যা প্রকৃতপক্ষে চাহিদা বাড়াত তা হল – কৃষি ও অকৃষি শ্রমিক, শিল্প শ্রমিক ও কর্মচারীদের মজুরি বৃদ্ধি; C2+50% স্তরে বিভিন্ন পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের উপার্জন বৃদ্ধি করা (2006 সালে এমএস স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এবং 2014 সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী) ; ভারতীয় বাজারকে আমদানি থেকে রক্ষা করা, যাতে শিল্প, বিশেষ করে MSME (মাঝারি, ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ) সেক্টর ইউনিটগুলি বিকাশ লাভ করতে পারে; সরকারী খাতকে রক্ষা করা যা আরও কর্মসংস্থান এবং ভাল মজুরি দিতে পারে ; এবং প্রধান খাতে সরকারি ব্যয় না কমিয়ে সম্প্রসারণ করা, যেমন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ফলে পারিবারিক বাজেটের উপর ক্রমবর্ধমান বোঝা হ্রাস করা।
বাজেট 2025-26 ! শুধুমাত্র আয়কর হ্রাস করেই অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা যাবে না
চিরন্তন গাঙ্গুলী
02 Feb 2025
অনেক গভীর তথ্যমূলক ব্যাখ্যার মধ্যে না গিয়ে সাধারণ দৃষ্টিতে একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় গতকাল পেশ হওয়া কেন্দ্রীয় বাজেট 2025-26 দেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া বিপুল জনতা, যার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে তাদের খুব একটা উপকারে আসবে না। তার ফলে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমলে বাজারে চাহিদা কমবে। ফলে কাজের সুযোগ কমে যাবে। সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
ভারত সরকার মধ্যবিত্তের একটা অংশের আয়কর সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু ঘোষণা করে নিম্ন আয়ের হাজার হাজার শ্রমিক কৃষকের সমস্ত বিষয়কে অবহেলা করলো।
কেন্দ্রীয় বাজেটে আয়কর সংক্রান্ত কিছু ছাড় দেওয়ার পর পর সমস্ত টিভি চ্যানেল টকশো বিশেষজ্ঞ সরকারপন্থী অর্থনীতিবিদ এবং মূলত "গোদি মিডিয়া" বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, সকলেই একেবারে হৈ হই করে উঠেছে আর উত্তেজক প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন।
অনেকে এটাকে প্রমাণ হিসেবে উথ্থাপন করছেন যে নরেন্দ্র মোদী সরকার ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘পাম্প প্রাইম’ বা ‘কিক-স্টার্ট’ করার জন্য এটি করেছে।
মূল বিশ্লেষণ এ যাওয়ার আগে তাহলে এটা স্বীকার করতে হয় যে সরকার এখন জনগণের মধ্যে চাহিদা বাড়াতে চাইছে যা বেশ কয়েক বছর ধরে তারা করেনি। এবং এ নিয়ে বারবার বলা সত্ত্বেও তাদের চোখ বন্ধ ছিল।
2018-19 এর অর্থনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা দেখা দেওয়ার মূল কারণ হিসেবে যা লক্ষ্য করা যায়, অর্থাৎ দেশজুড়ে চাহিদা ক্রমশ কমছে কারণ ক্রয় ক্ষমতা কমছে কারণ বৃদ্ধির সমস্যা এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা কর্মসংস্থানহীনতা। মানুষের হাতে পর্যাপ্ত ক্রয় ক্ষমতা নেই মুদ্রাস্ফীতির ফলে তা আরো কমেছে।
সুতরাং মানুষের হাতে আরও বেশি অর্থ থাকার প্রয়োজন ছিল সেই সঙ্গে সরকারেরও কর্মসংস্থান মজুরি এবং অন্যান্য বাড়ানোর জন্য ব্যয় বরাদ্দ করা দরকার ছিল ।
নব্য উদারনৈতিক নীতি অনুসারে বছরের পর বছর এই পথকে উপেক্ষা করে এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় হ্রাস করতে থাকা হয়েছে, ফলে পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হয়েছে।
বর্তমান বাজেট কি সত্যিই চাহিদা বাড়তে সাহায্য করবে?
কিন্তু সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের একবার দেখে নেওয়া দরকার আয়কর সংক্রান্ত কি ঘোষণা করা হয়েছে? এটা অবশ্যই মধ্যবিত্তের কিছুটা উপকার হবে, মূলত যারা 7 লাখ থেকে 12 লাখ টাকা বছরে রোজগার করেন। অর্থাৎ মাসে 58 হাজার থেকে 1 লক্ষ টাকা আয় করেন।
এদের আয়কর সংক্রান্ত দায়বদ্ধতা থাকলো না । এদের কোন ট্যাক্স দিতে হবে না যারা 7 লাখ পর্যন্ত আয় করেন তারা যে কোন অবস্থাতেই এই ঘোষণার আগেও কিছুটা অব্যাহতি পেয়েছিলেন সুতরাং এটা বলাই যায় তথাকথিত মধ্যবিত্তরা কিছু সুবিধা পেলেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গোটা দেশে চাহিদা বাড়াবার জন্য এই "কিক স্টার্ট" কি যথেষ্ট? 2023-24. দুর্ভাগ্যজনকভাবে উত্তরটা হচ্ছে "না" একেবারেই না। এখন দেখা যাক কেন হবে না?
অত্যন্ত কৌতুকজনক ও কাকতালীয়ভাবে সংসদে বাজেট পেশ করার মাত্র দু'দিন আগে, সরকারের আর একটি সমীক্ষা সংস্থা, গৃহস্থালি ভোক্তা ব্যয় সমীক্ষার
Household Consumption Expenditure Survey (HCES)2022-23.সম্পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে।
অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে এই রিপোর্টে বিভিন্ন সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ে বাৎসরিক খরচ করার ক্ষমতা উল্লেখ করা হয়েছে।
গৃহস্থালীর ব্যয়কে আয় বা উপার্জনের একটি উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণীর জন্য, যা দেশের বিশাল জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ।
HCES কি প্রকাশ করে? স্থির মূল্যে, একটি চার সদস্যের পরিবারের গড় মাসিক খরচ গ্রামীণ এলাকায় 8,316 টাকা এবং শহরাঞ্চলে 14,528 টাকা৷ তার মানে গড় বার্ষিক আয় যথাক্রমে গ্রামে মাত্র 99,792 টাকা এবং শহরে 1,74,336 টাকা । বোঝাই যাচ্ছে এই বিপুল অংশ বর্তমান আয়কর ছাড় দেওয়া জনসমাজের বিভাগের অনেক নীচের আয়ের পরিবার।
বাস্তবিকই বিপুল অংশের মানুষ এই দেশে যারা আয়কর দেয় না সুতরাং আয়কর ছাড় দিয়ে চাহিদা বাড়ানোর যে লক্ষ্য তা অত্যন্ত কম সংখ্যক মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
কি করা যেতে পারত?
যা প্রকৃতপক্ষে চাহিদা বাড়াত তা হল – কৃষি ও অকৃষি শ্রমিক, শিল্প শ্রমিক ও কর্মচারীদের মজুরি বৃদ্ধি; C2+50% স্তরে বিভিন্ন পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদানের মাধ্যমে কৃষকদের উপার্জন বৃদ্ধি করা (2006 সালে এমএস স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এবং 2014 সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রচারে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী) ; ভারতীয় বাজারকে আমদানি থেকে রক্ষা করা, যাতে শিল্প, বিশেষ করে MSME (মাঝারি, ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোগ) সেক্টর ইউনিটগুলি বিকাশ লাভ করতে পারে; সরকারী খাতকে রক্ষা করা যা আরও কর্মসংস্থান এবং ভাল মজুরি দিতে পারে ; এবং প্রধান খাতে সরকারি ব্যয় না কমিয়ে সম্প্রসারণ করা, যেমন পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ফলে পারিবারিক বাজেটের উপর ক্রমবর্ধমান বোঝা হ্রাস করা। অর্থাৎ একটা পরিবারের ন্যূনতম মূল চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এর জন্য সরকারের ভূমিকা বাড়ানো একটা আয় বাড়বার এবং বিপুল চাহিদা বাড়বার গুরুত্বপূর্ণ উপায় হতে পারত।
এই সব এবং এর সাথে সংযুক্ত পদক্ষেপগুলি এমন বিপুল সংখ্যক লোকদের হাতে খরচের অর্থ বাঁচাতে পারত এবং চাহিদা তৈরি করত , যার ফলস্বরূপ নতুন উৎপাদনশীল ক্ষমতাগুলিতে আরও বেশি বিনিয়োগ হতে পারত, এইভাবে আরও কর্মসংস্থান তৈরি হত। এর ফলে চাহিদা আরও বাড়ত ...এই ভাবেই বাড়তে থাকত ।
আর একটা এই নীতির মূল চাবিকাঠি হল মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যা এখনো পর্যন্ত রহস্যময় জটিল অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্ত্রকদের হাতেই রয়েছে।
গণ বন্টন ব্যবস্থা বিপুল প্রসার যার ফলে বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন খাদ্যশস্য রান্নার তেল জ্বালানি বস্ত্র স্টেশনারি প্রভৃতি জিনিস যা প্রত্যেক পরিবারের একটা নির্দিষ্ট সহনশীল দামে সরবরাহ করা সম্ভব, যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই খোলা বাজারে জিনিসের দাম কমবে। জনগণের উপর পরোক্ষ করের বোঝা কমাতে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মতো স্রেফ টাকা তোলার জন্য যে তা কর প্রত্যাহার করতে হবে।
এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যে প্রচুর বিপুল ধনী ব্যক্তিদের আয়কর বাড়ানো তাদের উপর সম্পত্তি কর এবং কর্পোরেট কর বাড়িয়ে দেওয়া যা ২০১৮ সাল থেকে মোদি সরকার শুধু কমিয়ে যাচ্ছে।
এটা মনে রাখতে হবে কর্পোরেটদের লাভের পরিমাণ গত 15 বছরে সর্বোচ্চ অথচ তাদের কর দেওয়ার পরিমাণ সরকারের প্রাপ্ত করের মাত্র 17 শতাংশ তুলনামূলকভাবে সাধারণ আয়করের পরিমাণ এই বাজেটে দেখানো হচ্ছে 22%
এখনো পর্যন্ত কর্পোরেটদের কর কাঠামোর কোন পরিবর্তন করেনি।
এই সবকিছু না করে সরকার শুধুমাত্র আয়কর কাঠামোর পরিবর্তন করে একটা মনোভাব তৈরি করতে চাইলো যে তারা যেন এই অর্থনৈতিক মন্দা সম্পর্কে চিন্তিত এবং তা সমাধান করতে চান। যা উপরে আলোচনা হল তাতে দেখা গেল প্রকৃত অবস্থায় এর থেকে অনেক দূরে। আয়কর পরিবর্তন শুধুমাত্র একটা কৌশল যে মধ্যবিত্ত অংশ খানিকটা বিরক্ত তাদের একটু সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা।
এর একটা উদ্দেশ্য হতে পারে সামনে দিল্লির নির্বাচন এবং বিজেপিকে আম আদমি পার্টির সামনে একটা কঠিন লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে এই বাজেটের আয়কর সংক্রান্ত ঘোষণা বিজেপিকে কিছুটা বাড়তি সুবিধে দিতে পারে বলে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ধারণা
কিন্তু যদি কেউ বাজেটের বিশ্লেষণ করে দেখেন , তবে এটা স্পষ্ট হবে যে ভারতে আন্তর্জাতিক পুঁজির লগ্নীর উদ্দেশ্য (নিরাপদ পোতাশ্রয়ের ব্যবস্থা, অপরাধমূলক দায় কমানোর উদ্দেশ্যে ) বা দেশীয় কর্পোরেটদের মঙ্গল বাড়ানোর জন্য সরকারের ওপর স্পষ্ট চাপ এখনও রয়েছে।
সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির উপর নয়া উদারনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এখনও রয়েছে - গত বছরের তুলনায় বাজেটে ব্যয়ে মাত্র 7% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা মূদ্রাস্ফীতির হিসাব করলে নিষ্ফল হবে।
কল্যানমূলক প্রকল্প বৃদ্ধির কোন পরিকল্পনা নেই। সাধারণত বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ লোকেদের মধ্যে একটা হইচই তৈরি করা হচ্ছে যে তাদের চাকরি হবে অথবা তারা ক্ষুদ্র ঋণ পাবে (হোম স্টে ম্যানেজারদের মত)
আসলে সরকারের নীতি এমনভাবে আটকে রয়েছে যে যা জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলি আনছে না - এবং প্রতি বছর একই ভাবে নানা আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে একই নীতি একটু এদিক ওদিক করে প্রনোয়ন করা হচ্ছে।।
We hate spam as much as you do