১৯শে মে দুপুর আড়াইটায় শিলচর রেল স্টেশনে তারা ধর্মঘটরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। শত শত লোক আহত হয়। গুলিতে শহীদ শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।
১৯শে মে ১৯৬১ শিলচরের ভাষা শহীদদের মনে রেখে।
ভারতবর্ষের ধর্ম ভাষাগত যত বিবাদ ও সংঘর্ষ তার প্রতিটি ব্রিটিশদের অবদান। পলাশীর যুদ্ধ থেকে ইংরেজ তাদের আধিপত্যের জাল সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে দিলেও কোলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী এবং একই সঙ্গেঁ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উত্তর ভারত, মায়ানমার, শ্রীলংকানদের জন্য বিদ্যা শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র
যার ফলেই রাজ্যের যে সকল অসমীয়রা ইউরোপীয় সাহিত্য চর্চা, বাংলা সাহিত্য ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয় উঠেছিল তাদের সকলেরই শিক্ষার বহন ছিল বাংলা। অনেক মনীষীর মতো বীর বিদ্রোহী মনিরাম দেওয়ান অসমের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ধর্ম-বর্ণ-জাতি নিয়ে যে ইতিহাস কামরুপ বা বুরঞ্জী রচনা করেন তারও ভাষা ছিল বাংলা। মূলত আঠারো শতকের মধ্যবর্ত্তী সময় পর্যন্ত রাজ্যের অসমীয়া ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে একটি পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের ঐতিহ্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বাংলা ও বাঙালীর প্রাধান্য মেনে নিতে পারেনি। রাজনৈতিক বিভাজন তৈরী করে অসমীয়া ও বাঙালীদের মধ্যে ভাষাই তখন ইংরেজের কাছে প্রধান হাতিয়ার হয়ে দঁড়ায়। এ.জে. মোয়াটে মিলস্ নামে একজন ইংরেজ কর্মচারী হঠাৎ করেই রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। বৃটিশের এই রাজনৈতিক দূরভীসন্ধিমূলক কাজের অংশীদারিত্ব গ্রহণ করে তাদেরই দোসর আমেরিকান ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা। মিশনারীরাই প্রথম অসমীয়া ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান ও সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠার কাজ করে। এরপর থেকে আঠারো শতকের শেষ দিকে দেখা গেল রাজ্যের অনেক জেলার স্কুল ও আদালতে সরকারী ভাষা হিসাবে অসমীয়া ভাষা ব্যবহৃত হতে থাকে। এই সময়ে একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে অসমীযা ভাষাকে রাজ্য ভাষা হিসাবে স্বীকৃতির প্রশ্নে বাঙালীরা কিন্তু কখনোই বিরোধীতা করেনি মিলসের পর এডওযার্ড গেইট বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সর্ম্পকে তীর্যকপূর্ণ মন্তব্য উপস্থাপন করলে তখন থেকেই মূলত শুরু হয় ভাষা বিষয়ক বিতর্ক ।
ইংরেজের বিভাজননীতি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঁ-হাঙ্গামা মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগষ্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
দু’টি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার সময়ে অধুনা বাংলাদেশের শ্রীহট্টের সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তখন প্রায় তিন লাখ চা-বাগান শ্রমিক, তারা আসামে আশ্রয় নেয়। অনেক অবস্থাপন্ন পরিবারও সিলেট ছেড়ে আসামে উদ্বাস্তু হয়।
এরপর স্বাধীন ভারতে বহু জাতি ও বহু ভাষাগোষ্ঠী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে বাঙালিকে বিদেশি এবং বহিরাগত রূপে চিহ্নিত করার হীন অপপ্রয়াস শুরু হয়।
আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরফলৈ তখন নতুন নীতির কথা ঘোষনা করে বলেন-”Assam is for Assamese ”।মহাত্ম গান্ধী অবশ্য এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন-” If Assam is Assame; India for whom ”।
দেশ বিভাগের যন্ত্রণা অনেকের মনেই গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সর্বশান্ত হয়ে বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি,হিন্দু, শিখ, খ্রীষ্টান, মুসলমান দলে দলে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। নেহেরু সরকারও তাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। তবে সবচেয়ে বেশী দেশত্যাগ করে বাঙালী হিন্দুরা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাঙালী হিন্দুরা কোলকাতা ও আসাম যাওয়া শুরু করে। ভারতের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী নেতারা দেশ বিভাগকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসাবে মেনে নিলেও পাকিস্তান থেকে নির্যাতিত মানুষের ভারতে আশ্রয় গ্রহণকে মেনে নিতে পারেনি। আসামের উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়লেন”ভারসাম্য রক্ষার জন্য”। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালের শুরু হয় আনষ্ঠানিকভাবে বাঙালী খেদা’ আন্দোলন। অসম্ভব কুৎসিত বিদ্বেষ তৈরি করে হাজার হাজার বাঙালীকে সেদিন আসাম ছেড়ে অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। অবশ্য তখন কিছু কিছু বাঙালীকে আবার পুর্নবাসনের নামে আসামে আশ্রয়ও দেয়া হয়। এই সময় অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বহু বাঙালিকে মাতৃভাষা হিসাবে অসমীয়া ভাষা লিখে নথিভুক্ত করানো হয় । ফলে বাঙালির সংখ্যা আদতে একই থাকলেও তা লিখিতভাবে কমে যায় । ১৯৫১ সালে প্রথম লোকগননায় দেখা গেল, সংখ্যাতত্ত্বের দিক থেকে বাঙালী সংখ্যা শতকরা ১৭ আর অসমীয়াদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হল শতকরা ৫৫। অথচ ১৯৩১ সালের লোক গনণার হিসাবে দেখা যায় আসামে বাঙালীর সংখ্যা ছিল ৪.৭৬ লক্ষ আর অসমীয়ার সংখ্যা ১.৬১ লক্ষ মাত্র। ২০ বছরের ব্যবধানে অসমীয়া রাজ্যে ব্যাপক সংখ্যক অসমীয়া ভাষাভাষী মানুষের বৃদ্ধি ও বাঙালী ভাষাভাষী মানুসের হ্রাস তৎকালীন লোকগনণার অধীক্ষক আর বি ভাগাইওয়ালা বলেছিলেন ” Biological Miracle ” ।
ফলে বাঙালি অসমিয়া সুসম্পর্ক আর বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি আসামের উগ্রজাতীয়তাবাদী নেতাদের আধিপত্যের জোরে। ফলে দেখা গেলো দেশ স্বাধীন হবার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমশই বাংলা ভাষার ব্যবহার সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল। পক্ষান্তরে অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার শুরু হল। রাজ্যের লোকাল বোর্ড থেকে জানিয়ে দেয়া হল যে, যদি কোন বিদ্যালয় অসমীয়া ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ না করে তবে সে স্কুলের অনুদান বন্ধ করে দেয়া হবে।
ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ এর মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও সরকারের এই বৈষম্য বজায় ছিল। বিভিন্ন কলেজে উল্লেখযোগ্য বাঙালী ছাত্রের উপস্থিতি থাকলেও সেখানে মুখপত্রে কোন বাংলা বিভাগে লেখার সুযোগ দেয়া হতো না। অথচ ছাত্রছাত্রীদের নিকট থেকে ম্যাগাজিন ফি রীতিমতই নেয়া হয়।
রাজ্য কংগ্রেসের অসমিয়া নেতৃবৃন্দ যখন রাজ্য ভাষা হিসাবে একমাত্র অসমীয়াকেই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন তখন বাঙলাভাষী নেতৃবৃন্দ ও আদিবাসী নেতৃবৃন্দ এর তীব্র বিরোধীতা করেন। সমগ্র প্রদেশ জুড়েই ভাষা আন্দোলনের বিদ্রোহ
জ্বলে উঠে।
১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে আসাম রাজ্যের সর্বত্র অনসমিয়া ভাষীদের মধ্যে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশ্য বেসরকারিভাবে উত্থাপিত ওই প্রস্তাব তখন বিবেচনা না করে স্থগিত রাখা হয়।
ভাষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৬০ এর এপ্রিলে। ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক সভায় অসমিয়াকে আসামের একমাত্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর পর পরই আসাম প্রদেশের শাসকরা উগ্র ভাষাপ্রেমের পক্ষে অবস্থান নেন এবং অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার অপচেষ্টায় সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেন।
এর ফলে বিশেষত বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সরকারি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৬০ সালের ২১ জুন শিলচরে ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’ এর উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
লোকসভা সদস্য শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় আলতাফ হোসেন মজুমদার, নন্দকিশোর সিংহ, নিবারণচন্দ্র লস্কর, রথীন্দ্রনাথ সেন, গোলাম ছগির খান, শরৎচন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং প্রতিবাদ জানান। সভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে বাঙালিদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে সংহত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ওই বছরের ২ ও ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় ‘নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন’। এই সম্মেলনে আসাম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৫ হাজার বাঙলাভাষী মানুষ সমবেত হয়। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলন পরিণত হয় মহাসম্মেলনে। সভায় আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়ার প্রবর্তন স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়।
এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরই সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাব্যাপী শুরু হয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা। অসমিয়াপন্থী উগ্র দাঙ্গাবাজরা পথে নামে। নির্বিচারে বহু বাঙালির বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুঠতরাজ, হত্যা ও ধর্ষণ চলে অসমিয়া ভাষা আন্দোলনের নামে।
কংগ্রেসের সবার এতে সমর্থন ছিল না। প্রশাসনের এক শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদী কর্তাব্যক্তি ও পুলিশ কর্মকর্তা এসব ঘটনায় নেপথ্যে ইন্ধন জোগান।
১০ অক্টোবর আসাম বিধান পরিষদে আসাম সরকারি রাজ্যভাষা বিল উত্থাপন করা হয়। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিল নিয়ে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সব সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়।
এভাবে আসামের বিভিন্ন অসমিয়া উপজাতি গোষ্ঠী ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লাখ লাখ বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবি উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত হয়। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মাতৃভাষার অধিকার বঞ্চিত লাখ লাখ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।
১৯৬০ সালের ৬ ও ৯ নভেম্বর নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলনের উদ্যোগে কনভেনশন আহ্বান করা হয়। কনভেনশন সংবিধান স্বীকৃত ভাষা-অধিকার সুরক্ষা করা ও মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়সহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমেই সংহত রূপ নিতে থাকে। ১৯৬০-এর ১৮ ও ২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় উপত্যকা তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। ওই অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি মর্যাদা দেওয়া না হলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়।
১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জনসম্মেলন। সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবি তোলা হয়। অন্যথায় সমগ্র জেলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই বছরের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পালিত হয় ‘সংকল্প দিবস’। সংকল্প করা হয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসেবে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা।
দুই সপ্তাহ ধরে পদযাত্রীরা ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন। গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালান। ২ মে তারা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯ মে ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসেবে কাছাড় জেলার সর্বত্র পালিত হয় হরতাল। আগের রাতে করিমগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে চলে পুলিশি হামলা। আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয় অনেক নেতাকর্মীকে। সে খবর দাবানলের মতো রাতেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শহর জেগে ওঠে উত্তেজনায়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জনতা নামে রাজপথে।
১৯ মে ভোর চারটায় শিলচর রেল স্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহীদের অবরোধ। জেলার সর্বত্র একই সময় থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘট কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। দোকানপাট যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। কোর্ট-কাছারি, ডাকঘর, অফিস-আদালত সব কার্যালয়ের সামনে চলে পিকেটিং। গ্রেফতার বরণ করেন হাজার হাজার কর্মী।
আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখে শাসকগোষ্ঠী মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য তারা বেছে নেয় চরম নির্যাতনের পথ।
১৯শে মে দুপুর আড়াইটায় শিলচর রেল স্টেশনে তারা ধর্মঘটরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। শত শত লোক আহত হয়। গুলিতে শহীদ শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।
১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর উগ্র ভাষানীতির মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন করে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার; তেমনিভাবে ভাষা আন্দোলনের আর এক ইতিহাস রচিত হলো বরাক উপত্যকায়। তাতে খচিত হলো ১১ শহীদের নাম।
এ ঘটনায় সারা ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। ২১ মে শিলচর সহ সমগ্র কাছাড় জেলায় রেলকর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেন। শিলংয়ে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন শোক পালন করে। শোক পালিত হয় জলপাইগুড়িতে।
কলকাতায় তীব্র প্রতিবাদ ওঠে সভা, সমিতি, মিছিলে। শহীদ স্মরণে শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। ২৩ মে গৌহাটি, শিলং, জাফলং, আইজল ও আগরতলায় পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিভিন্ন বামদল সম্মিলিতভাবে ২৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে পালন করে প্রতিবাদ দিবস।
২৪ মে বরাকের বুকে বিশ হাজার সত্যাগ্রহী আসাম সরকারের বিদ্বেষনীতির বিরুদ্ধে আমরণ সত্যাগ্রহের শপথ নেয়। ২৬ মে ঈদ উৎসবের দিন বরাক উপত্যকার সর্বত্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে হত্যাকাণ্ডের নীরব প্রতিবাদে সামিল হয়। ২৯ মে পালিত হয় ভাষা শহীদ তর্পণ দিবস।
আজও দেশজুড়ে এই বিভেদ রাজনীতির বিষয় আলোচনা করার প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে। অসমে NRC - CAA এর নাম করে বাঙলাভাষী ও অন্য ভাষার মানুষের বিতাড়নের ভয় দেখানো হচ্ছে । বহু মানুষ এখনো ডিটেনসন ক্যাম্পে। এবারের ভোটে সেই তীব্র বিভাজনের রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল। তাই এই ভাষা আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতার সাথে ২১শে ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে না ফেললেও ১৯শে মে এর শহীদরা বাঙলার কাছে চিরস্মরণীয় ।
We hate spam as much as you do