ভর্তুকির খতিয়ান দেখলে বোঝা যায় কীভাবে খাদ্য ও সার থেকে ভর্তুকি তুলে নিচ্ছে এই মোদি সরকার-- ২০২০-২১ অর্থবর্ষে খাদ্যের উপর ভর্তুকি ছিলো ৫৪১.৩৩ হাজার কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে যা কমে হলো ২৮৬.৪৭ হাজার কোটি এবং ২৩-২৪ অর্থবর্ষে যা দাঁড়ালো ১৯৭.৩৫ হাজার কোটি। একই চিত্র সারের ক্ষেত্রেও, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে যা ছিলো ২২৫.২২ হাজার কোটি, ২৩-২৪ অর্থবর্ষে যা দাঁড়িয়েছে ১৭৫.১০ হাজার কোটি।
অমৃত্ কালের কেন্দ্রীয় বাজেট
5th January 2023
ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন পয়লা ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট-এ বাজেট নথিতে জমা রাখলেন এক গুচ্ছ প্রতিশ্রুতি । মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে বা সংবাদমাধ্যমে যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে তা হল ‛কর স্ল্যাব'-এর পুনর্বিন্যাস । ৮৭ মিনিটের সংক্ষিপ্ততম বাজেটে করছাড়ের উর্ধসীমাকে বাড়িয়ে করলেন ৭ লক্ষ টাকা।অর্থাৎ ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত যাদের বার্ষিক আয়, তাঁদের কোনো আয়কর দিতে হবেনা। যদিও পুরোনো কর ব্যবস্থায় এই কর দিতে হতনা বলেই জানা গেছে। সাধে কি বলা হয় 'জুমলাবাজ'!
বাজেটের শুরুতে অর্থমন্ত্রী হাউসকে উদ্দেশ্য করে যে কথাটি প্রথম বলেন তা হল- "This is the first budget in Amrit kaal". এই অমৃত্কালে 'সপ্তঋষি' বলে একটি শব্দ ব্যবহার করেন অর্থাৎ, সাতটি বিষয়ের উপর সরকার আলোকপাত করতে চাইছে। এই সপ্তঋষি গুলো হলো-
*Inclusive Development ( অন্ত:ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি)
*Reaching the last Mile ( শেষ প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছানো)
*Infrastructure and investment( পরিকাঠামো ও বিনিয়োগ)
*Unleashing the potential ( সম্ভাবনা উন্মোচন)
*Green growth (সবুজ উন্নয়ন)
*Youth Power (যুবশক্তি)
*Financial sector ( আর্থিক ক্ষেত্র)
এককথায় পরিকাঠামোগত উন্নয়নের উপর জোর দিতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী, কারণ আর্থিক ভাবে কর্মসংস্থান গড়তে পরিকাঠামোই একমাত্র রাস্তা। করোনার জোড়া ধাক্কায় বেসামাল অর্থনীতিকে গতি দিতে একপ্রকার নাজেহাল হতে হয়েছে মোদি সরকারকে, যার অন্যতম কারণ এই পরিকাঠামোগত অব্যবস্থা। শুধু তাই নয়, রুশ-উইক্রেন যুদ্ধ এবং ক্রমেই বেড়ে চলা পণ্যের দর গোটা বিশ্বের অর্থনীতির পাশাপাশি ভারতীয় অর্থনীতির উপরে আঘাত এনেছে বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অন্যদিকে ভর্তুকির খতিয়ান দেখলে বোঝা যায় কীভাবে খাদ্য ও সার থেকে ভর্তুকি তুলে নিচ্ছে এই মোদি সরকার-- ২০২০-২১ অর্থবর্ষে খাদ্যের উপর ভর্তুকি ছিলো ৫৪১.৩৩ হাজার কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে যা কমে হলো ২৮৬.৪৭ হাজার কোটি এবং ২৩-২৪ অর্থবর্ষে যা দাঁড়ালো ১৯৭.৩৫ হাজার কোটি। একই চিত্র সারের ক্ষেত্রেও, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে যা ছিলো ২২৫.২২ হাজার কোটি, ২৩-২৪ অর্থবর্ষে যা দাঁড়িয়েছে ১৭৫.১০ হাজার কোটি।
এক কথায় বৈষম্য কমানোর দিকে নজরই নেই মোদি সরকারের। ভারতের মতো দেশে ৪০% সম্পদ কুক্ষিগত ১ শতাংশ ভারতীদের হাতে, সেই দেশে নতুন বাজেটে ৬৪% জি.এস.টি দিচ্ছেন সেই দেশের ৫০% গরিব মানুষ।
বাজেটের আরেকদিকে পরিবেশ বান্ধব আর্থিক উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ নয়া প্রকল্পে বরাদ্দ করেছেন মোদি সরকার। কেউ কেউ একে ইতিবাচক দিক হিসাবে দেখছেন। যার মধ্যে রয়েছে গ্রীন হাইড্রোজেন মিশন, শক্তি রূপান্তর, এনার্জি স্টোরেজ প্রকল্প , গ্রীন ক্রেডিট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। একই সাথে পরিবেশের ভালো চেয়ে বীরভূমের ডেউচা পাঁচমি কে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা নগরী গড়ে তোলার জন্য মুখিয়ে রয়েছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এবং সেটা আদানি গোষ্ঠীর হাত ধরে । বলাবাহুল্য যে ইদানিংকালে এই আদানি গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বের আতস কাঁচের নিচে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে মুক্ত কয়লা খনি এবং সেই মাইনের চারিপাশে থাকা বসতির জন্য কতটা ক্ষতিকারক। খুব স্বাভাবিকভাবেই সরকারের পরিবেশবান্ধব প্রকল্পের বার্তায় দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ কোভিড পরবর্তী সময়ে ৮.৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করলেও মিড ডে মিলের বরাদ্দ কমেছে ১২০০ কোটি টাকা। প্রাক মাধ্যমিক থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ২২-২৩ অর্থবর্ষে বরাদ্দ ছিলো ১২,৮০০ কোটি টাকা সেই বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ১১,৬০০ কোটি টাকায়।
করোনার জেরে ২১-২২ অর্থবর্ষে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বাজেট বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬৪,১৮০ কোটি থেকে ৮৬,৮০৬ কোটিতে। কিন্তু চলতি ২২-২৩ অর্থবর্ষে যা কমে দাঁড়ায় ৮৬,২০১ কোটিতে যার মধ্যে খরচ হয়েছিলো ৭৬,৩৭০ কোটি। এই অর্থবর্ষে বরাদ্দ আরো কমে দাঁড়িয়েছে ৮৬,১৭৫ কোটি।
ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে একশো দিনের কাজের প্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেখানে বরাদ্দ কমেছে ১৩ হাজার কোটি। কিন্তু উল্টোদিকে প্রাক কোভিড পরিস্থিতিতে একশো দিনের কাজের চাহিদা ক্রমশ বেড়েছে। অতিমারীর প্রভাবে পরিযায়ী বহু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসার পর যাদের একমাত্র উপার্জনের উপায় ছিলো এই প্রকল্প।
দেশের অধিকাংশ সংস্থায় অসংগঠিত শ্রমের পরিমান বেড়েছে ।পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৫.৯৬% থেকে বেড়ে ১৩.৫৮% হয়েছে ২০-২১ বর্ষে।একই সাথে বেকারত্ব বেড়ে মহিলাদের ক্ষেত্রে শহরে ৯% এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ৬.৪% হয়ছে।
বাজেট আলোচনা অনুযায়ী এই বাজেটের প্রধান একটি বিষয় ৭ লক্ষ পর্যন্ত কর ছাড়। ফলে মনে হতেই পারে এতে সাধারণের উপকার হবে কিন্ত দিনে চার হাজার কোটি টাকার ঋণের বোঝা মুদ্রাস্ফীতি ঘটাবে ও কর ছাড়ের সুবিধা অপ্রাপ্তই থেকে যাবে।
উপরন্তু এই বাজেটে কোথায় লেখা নেই যে; গত বছরে কর্পোরেটদের কত লাখ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক ঋন মকুব করায়, সরকারের কতো কোটি টাকার মাশুল গুনতে হয়েছিল। এবং ব্যাঙ্ক ও এল আই সির মতো সরকারি সংস্থ্যায় কত লাখ কোটি টাকা NPA কে write off করতে বাধ্য করেছিল সরকার।
পরিশেষে সপ্তঋষির এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যুবশক্তির বিষয়ে আসা যাক। শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের কোন নির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের দিশা দেখাতে ব্যর্থ এই বাজেট। উল্টে অনলাইন গেমস ও বেটিং -এর সরকারি স্বীকৃতি ও বৈধতা পায় এই বাজেটে।
We hate spam as much as you do