Tranding

02:15 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / প্রবন্ধ - রাজ‍্য বাজেট ও চিরকুটে মহার্ঘ ভাতা

প্রবন্ধ - রাজ‍্য বাজেট ও চিরকুটে মহার্ঘ ভাতা

আগের বাজেট গুলোতে পথশ্রী নমক একটি প্রকল্পের কথা খুঁজে পাই। এই প্রকল্পের অধীনে কি কি কাজ হয়েছে, কতটা রাস্তা তৈরি হয়েছে, তার কোন উল্লেখ সহকারী নথিতে নেই। রাজ্যবাসী তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রাস্তাঘাটের হালের সাম্যক ধারণা খুব ভালোই আছে । এই প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেটে একই ক্ষেত্রের জন্য ভিন্ন নাম দিয়ে ঘোষণা হলো রাস্তাশ্রী প্রকল্প।এই জন্য বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকা। তৈরি হবে ১১ হাজার কিলোমিটার রাস্তা। সারাই হবে পুরনো রাস্তাও। দেখা যাক, পথশ্রী দিয়ে তো হলো না রাস্তাশ্রী দিয়ে রাস্তা ঘাটের হাল ফেরানো যায় কিনা।

প্রবন্ধ - রাজ‍্য বাজেট ও চিরকুটে মহার্ঘ ভাতা

প্রবন্ধ - রাজ‍্য বাজেট ও চিরকুটে মহার্ঘ ভাতা


ডঃ ভাস্কর গোস্বামী, অর্থনীতি বিভাগ 
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
19 feb 2023

গত ১৫ ই ফেব্রুয়ারি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী  চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বিধানসভায় পেশ করলেন রাজ্যের বাজেট। এই বাজেট কর্মসংস্থানমুখী বলে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাজেটে খুবই নাটকীয়ভাবে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বৃদ্ধি-সহ একাধিক বড় ঘোষণা রাজ্যের। ঘোষণা করা হল নতুন অনেক প্রকল্পেরও। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক চলতি অর্থবর্ষের রাজ্য বাজেটে বাংলার মানুষের হাতে  কী কী এলো?
বিধায়কদের এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিইইউপি) কর্মসূচিতে এলাকা উন্নয়নের খাতে বাৎসরিক ৬০ লক্ষ টাকা থেকে ১০ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৭০ লক্ষ টাকা করা হয়। অর্থাৎ বিধায়কদের হাতে বাৎসরিক আরও ১০ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হলো। কিন্তু  বিধানসভাগুলির এলাকার উন্নয়ন বলতে কী বোঝাতে চাইছে সেটা অনুচ্চারিত থেকে যায়। প্রশ্ন থেকে যায় এই বরাদ্দ কি এলাকাভিত্তিক  ক্লাবগুলোর অনুদান ও মেলা খেলা উৎসবের জন্য বরাদ্দ। কারণ বিগত ১২ বছর ধরে বিধায়করা এ তহবিলের টাকা কি কি খাতে খরচ করেছে তার কোন দলিল আজও জনসমক্ষে নেই। ২৩৫ টি বিধানসভার কেন্দ্রের জন্য মোট বরাদ্দ ২৩৫০ লক্ষ টাকা কোন খাতের থেকে আসবে সেটার কোনো উল্লেখ নেই এই বাজেটে।
আগের বাজেট গুলোতে পথশ্রী নমক একটি প্রকল্পের কথা খুঁজে পাই। এই প্রকল্পের অধীনে কি কি কাজ হয়েছে, কতটা রাস্তা তৈরি হয়েছে, তার কোন উল্লেখ সহকারী নথিতে নেই। রাজ্যবাসী তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রাস্তাঘাটের হালের সাম্যক ধারণা খুব ভালোই আছে । এই প্রেক্ষাপটে এবারের বাজেটে একই ক্ষেত্রের জন্য ভিন্ন নাম দিয়ে ঘোষণা হলো রাস্তাশ্রী প্রকল্প।এই জন্য বরাদ্দ তিন হাজার কোটি টাকা। তৈরি হবে ১১ হাজার কিলোমিটার রাস্তা। সারাই হবে পুরনো রাস্তাও। দেখা যাক, পথশ্রী দিয়ে তো হলো না রাস্তাশ্রী দিয়ে রাস্তা ঘাটের হাল ফেরানো যায় কিনা।
এই সরকারের খুবই জনপ্রিয় প্রকল্প লক্ষ্মীর ভান্ডার।বাংলার ১.৮৮ কোটি মহিলা, যাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রাপক, তাঁরা ৬০ বছর পেরোলেই সরাসরি বার্ধক্যভাতার আওতায় আসবে বলে ঘোষণা করা হয় এই বাজেটে। অর্থাৎ বার্ধক্যভাতার একটা বড় অংশ লক্ষী ভান্ডার এর সাথে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ভাবে মাথাপিছু ভাতা একই থাকছে ।এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আবহাওয়া মাথাপিছু লক্ষী ভান্ডারের ভাতা ও বার্ধক্য ভাতা নিতান্তই নগণ্য। 
ডেউচা-পাঁচামিতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লগ্নির ঘোষণা। চাকরি হতে পারে লক্ষাধিক যুবক-যুবতীর এমনই দাবি রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর। পরিবেশ দূষণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের কোন কিছু তোয়াক্কা না করে এই ঘোষণা খুবই দুর্ভাগ্যজনক বিশেষত যখন ডেউচা-পাঁচামির এলাকার বাসিন্দারা এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। আগের বছরে বাজেটে তাজপুরের সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ঘোষণা কোন উল্লেখ নেই বাজেট। কারণটা সহজে অনুমানীয় ।বিগত কয়েক মাস ধরে আদানি শিল্প গোষ্ঠীর টালমাটাল অবস্থার জন্য অর্থমন্ত্রীর আর সাহসে হয়নি বাজেট বক্তৃতায়  আদানি গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করার। সুতরাং অধরা থেকে গেছে বিগত বাজেটের কর্মসংস্থানের দিশা।
বাজেটে ঘোষণা হল স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড় আরও ৬ মাস বৃদ্ধির। বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটির ২ শতাংশ এবং জমি-বাড়ির বাজারমূল্যের সার্কল রেটের ১০ শতাংশ ছাড়ের মেয়াদ আরও ছ’মাস বৃদ্ধি করা হলো। এই পদক্ষেপের জন্য নিঃসন্দেহে জমি বাড়ি ফ্যাট কেনার জন্য ক্রেতারা উৎসাহিত হবেন। রাজ্যের অর্থনীতিও চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বিশ্লেষণ শুধু এখানটায় থেমে থাকলে সঠিক চিত্রটা পাওয়া যায় না। আরো তলিয়ে দেখলে আসল চিত্রটা ধরা পড়বে। ইদানিং কালের সমস্ত দুর্নীতির টাকা, কয়লা থেকে বালি,ভুয়ো চাকরির থেকে গরু পাচার, শাসক দলের সমস্ত দুর্নীতির কালো টাকা ঘুরপথে এই আবাসন শিল্পে বিনিয়োগ হচ্ছে। অর্থাৎ কালো টাকার সাদা করার এক সুবর্ণ সুযোগ এই আবাসন প্রকল্পগুলি। আবাসন প্রকল্পে রাজ্য সরকারের বাজেটের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মদত কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করবে। ইদানিংকালে আয়কর বিভাগ ও ইনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটর সক্রিয়তার বাতাবরণ  কেন এত তাড়াহুড়ো তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এবার আসা যাক বহু প্রচলিত মহার্ঘভাতা প্রসঙ্গে। বাজেটের মাঝপথে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে অর্থমন্ত্রী হাতের চিরকুটে মাধ্যমে ৩ পার্সেন্ট মহার্ঘভাতা ঘোষণা করেন। ঘোষণার এই পুরো প্রক্রিয়াটা সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী। প্রথমত বাজেটের দলিলে মহার্ঘভাতার কোন উল্লেখ নেই। শুধু তাই নয় এই অতিরিক্ত মহার্ঘ ভাতা প্রদানের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা কোন খাত থেকে আসবে তার কোন উল্লেখ নেই। দ্বিতীয়তঃ কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা প্রদানের বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের বিচারাধীন। বিচারাধীন বিষয় সরকারের কোন এখতিয়ার নেই আংশিক মহার্ঘ ভাতা ঘোষণার। এই বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নিন্দনীয়। নানা সময় সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা না দেওয়ার যুক্তি হিসেবে দেখানো হয় সরকারি জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি চালু রাখার জন্য টাকা সংস্থানের বিষয়টি। আমাদের পড়শি রাজ্যে ঝাড়খন্ড উড়িষ্যাতেও অনেক জনসমাজ কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু আছে এবং তা সত্ত্বেও এই রাজ্যগুলিতে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা হয়। প্রশ্ন তারা পারলে আমরা কেন পারব না। একান্তই যদি না পারে সেটা সরকারের ব্যর্থতা। অন্যদিকে সমাজে একটা বাতাবরণ তৈরি করার চেষ্টা চলছে।সরকারি কর্মচারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেক বেশি মাইনে পায়। তাই তাদের মহার্ঘ ভাতা খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। খুব দায়িত্ব নিয়ে এই বিতর্কটা সমাজে প্রতিষ্ঠা  করার চেষ্টা চলছে। এর সঙ্গে চলছে সরকারি কর্মচারীদের ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাধারণ মানুষের প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরা। এই প্রচেষ্টাকে নশ্চাত করতে হবে। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়  আম্বানি আদানি গোষ্ঠীর ১০০ টাকা উপার্জন বৃদ্ধি হলে সেটা তাদের পকেটেই থাকে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের ১০০ টাকা উপার্জন বৃদ্ধি হলে তার থেকে অধিকাংশই নানা জিনিসপত্রের উপর খরচ হয় যা প্রকারান্তরে সমাজের নিচু চলার মানুষের উপার্জন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সুতরাং সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা বৃদ্ধি আয়ের বৈষম্যকে অনেকটা হল নিয়ন্ত্রণ করে ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে। বিশেষ করে রাজ্যের দেনার জন্য রাজকোষের ঘাটতি যখন মাথাপিছু ৬০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায় তখন অর্থনীতিতে চাঙ্গা রাখতে গেলে মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা বাড়াতেই হবে।

Your Opinion

We hate spam as much as you do