূলি লাঞ্ছিত কুখ্যাত সেলুলার জেলের নামকরণ করা হচ্ছে এই কাপুরুষের নামে। যে বন্দরের একটি ডকের নাম নেতাজী সুভাষের নামে সেই গোটা বন্দরটার নাম করণ করা হচ্ছে আদ্যন্ত সুবিধাবাদী রাজনীতিক শ্যামাপ্রসাদের নামে। প্রধানমন্ত্রীর দলীয় সাংসদ স্বাধ্বী প্রজ্ঞা নির্দ্বিধায় গডসেকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী বলছেন। ফৈজাবাদে হিন্দু মহাসভার নেতৃ জনৈকা পূজা দেবী গডসে সেজে গান্ধীর ছবিতে খেলনা পিস্তল দিয়ে সোৎসাহে নকল গুলি ছুঁড়ে আনন্দে উদ্বেল হয়ে মিষ্টি বিতরণ করছেন। কোথাও আবার রীতিমত মন্দির নির্মাণ ক'রে গডসে মূর্তির পূজা অর্চনা চলছে। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাদের ন্যূনতম অবদান নেই; যারা এই সেদিন পর্যন্ত ভারতের তেরঙ্গা ঝান্ডার অমর্যাদা করে এসেছে, যাদের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়ে আছে স্বাধীনতার পর স্বাধীন ভারতের পতাকা পোড়ানোর ঘটনায়, তারাই আজ গান্ধীর আদর্শের উল্টো পথে দাঁড়িয়ে 'এক ভাষা, এক ধর্ম, এক দেশের স্লোগান তুলে দেশবাসীকে দেশভক্তির পাঠ শেখাতে এসেছে। আর এভাবেই অবিরত চলছে গান্ধীর আদর্শ-চিন্তা-চেতনাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ। চলছে মহাত্মার স্বপ্নের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতের মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস। সিএএ-এনপিআর-এনআরসির নামে সরাসরি আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে ভারতের সংবিধানের ওপরে। কে কি খাবে, কে কি পরবে, কে কি বলবে সমস্ত কিছু অাজ ঠিক ক'রে দিতে চাইছে গান্ধী হত্যার উত্তরাধিকারীরা। আমাদের মত রাজ্যে বিপদ আরও ভয়াণক। কেননা এখানে সংবিধান ও ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রত্যক্ষ শত্রুদের পাশাপাশি আছে তাদের গোপন সঙ্গী আরএসএস-এর দেবী দুর্গা। লড়াইটা তাই বড় কঠিন।
আজকের শপথ
জাতির জনকের হত্যার দিন হোক শপথের দিন।আসুন আমরা অঙ্গীকার ক'রি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারীদের উত্তরসূরীদের হাতে পবিত্র সংবিধানকে কলুষিত হতে দেবো না কিছুতেই। যে কোনে মূল্যে রক্ষা করবো বাপুজীর ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারতের উত্তরাধিকার।
We hate spam as much as you do