ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান ও ইসরায়েলের ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরায়েলের একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনায় সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা বিবেচনায় এই তত্ত্বটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যু ! দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা ?
২১ মে ২০২৪
হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি । রবিবার ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এক পার্বত্য অঞ্চলে প্রেসিডেন্ট রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ানসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনা ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এই দুর্ঘটনা ঘিরে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
ইরানের কট্টরপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। ১৯৮৮ সালে ইরানে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও পরবর্তী সময়ে দেশটির পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। অনেকে মনে করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উত্তরসূরি হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছিলেন রাইসি। তার নেতৃত্বেই ইরানের সামরিক বাহিনী কিছুদিন আগে আঞ্চলিক চিরবৈরী ইসরায়েলের ভূখণ্ডে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে ইরানজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই ঘটনায় অনিশ্চয়তার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে ইরান, যার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও দেশটির সরকারি ব্যাখ্যায় এখন পর্যন্ত বৈরী আবহাওয়া পরিস্থিতির কারণে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানানো হচ্ছে। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারি বৃষ্টিপাত আর ঘন কুয়াশার কারণে ফ্লাইটের দৃষ্টিসীমায় ব্যাঘাত ঘটেছে। তবে এই দুর্ঘটনায় শত্রæপক্ষের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়েও জল্পনা ছড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মেয়াদ ও ইরানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় শত্রæ, এমনকি ইসরায়েলের মতো বহিরাগত ক্রীড়নকদের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়েও কথা উঠেছে।
ব্রিটিশ প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরান ও ইসরায়েলের ঐতিহাসিক বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার পেছনে ইসরায়েল জড়িত থাকতে পারে বলে কিছু ইরানি সন্দেহ করছেন। দামেস্কে ইসরায়েলের একজন ইরানি জেনারেলকে হত্যা ও পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলে ইরানের শত শত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনায় সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনা বিবেচনায় এই তত্ত্বটি অনেকের মনোযোগ কেড়েছে।
ইরানের স্বার্থের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা এবং নিখুঁত অভিযান চালানোর জন্য ইসরায়েলের দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ব্যাপক পরিচিতি আছে। যদিও ইসরায়েলি এই গোয়েন্দা সংস্থা কখনোই কোনো রাষ্ট্রের প্রধানকে লক্ষ্যবস্তু বানায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে হত্যার ঘটনা সরাসরি যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাবে। এমনকি ইরানের পক্ষ থেকে নজিরবিহীন প্রতিক্রিয়া আসবে। যদিও ঐতিহ্য বিবেচনায় ইসরায়েলের কৌশলগত অবস্থান উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে সামরিক এবং পারমাণবিক লক্ষ্যবস্তুতেই রয়েছে। ইকোনমিস্ট বলছে, রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইসরায়েলের জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ করার জোরালো কারণ রয়েছে। ইসরায়েল কখনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার মতো এত দূর অগ্রসর হয়নি। এর অর্থ হবে দ্ব্যর্থহীন যুদ্ধ- যা ইরানের তীব্র প্রতিক্রিয়া উসকে দেবে।
নিছক দুর্ঘটনা নাকি বিশাল কোনো ষড়যন্ত্র : গত রবিবার আজারবাইজানের সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাস নদীর ওপর দুই দেশের যৌথভাবে নির্মিত একটি বাঁধ উদ্বোধন করতে যান ইব্রাহিম রাইসি। সেখানে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভও ছিলেন। বাঁধ উদ্বোধন শেষে ৩টি হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরিজে ফিরছিলেন রাইসি ও তার সঙ্গে থাকা অন্য কর্মকর্তারা। অন্য দুটি হেলিকপ্টার নিরাপদে ফিরলেও প্রেসিডেন্টকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে হেলিকপ্টারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির আবদুল্লাহিয়ান ছাড়াও ছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির প্রতিনিধি ও তাবরিজ শহরের জুমার নামাজের ইমাম আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলি আল-ই হাশেম, পূর্ব আজারবাইজানের গভর্নর মালিক রাহমাতি, প্রেসিডেন্ট প্রোটেকশন ইউনিটের কমান্ডার সরদার সৈয়েদ মেহদি মৌসভি, কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী এবং ক্রুরা। এদিকে নিরাপদে ফেরা হেলিকপ্টারে ছিলেন ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী আলী আকবর মেহরাবিয়ান এবং আবাসন ও পরিবহনমন্ত্রী মেহরদাদ বজরপাশ।
কী কারণে এমন মর্মান্তিক পরিণতি হলো হেলিকপ্টারটির? কেন বা কীভাবে দুর্ঘটনার কবলে পড়ল সেটি? এটি কি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি এর পেছনে রয়েছে বিশাল কোনো ষড়যন্ত্র, এখন এসব প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে সবার মনে। হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে এখনো হয়তো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ঘন মেঘ, কুয়াশা ও জলীয় বাষ্পের কারণেই হয়তো এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
উদ্ধার অভিযানে বেগ পেতে হয় : দুর্ঘটনার পর ৪০ জনের বেশি উদ্ধারকর্মী, অনুসন্ধানী কুকুর এবং ড্রোন দিয়ে শুরু হয় বড় ধরনের উদ্ধার অভিযান। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কুয়াশার মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে উদ্ধারকর্মীদের বেগ পেতে হয়। পরে গতকাল সকালে উদ্ধার অভিযানে যোগ দেয়া একটি তুর্কি ড্রোন ‘হিট সোর্স’ শনাক্ত করলে দুর্ঘটনাস্থলের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু পাহাড়ের উপরে হেলিকপ্টারের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়ার পর ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রধান হোসেইন কোলিভান্দ বলেন, দুর্ঘটনাস্থলে প্রাণের কোনো চিহ্ন মেলেনি।
বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটি পুড়ে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ড্রোন থেকে তোলা বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে। দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল্লাহিয়ানসহ ওই হেলিকপ্টারে থাকা কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাও মারা গেছেন।
রাইসিকে বহন করছিল বেল ২১২ মডেলের একটি হেলিকপ্টার। এই মডেলটি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরে যুক্তরাষ্ট্রের এটি ইরানের কাছে বিক্রি করার কথা নয়। সেই হিসেবে এটি অন্তত ৪৫ বছরের পুরনো।
এর আগেও আকাশপথে দুর্ঘটনায় দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। প্রতিরক্ষা ও বিভিন্ন সময়ে পরিবহনমন্ত্রী, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড ও সেনাবাহিনীর কমান্ডার বিমান বা হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।
৫ দিনের শোক : ইব্রাহিম রাইসি দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ২০২১ সালে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। রবিবার দুর্ঘটনার পর তাকে জীবিত উদ্ধারের আশা ফিকে হতে থাকলে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইরানিদের উদ্বিগ্ন হতে বারণ করেন। দেশের কাজে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেন। রাইসির জন্য সবাইকে দোয়া করারও আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয় টিভিতে আসা ভিডিওতে মাসাদ শহরে মানুষকে প্রেসিডেন্টের জন্য দোয়া করতেও দেখা যায়।
প্রেসিডেন্ট রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর গতকাল সকালে জরুরি বৈঠকে বসে ইরানের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। পরে তারা একটি বিবৃতি দেন। প্রেসিডেন্ট ও তার সফরসঙ্গীদের মৃত্যুতে ৫ দিনের শোক ঘোষণা করেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি।
রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থার শেয়ার করা একটি ছবিতে দেখা যায়, রাইসি সাধারণত যে চেয়ারটিতে বসেন সেটি খালি রাখা হয়েছে। নিহত এই প্রেসিডেন্টের স্মরণে সেটিকে কালো কাপড়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার : রাইসির মৃত্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন দেশটির প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার। দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি তার নাম অনুমোদন করেছেন। ৬৮ বছর বয়সি মোখবার দুই মাস এ দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানিকে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় কোনো প্রেসিডেন্ট মারা গেলে ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে নির্বাচন আয়োজন করে থাকে ইরানের তিন সদস্যের একটি পরিষদ। সেখানে মোহাম্মদ মোখবার ছাড়াও রয়েছেন পার্লামেন্টের স্পিকার ও বিচার বিভাগের প্রধান।
ইব্রাহিম রাইসির মতোই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ মোখবার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ২০২১ সালে তিনি প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। আর রাইসি সে সময় হন প্রেসিডেন্ট।
রয়টার্স লিখেছে, গত বছরের অক্টোবরে রাশিয়ার মস্কোয় যে কজন ইরানি কর্মকর্তা সফর করেন, তাদের একজন ছিলেন মোখবার। সে সময় রুশ সেনাবাহিনীকে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও আরো বেশি ড্রোন সরবরাহের ব্যাপারে তারা সম্মত হন।
এর আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বিনিয়োগ ফান্ড ‘সেতাদ’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোখবার। পারমাণবিক বা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ২০১০ সালে ইরানের অন্যান্য কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মোখবারকেও নিষেধাজ্ঞা তালিকায় রেখেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে দুই বছর পর ওই তালিকা থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়।
বিশ্ব নেতাদের শোক : হেলিকপ্টার বিধ্বস্তে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হওয়ায় ঘটনায় শোক জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। তাদের মধ্যে রয়েছেন- রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
শোক বার্তায় রাইসিকে একজন অসামান্য রাজনীতিবিদ হিসেবে বর্ণনা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি বলেন, রাইসির মৃত্যু একটি অপূরণীয় ক্ষতি।
রাইসির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি। রাইসির মর্মান্তিক মৃত্যুকে ইরানের জনগণের জন্য একটি বড় ক্ষতি বলে বর্ণনা করেন তিনি।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, তিনি তার প্রিয় ভাই রাইসির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। তিনি ইরানের জনগণের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা প্রকাশ করেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছেন। তিনি এক্স পোস্টে লিখেছেন, তার পরিবার ও ইরানের জনগণের প্রতি আমার সমবেদনা জানাচ্ছি। এই শোকের সময়ে ভারত ইরানের পাশে আছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেছেন, রাইসির মৃত্যুতে অনেক বড় ক্ষতি হল। পাকিস্তানে একদিনের শোক ঘোষণার কথাও জানান তিনি।
রাইসির মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। তিনি এই ঘটনাকে একটি অকল্পনীয় ট্র্যাজেডি হিসেবে বর্ণনা করেন।
এছাড়া শোক জানিয়েছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানি, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল প্রমুখ।
দুঃখের অনুভূতির অংশীদার হামাস : ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইরানের সঙ্গে ‘পূর্ণ সংহতি’ প্রকাশ করে বলেছে, তারা ‘ভ্রাতৃসম ইরানি জনগণের কষ্ট ও দুঃখের অনুভূতির অংশীদার’।
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই ইরান ইসরায়েলের চরম শত্রæ হয়ে আছে। ইরান মধপ্রাচ্যজুড়ে বছরের পর বছর ধরে তাদের বিভিন্ন ছায়া বাহিনীগুলো গড়ে তুলেছে, যাদের মধ্যে হামাস অন্যতম। হামাসকে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সমর্থন দিয়ে আসছে তেহরান।
মার্কিন সিনেটরের নেতিবাচক মন্তব্য : যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের সিনেটর রিক স্কট ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসিকে নিয়ে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি পোস্ট দেন। যদিও তার ওই পোস্ট দেয়ার সময় রাইসির নিহত হওয়ার খবর জানায়নি ইরান। সে সময় পর্যন্ত বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের খোঁজ চলছিল।
ওই পোস্টে রিপাবলিকান সিনেটর রিক বলেন, রাইসি যদি মারা গিয়ে থাকেন, তবে বলতে হবে, বিশ্ব এখন আগের চেয়ে নিরাপদ এবং ভালো জায়গা হয়ে উঠেছে। ওই মন্দ লোকটি অত্যাচারী ও সন্ত্রাসী ছিলেন। তাকে (রাইসি) কেউ ভালোবাসত না, সম্মান করত না। কেউ তার শূন্যতা অনুভব করবে না। রিক আরো লিখেছেন, তিনি যদি মারা গিয়ে থাকেন, তবে আমি সত্যিই আশা করি যে ইরানি জনগণ খুনি স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে নিজেদের দেশকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
এদিকে দুর্ঘটনার বিষয়ে মার্কিন সিনেটের ডেমোক্র্যাট নেতা চাক শুমার জানান, মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোনো সন্দেহ করার মতো কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু, তিনি পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছেন।
রাইসিকে ভাবা হতো পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা : রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী ৬৩ বছর বয়সি রাইসিকে দীর্ঘদিন ধরে ইরানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির স্বাভাবিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল।
কট্টরপন্থি ও ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল রাজনীতিক রাইসির সঙ্গে বিচার বিভাগ ও ধর্মীয় অভিজাতদের গভীর সংযোগ ছিল। ২০১৭ সালে তিনি প্রথম ইরানের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। পরে ২০২১ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজাভি খোরসান প্রদেশের প্রধান শহর মাশহাদে ১৯৬০ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম রাইসি নামে পরিচিত সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসুলসাদাতি। তিনি ১৫ বছর বয়সে বিখ্যাত কওম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। তারপর থেকে ওই সময়ের বেশ কয়েকজন মুসলিম পণ্ডিতের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বয়স ২০ ছাড়ানোর পর তিনি পরপর কয়েকটি শহরে অভিশংসক হিসেবে নিযুক্ত হন। পরে উপঅভিশংসক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে রাজধানী তেহরানে যান। ১৯৮৩ সালে তিনি মাশহাদের জুম্মার ইমাম আহমেদ আলমলহোদার কন্যা জামিলেহ আলমলহোদাকে বিয়ে করেন। তাদের দুজন কন্যা সন্তান আছে।
১৯৮৮ সালে পাঁচ মাসের জন্য তিনি বিচার বিভাগীয় একটি কমিটির অংশ ছিলেন। এই কমিটি রাজনৈতিক বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়ার তদারকি করেছিল। এই ভূমিকার কারণে তিনি ইরানের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আর যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে রাইসি তহরানের অভিশংসক নিযুক্ত হন। পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুলাহ খামেনির অধীনে রাইসির ক্রমপদোন্নতি হতে থাকে। ২০১৬ সালের ৭ মার্চ তিনি ইরানের দ্বিতীয় জনবহুল শহর মাশহাদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুদান সংস্থা আস্তান কুদস রাজাভির চেয়ারম্যান হন। এই পদ ইরানের ক্ষমতার বলয়ে তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
ইরানের ধর্মীয় ক্ষমতাবলয়ের দৃঢ় আস্থার পাত্র ছিলেন রাইসি। ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ নেতা রুহুল্লাহ খোমেনির সঙ্গে তার সম্পর্ক যেমন দৃঢ় ছিল পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ নেতা খামেনির সঙ্গেও তা-ই ছিল। খামেনি তাকে বেশ কয়েকটি জ্যেষ্ঠ পদে নিয়োগ করেছিলেন।
এসব সত্ত্বেও রাইসিকে ব্যাপক জনরোষ মোকাবিলা করতে হয়েছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জীবনযাত্রার নিম্নমুখী মানের কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। ২০২২ সালের শেষ দিকে ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু হলে গণঅসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটে। কয়েক মাস ধরে ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলতে থাকে। ২০২৩ সালের মাঝামাঝি এসে বিক্ষোভ স্তমিত হয়ে আসে, কিন্তু এরই মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে কয়েকশ মানুষের মৃত্যু হয়। এই অস্থিরতায় ভূমিকা থাকার অভিযোগে সাতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা নিয়ে দেশটির সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এ সময় ইসরায়েলের সঙ্গে চলা অচলাবস্থার মধ্যে দেশকে নেতৃত্ব দেন রাইসি। ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের ওপর ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলার নিন্দা করতে থাকে ইরান, পাশাপাশি ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ হিসেবে পরিচিত ইরানের আঞ্চলিক মিত্ররা ইসরায়েল ও এর পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠে।
এপ্রিলের প্রথমদিকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনসুলার ভবনে চালানো এক হামলায় দেশটির শীর্ষ কমান্ডার ও তার সহকারীসহ ৭ জন নিহত হয়। এ হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান। এরপর ১৫ এপ্রিল ইসরায়েলে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলের মুখ্য সামরিক মুখপাত্র দানিয়েলে হ্যাগারি জানান, ১২০টিরও বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ১৭০টি ড্রোন ও ৭০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে ইরান। তবে অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের সীমান্তে বাইরে ধ্বংস করে দেয়ায় ক্ষয়ক্ষতি সীমিত থাকে।
রাইসির সময়ে ইরানের আরেক আঞ্চলিক প্রতিদ্ব›দ্বী সৌদি আরবের সঙ্গে তেহরানের কূটনৈতি সম্পর্ক পুনর্স্থাপিত হয়। এ সময় ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার দৃঢ় সমর্থক ও অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবেও ইরান আলোচিত হয়।
ইরানে হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের এই ঘটনা এমন এক সময় ঘটেছে, যখন আঞ্চলিক উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে তোলার মতো অনেক বিষয় রয়েছে। লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনজুড়ে ইরানের প্রক্সি নেটওয়ার্ক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে। বিশেষ করে ইসরায়েল এবং হামাসের চলমান যুদ্ধের মাঝে আঞ্চলিক এই পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ এক প্রান্তে পৌঁছেছে। ইরানের নেতৃত্ব নিয়ে যে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে তা এসব গোষ্ঠীকে সম্ভাব্য বিস্তৃত সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
We hate spam as much as you do