ব্রিটিশদের হাতে তখন বন্দি কিশোর হরিপদ। তার ওপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। তার গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট, চুরুটের ছ্যাঁকা দেওয়া হচ্ছে আর জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, “বল তোকে কে পাঠিয়েছে, বল তোদের গুরু সেই মাস্টার কোথায়?”
বন্দেমাতরম
মনজিৎ গাইন
newscopes.in 15th august
মাস্টারদা খুব চিন্তার মধ্যে আছেন। চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের পরে তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা এখন বিভিন্ন জায়গায় সম্পূর্ণ আত্মগোপন করে রয়েছেন। ইংরেজ সরকার এখন তাঁদের সন্ধানে পুরো চট্টগ্রামের ওপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করেছে। মাস্টারদার খুব ইচ্ছা হচ্ছে তার এই গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে এসে ইংরেজদের এবং তাদের শাগরেদদের করা অত্যাচারের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা মাস্টারদাকে বারবার বারণ করছে, “না মাস্টারদা, এইভাবে তুমি বেরিও না। একবার যদি তোমার সন্ধান পায় ইংরেজরা তাহলে তোমাকে অবশ্যই ওরা ধরে ফেলবে আর একবার ওদের হাতে ধরা পড়লে কিন্তু আমাদের যে স্বপ্ন সেটা সম্পূর্ণ ভাবেই ব্যর্থ হবে। আমাদের স্বপ্ন এই ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের তাড়ানো কিন্তু তুমি যদি বাইরে না থাকো তাহলে এই স্বপ্ন সফল করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে।“
মাস্টারদাকে যেমন তার সঙ্গীরা খুব ভালোবাসে্ন, তেমনই মাস্টারদাও তাঁর সঙ্গীদের খুব ভালোবাসেন। তাই সঙ্গীদের কথা শুনে মাস্টারদা শুধু একটাই কথা বললেন, “হ্যাঁ, আমি শুধু সেই চিন্তাভাবনা থেকে এখনও নিজেকে বাইরে বার করে আনিনি। কিন্তু আমার নিজের যে একদম এই অত্যাচার সহ্য হচ্ছে না। আমি শুনতে পাচ্ছি চট্টগ্রাম পুলিশের ডেপুটি সুপার রায়বাহাদুর আসানুল্লা খান সব বিপ্লবীদের পরিবাররের ওপরে ভয়ানক অত্যাচার শুরু করেছে বিপ্লবীদের না পেয়ে। আর কেউ যদি বিপ্লবীদের স্বপক্ষে একটা কথা বলে তাহলে তাদের অবস্থা একদমই খারাপ করে দিচ্ছে। অনেক এইরকম মানুষদের বাড়িতে আসানুল্লা খান অত্যাচার চালাচ্ছে বিপ্লবীদের কোনোরকম সংবাদ পাওয়া যায় কিনা তা জানতে। এই অবস্থায় আমি নিজেকে কীভাবে আত্মগোপন করে রাখব এটা আমি যে নিজে কিছুই বুঝতে পারছি না।“
বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের এই কথা শুনে অন্য যারা বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সামনে তখন উপস্থিত ছিলেন তাঁরা বললেন, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আসানুল্লা খানকে তার অত্যাচারের শাস্তি আমরা অবশ্যই দেবো।“
মাস্টারদা এই কথা যারা বললেন সেই শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, সুশীল দে, বিনোদ দত্তদের তাকিয়ে বললেন, “তাহলে তোমরা যদি এই কাজটা সমাধা করতে পারো তাহলে আমার আপাতত নিজের এই ডেরা থেকে আর বেরোতে হচ্ছে না।“
মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গীরা বারবার চেষ্টা করতে লাগলেন চট্টগ্রামের অত্যাচারী পুলিশের ডেপুটি সুপার রায়বাহাদুর আসানুল্লা খানের ওপরে প্রাণঘাতী হামলা করে তার ওপরে এই সবকিছুর প্রতিশোধ নিতে। কিন্তু তাঁরা অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারল না তাদের উদ্দেশ্যে কারণ আসানুল্লা খানকে সবসময় ঘিরে রেখেছে চার থেকে ছয়জন দেহরক্ষী কারণ রায়বাহাদুর আসানুল্লা খনের বিপ্লবীদের পরিবারের ওপরে এইরকম অত্যাচারে যে বিপ্লবীরা তাকে টার্গেট করবে এটা ইংরেজরা খুব ভালোই জানত। আর ঠিক এই কারণেই আসানুল্লা খনের জীবনরক্ষায় সবসময় নিয়োজিত হয়ে রয়েছে অতজন নিরাপত্তারক্ষী। একজন নেটিভ পুলিশ অফিসারের জন্যে সবসময়ের জন্যে অতজন দেহরক্ষী অস্বাভাবিক লাগলেও সেটা বলা যায় ইংরেজদের তরফ থেকে একটা পুরস্কার আসানুল্লা খানের এই অত্যাচারের জন্যে। বিপ্লবীরা তাই বারবারই ব্যর্থ হচ্ছেন তাকে হত্যা করে তার কৃতকর্মের শাস্তি দিতে। বিপ্লবীরা তাই এবার একটু নিজেদের মধ্যে চিন্তাভাবনা করছেন কীভাবে তাঁদের নিজেদের এই ব্যর্থ হওয়ার খবরটা মাস্টারদাকে দেওয়া যায়। মাস্টারদা নিজে কোনো কাজে ব্যর্থ হওয়া একেবারেই পছন্দ করেন না। তারপর মাস্টারদা যদি বোঝেন তাঁর সঙ্গীদের দ্বারা এই কাজ কোনোমতেই হবে না তখন তো তিনি নিজে এই কাজে ব্রতী হবেন আর সেটা করতে গেলে তাঁকে তাঁর গোপন ডেরা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যেটা আবার তাঁর ক্ষেত্রে খুব বিপদের হয়ে উঠবে।
এদিকে মাস্টারদাও তাঁর গোপন ডেরা থেকে থেকে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন কখন তাঁর সঙ্গীরা তাঁর কাছে এসে অত্যাচারী আসানুল্লা খানের মৃত্যুসংবাদ দেবে। কিন্তু বেশ অনেকদিন হয়ে গেলেও মাস্টারদা তেমন কোনো খবর পেলেন না। তিনি নিজে তাই বেশ এইজন্যে হতাশই হচ্ছেন। এই অবস্থায় তাঁর কাছে তাঁর একজন খুবই বিশ্বস্ত অনুচর এসে হাজির। সূর্য সেন তাঁকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ব্যাপার, আসানুল্লা খানের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?”
মাস্টারদার এই প্রশ্ন শুনে সেই অনুচর ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, “না, আসানুল্লা খানের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি তবে আমাদের জন্যে একটা খারাপ খবর আছে।“
মাস্টারদা তাই শুনে জানতে চাইলেন, “কী খারাপ খবর?”
“আসানুল্লা খান জেলে বন্দি আমাদের সঙ্গী অম্বিকা চক্রবর্তীর ওপরে খুবই অত্যাচার চালানো শুরু করেছে।“
এটা শুনে মাস্টারদার মনে খুবই দুশ্চিন্তা। এমনিতে বিপ্লবী আন্দোলন করতে গিয়ে অম্বিকা চক্রবর্তী শরীরের খুবই অযত্ন করায় এখন ক্ষয় রোগে ভুগছেন। তাঁর এখন চিকিৎসার দরকার, যত্নের দরকার আর এখন তাঁকে এইভাবে অত্যাচার করা মানে তো তাঁর জীবন রাখাই এখন খুবই সমস্যার হয়ে যাবে। উদ্বিগ্ন মাস্টারদা তাই তাঁর অনুচরকে এবারে জিজ্ঞাসা করলেন, “অম্বিকার ওপরে কি খুব অত্যাচার করছে ওই আসানুল্লা?”
“হ্যাঁ, আসানুল্লা খান জেলে বন্দি অম্বিকা চক্রবর্তির ওপরে খুবই অত্যাচার চালাচ্ছে। প্রচন্ড মারধর করা হচ্ছে তাঁকে, শয়তান আসানুল্লা খান বারবার নিজে অম্বিকা চক্রবর্তীকে বুটের আঘাত করছে, ইলেকট্রিক শক দেওয়া হচ্ছে, এমনকি তিনি যদি কষ্টে-যন্ত্রণায় একটু জল খেতে চান তাহলে অত্যাচারী আসানুল্লা তাঁর মুখে তখন প্রসাব করে দিচ্ছে।“
আসানুল্লা খানের অম্বিকা চক্রবর্তীর ওপরে করা এই অত্যাচার শুনে মাস্টারদা নিজে খুবই শিউরে উঠে জানতে চাইলেন, “কিন্তু আসানুল্লা খানের অম্বিকার ওপরে এত অত্যাচার করার কারণটা ঠিক কী?”
“তাঁর একটাই উদ্দেশ্য আর সেটা হচ্ছে ওঁনার মুখ থেকে আপনার সম্বন্ধে আর আপনার অন্য সঙ্গী-সাথিদের সম্বন্ধে কিছু না কিছু খবর বার করা।“
এই কথা শুনে মাস্টারদার মুখ কোনো একটা কিছু করার প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় হয়ে ওঠে। তাঁর মুখে তখন শুধু একটাই কথা, “না, আমরা আর কোনোভাবেই এই শয়তান আসানুল্লা খানকে রেয়াত করতে পারব না। আমাদের যেকোনো মূল্যেই আসানুল্লা খানকে হত্যা করতে হবে।“
মাস্টারদা এবারে যাঁদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন আসানুল্লা খানকে খতম করবার জন্যে সেই শৈলেশ্বর চক্রবর্তী, বিনোদ দত্ত, সুশীল দে-দের ডাক পাঠালেন তাঁর সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করবার জন্যে। আর তাঁদের কাছে মাস্টারদার ডাক মানে সেটা সঙ্গে সঙ্গেই পালনীয়। তাঁরা সবাই মাস্টারদার কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। তাঁদের দেখে মাস্টারদা জানতে চাইলেন, “কী ব্যাপার, অত্যাচারী আসানুল্লা খানকে তোমরা এখনও হত্যা করতে পারোনি?”
মাস্টারদার অনুগামী বিপ্লবীরা বললেন, “না, আমরা সেটা পারিনি তার কারণ আসানুল্লা খানের নিরাপত্তার জন্যে সবসময়ই পাঁচ-ছয় জন নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা থাকে আর যার ফলে আমরা কোনোভাবেই আর আসানুল্লা খানের কাছে পোঁছোতে পারছি না।“
মাস্টারদা সূর্য সেন তাই শুনে বললেন, “ও, তাহলে তো তার কাছে পৌঁছোনো সত্যিই বেশ কঠিন কিন্তু যেভাবে হোক তার কাছে আমাদের কাউকে না কাউকে অবশ্যই পৌঁছোতে হবে। আর আমরা যদি এটা করতে দেরি করি তাহলে আমাদের চট্টগ্রামে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করবে এই ইংরেজরা ও তাদের অনুচর আসানুল্লা খান।“
মাস্টারদার কথায় বেশ উদ্বেগের ছায়া। অন্য বিপ্লবীরা তাই জানতে চাইলেন, “কিন্তু কী ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চলেছে ইংরেজরা ও আসানুল্লা খান এই চট্টগ্রামে?”
“এর মধ্যে চট্টগ্রামের জেলাশাসক ক্যামেরন ওই আসানুল্লাকে নিয়ে চট্টগ্রামের বেশ কয়েক জন মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছে। আর তাদের সম্পূর্ণ মদতে ইতিমধ্যে এই শহরের বেশ কিছু হিন্দুদের দোকান-পাট ও ঘরবাড়ি লুট করা হয়েছে।“
মাস্টারদার এই কথা শুনে বিপ্লবীরা বললেন, “তাহলে এখন তো চট্টগ্রামের খুবই বিপদ। আমরা কোনোভাবেই কি চট্টগ্রাম শহরকে এইভাবে সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে বাঁচাতে পারব না?”
“মুসলিম নেতারা আমাদের পাশে থাকায় সেই পরিস্থিতি আপাতত আটকানো গিয়েছে। বিশেষ করে চেয়ারম্যান নুর আহমদ এবং জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান বাহাদুর জালালুদ্দিন আহমেদের মতো মানুষজনের চেষ্টায় পরিস্থিতি খুব একটা খারাপ দিকে যায়নি। কিন্তু ওই আসানুল্লা খান যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকে তাহলে চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খুবই ঘোরালো করে তুলবে।“
“কিন্তু আমরা আসানুল্লা খানকে কীভাবে হত্যা করতে পারব এটা তো আমরা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।“
“সেটা আমি একটু ভেবে নেই তারপর দেখা যাবে আসানুল্লা খান কীভাবে আমাদের হাত থেকে নিস্তার পায় এত অত্যাচার করার পরে।“
মাস্টারদা এই কথা বলায় সবাই নিশ্চিত যে তিনি কিছু একটা পরিকল্পনা করবেনই আসানুল্লা খানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে। মাস্টারদাও ভাবছেন কীভাবে ওই অত্যাচারী আসানুল্লা খানকে হত্যা করবার জন্যে একটা পরিকল্পনা করা যায়। তাঁর মাথায় সবসময় ঘুরছে তাঁর পাঠানো বিপ্লবীদের বলা একটাই কথা আসানুল্লা খানকে সবসময়ই পাঁচ-ছয়জন দেহরক্ষী ঘিরে রাখে। সুতরাং তাঁকে এমন একটা পরিকল্পনা করতে হবে যাতে কোনোভাবেই আসানুল্লা খানের দেহরক্ষীদের কোনোরকম সন্দেহ না হয়। এটা ভাবতে ভাবতেই মাস্টারদার মাথায় আসে কিশোর বিপ্লবী হরিপদ ভট্টচার্যের কথা। মাত্র পনেরো বছরের এই কিশোরের ওপরে আসানুল্লা খান বা তাঁর দেহরক্ষীদের স্বাভাবিক ভাবেই কোনো সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। মাস্টারদা হরিপদকে সব বুঝিয়ে একটাই কথা বললেন, “হরিপদ, এই কাজটা যেন হয়। ওই আসানুল্লা খান চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের পরিবারদের ওপরে খুব অত্যাচার করছে আর তাঁর বেঁচে থাকা আমাদের চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে দেবে।“
হরিপদ মাস্টারদার সব কথা শুনে শুধু একটাই উত্তর দিল, “বন্দেমাতরম!”
হরিপদ যখন তার বাড়ি ছেড়ে চলে আসছে তখন তার মনে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছে। তার মায়ের জন্যে মন খুবই কাঁদছে। বাড়ি ছেড়ে চলে আসার আগের রাতে সে মায়ের সঙ্গে ঘুমোলো। তারপর ভোর রাতে সে গোপনে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে মা কালীর মূর্তিকে প্রণাম করে চলে গেল তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশ্যে। বিপ্লবী সরোজ গুহ তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হরিপদ, তোর কোনো ভয় করছে না তো?”
হরিপদ তাঁর দিকে একবার মৃদু হেসে শুধু বলল, “না, দেশমাতৃকার চরণে নিজেকে উৎসর্গ করেছি আর আমার কী ভয়!”
হরিপদর উত্তর শুনে বিপ্লবী সরোজ গুহ খুবই সন্তুষ্ট। এবারে হরিপদর অস্ত্রদীক্ষার পালা। হরিপদর হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন সরোজ গুহ। তারপর তাঁকে বললেন, “এটা জার্মান মাউজার। ঠিকঠাক এটা চালাতে পারলে আর তোর কোনো ভাবনা থাকার কথা নয়। আসানুল্লা খানের ওপর আমাদের প্রতিশোধ নিতে আর কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এবারে শুধু তোকে এই জার্মান মাউজার চালানো ঠিকঠাক শিখতে হবে।“
এরপর সরোজ গুহের কাছে হরিপদর পিস্তল চালানোর শেখা শুরু। সরোজ গুহ হরিপদকে বারবার এই কথাই বলছেন, “হরিপদ, তুই যখন আসানুল্লা খানের ওপর তোর ফাইনাল অ্যাটাক হানবি তখন তোকে তোর টার্গেটকে সবসময় আইসোলেট করতে হবে আর সবসময় ভাববি এই পৃথিবীতে তুই আর তোর টার্গেট ছাড়া তৃতীয় কোনো কেউ নেই।“
হরিপদর সঙ্গী নির্মল সেন। কর্ণফুলী নদীর তীর বেয়ে তারা দুজনে হাঁটছে। তাদের টার্গেট এখন আসানুল্লা খান। হরিপদকে আসানুল্লা খান সম্বন্ধে খবর দিচ্ছে আরেক ছদ্মবেশী বিপ্লবী চট্টগ্রামের সোডা ওয়াটারের দোকানে কর্মরত পান্নালাল সেন। সেই মতো খবর পেয়ে তারা এগোচ্ছে। নির্মল সেন হরিপদকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে নিজে সরে গেলেন যাতে হরিপদর ওপরে কোনো সন্দেহ না হয়। হরিপদ পরের দিন আসানুল্লাকে মারতে গিয়ে ব্যর্থ হল। এবারেও তার আর আসানুল্লার মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াল আসানুল্লা খানের দেহরক্ষীরা কিন্তু পনেরো বছরের কিশোর হরিপদ কোনোভাবেই দমবার পাত্র নয়। আর স্বয়ং সূর্য সেন তো তাকে বলে দিয়েছেন যাতে এই কাজটি যেন হয়।
হরিপদ খবর নিয়ে নিয়েছে আগস্টের ৩০ তারিখ আসানুল্লা খান উপস্থিত থাকবে চট্টগ্রামের নিজাম পল্টন খেলার মাঠে। যে ফুটবল প্রতিযোগিতা ওই মাঠে চলছিল তার ফাইনাল ছিল সেদিন। আর আসানুল্লা খানের সেদিন বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার কথা। হরিপদ ঠিক সময় বুঝে সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। তার পরনে অপরিচ্ছন্ন ফতুয়া আর ধুতি। খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। পুরস্কার বিতরণীর সময় চারপাশে বেশ বিশৃঙ্খলা। হরিপদ দেখে নিয়েছে এই সুযোগ। সে একজন অভিজ্ঞ শ্বাপদের মতো ঠিক তার শিকারের কাছে চলে গিয়েছে। সেইসময় তার মনে শুধু তার অস্ত্র-শিক্ষাগুরু সরোজ গুহর কথা, “হরিপদ, তুই তোর টার্গেটকে একদম আইসোলেট কর। এই পৃথিবীতে তখন শুধু তুই আর তোর টার্গেট।“
ঠিক এখন সে সেই পর্যায়েই পৌঁছে গিয়েছে। তার সামনে এখন শুধু তার টার্গেট অত্যাচারী আসানুল্লা খান। তাকে এবার সে আর কোনো সুযোগ দিল না। কোমরে গোঁজা জার্মান মাউজার তার হাতে চলে এল। এবারে পরপর তিনটে গুলি গুড়ুম-গুড়ুম-গুড়ুম! এখন হরিপদ চাইলে ওই ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারত কিন্তু তার কাজে কোনো রকম বাকি রাখা যাবে না। মাস্টারদার নির্দেশ যে তাকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। তাই সে এগিয়ে গিয়ে আসানুল্লা খানের বুকের ওপরে চেপে বসে তার জার্মান মাউজারের সবকটা গুলি অত্যাচারী আসানুল্লা খানের বুকে চালিয়ে দিয়ে বিজয়ীর চিৎকার করল, “বন্দেমাতরম!”
ব্রিটিশদের হাতে তখন বন্দি কিশোর হরিপদ। তার ওপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। তার গায়ে জ্বলন্ত সিগারেট, চুরুটের ছ্যাঁকা দেওয়া হচ্ছে আর জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, “বল তোকে কে পাঠিয়েছে, বল তোদের গুরু সেই মাস্টার কোথায়?”
কিন্তু হরিপদর মুখ দিয়ে কোনো উত্তর অত্যাচারী ইংরেজরা বার করতে পারেনি। সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে তবু তার মুখে তখন একটাই উচ্চারণ, “বন্দেমাতরম!”
তার পিছনে পায়ুপথে গরম ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পুরুষাঙ্গে দমাদম লাঠির বাড়ি। এত অত্যাচার করেও হরিপদর মুখ থেকে কোনো কথা ইংরেজরা বার করতে পারল না। এত অত্যাচারের পরেও একটা সামান্য কিশোর কোনো কথা বলছে না। ইংরেজদের দম্ভে ঘা লাগল। তারা হরিপদর বাড়ি, স্কুল সব ভেঙে জ্বালিয়ে দিল। হরিপদর বাবা-মা-ভাই সবাইকে গাছে বেঁধে বিশাল মারতে শুরু করল ইংরেজরা। কিন্তু হরিপদর মুখ দিয়ে কোনো কথাই তারা বার করতে পারল না। তার মুখ থেকে শুধু একটাই উচ্চারণ আর সেটা, “বন্দেমাতরম!”
পুলিশ সুপার জেকব সুটারের নির্দেশে শুরু হল জেলের মধ্যে হরিপদর মাথায় ইলেকট্রিক শক দেওয়া। তার সমস্ত মাথার চুল উঠে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও হরিপদর মুখ খোলাতে পারছে না ইংরেজরা। তখন পুলিশ সুপার জেকব তার জিপ গাড়ির পিছনে হরিপদকে বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে লাগল চট্টগ্রামের রাস্তা দিয়ে। হরিপদকে প্রথমে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় আসানুল্লা খানকে হত্যার অপরাধে কিন্তু দেশপ্রিয় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এবং শরৎ বসুর মতো বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী উকিলরা তার হয়ে আদালতে কেস লড়ায় শেষপর্যন্ত হরিপদের আন্দামানে দ্বীপান্তরের শাস্তি হয়।
প্রেসিডেন্সি জেলে হরিপদকে দেখার জন্যে স্বয়ং সুভাষ চন্দ্র বসু এসেছেন আর হরিপদকে দেখে সুভাষ চন্দ্র তাকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “দেশমাতৃকার এই বীর সন্তানের জায়গা সবসময় আমার হৃদয়ে। বন্দেমাতরম!“
হরিপদর যেন আর কিছু চাওয়ার নেই জীবন থেকে। সেও সুভাষ চন্দ্র বসুকে বলল, “বন্দেমাতরম!”
আন্দামানেও হরিপদর ওপর অনেক অত্যাচার হলেও ওখানেও তার মুখ কেউ খোলাতে পারেনি। এখনও আন্দামানের সেলুলার জেলে এগারো নম্বর থামে বাঙালি বন্দিদের নামের মধ্যে একশো তেরো নম্বারের নাম হিসাবে বেঁচে রয়েছে সেই পনেরো বছরের কিশোর বিপ্লবী হরিপদ ভট্টচার্য!
_________
We hate spam as much as you do