Tranding

03:31 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / গণেশঃ গণপতি থেকে গজানন, বিনায়ক থেকে বিঘ্নেশ

গণেশঃ গণপতি থেকে গজানন, বিনায়ক থেকে বিঘ্নেশ

তামিলনাডুতে গণেশ হলেন পিল্লাই বা পিল্লাইয়ার। তামিল ভাষায় পিল্লে মানে আদুরে শিশু। গাল পাড়ার সময় হিন্দিতেও মনুষ্যেতর প্রাণীর বাচ্চা বোঝাতে ওই প্রাণীটির সঙ্গে তামিল পিল্লে শব্দটি জুড়ে দিতে আমরা দেখেছি - যেমন কুত্তে কি পিল্লে। আবার পালি ভাষায় পিল্লাকা মানে হস্তীশাবক। তামিল পিল্লু মানেও বাচ্চা হাতি কিম্বা হাতির দাঁত। তাহলে কি হাতির মুখওয়ালা গনেশ আদতে আর্য্য দেবতাই নয়! জনপ্রিয় কোনো দেশজ দেবতা বা টোটেমকে ব্রাম্ভণ্যধর্মে আত্মীকরণ করার উদ্দেশ্যেই কি তবে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতক ও তার পরবর্তী সময়ে লিখিত পুরাণগুলিতে গণেশ নিয়ে এত চর্চা; এত লেখালিখি! 

গণেশঃ গণপতি থেকে গজানন, বিনায়ক থেকে বিঘ্নেশ

গণেশঃ গণপতি থেকে গজানন, বিনায়ক থেকে বিঘ্নেশ


আজ গণেশ চতুর্থী। অবশ্য বছর পনেরো আগেও গণেশ চতুর্থী বলতে এক ওই বলিউডি সিনেমায় ঝমাঝম বাজনার সঙ্গে গণপতি বাপ্পা মোরিয়া ধ্বণি সহযোগে কোমর দোলানো উদ্দাম সম্মেলক নাচের তালে অতিকায় গণেশ মূর্তির আরব সাগরে বিসর্জন ছাড়া বিশেষ কিছু বুঝতাম না। আমাদের ছোট বেলায় এই বঙ্গদেশে গণেশের কদর দেখা যেত ছোট বড় সবরকম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে পয়লা বৈশাখের দিন আর অবশ্যই দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে দেবী দুর্গার সঙ্গে মন্ডপে মন্ডপে। বঙ্গের কুচোকাঁচাদের মুখেমুখে ঘুরতে থাকা সেই মজার ছড়া 'গণেশ দাদার পেটটি নাদা'র মধ্যে দিয়ে যেন বাঙালির এক রকম আত্মীয়তারই প্রকাশ ঘটতো গণেশের সঙ্গে।  বাংলা বাগধারায় ব্যবসায় ভরাডুবি বোঝাতে গণেশ উল্টানো অথবা বোকাসোকা বোঝাতে গোবর গণেশ শব্দগুচ্ছের ব্যবহার বহুকাল ধরেই চলছে। 

 

সেই অর্থে গণেশ চতুর্থী উদযাপন কিন্তু বাংলায় কার্যত নতুনই। বাংলার শহরাঞ্চলে, বিশেষ ক'রে নগর কলকাতার দ্রুত বদলাতে থাকা ডেমোগ্রাফির কারনে মূলতঃ অবাঙালিদের হাত ধরেই ইদানিং এ শহরে গণেশ পুজোর এত ধুম। একে এক ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও বলা চলে বোধহয়। কেননা আম বাঙালির কাছে গণেশ যত না 'গণপতি বাপ্পা মৌরীয়া' তার থেকে বরং সে ঢের বেশি যেন আমাদেরই ঘরের মেয়ে উমার নাদুস নুদুস আদুরে ছেলেটি।  

 

এখন প্রশ্নটা হ'ল এহেন হাতির মাথাওয়ালা বকচ্ছপ দেবতাটির হঠাৎ আবির্ভাব হ'ল কোথা থেকে! এ কথা ঠিক যে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরানো ঋগ্বেদে 'গণপতি'র উল্লেখ আছে; তবে সে গণপতি কিন্তু হাতির মাথাওয়ালা আমাদের পরিচিত গণেশ নন; বরং সম্ভবত ইন্দ্রকেই জনগনের অধিপতি হিসাবে গণপতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়ে থাকবে। 

খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে নির্মিত কিছু ইন্দো-গ্রিক মুদ্রায় হাতির মুখোশ আবৃত মানুষের মুখাবয়ক খোদিত থাকতে দেখা যায়। তবে কি গ্রিকদের থেকেই এদেশে গজানন গনেশের ধারনাটি এসেছিল কোনো এক কালে! পরবর্তী কালে মথুরা অঞ্চলে প্রত্নতাত্বিক খননের ফলে খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের গণেশ মূর্তির খোঁজ মেলে। মোটামুটি খ্রীষ্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে, মানে প্রধানত গুপ্ত যুগেই গণেশ ক্রমশঃ অন্যতম প্রধান দেবতায় উন্নীত হয়। আসলে ওই সময়কালে রচিত গণেশ পুরাণ, মুদ্গল পুরাণ, ব্রম্ভ পুরাণ,ব্রম্ভান্ড পুরাণ, তৈত্তীরীয় সংহিতা ইত্যাদি একাধিক পুরাণে গণেশের উৎপত্তি বিষয়ে নানা রকম ব্যাখ্যা হাজির করা হতে থাকে। জনপ্রিয়তম ব্যাখ্যাটি হ'ল শিবের অনুপস্থিতিতে পার্বতীর দেহের ময়লা থেকে গণেশের জন্ম হয়। এরপর শিব ফিরে এসে তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে গেলে ওই শিশু তাকে বাধা দেয় এবং রুষ্ট শিব তার মস্তকচ্ছেদন করে। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে এবং ক্ষুব্ধ পার্বতীর ক্ষোভ প্রশমিত করতে শিব পার্বতীকে কথা দেন যে তিনি প্রথম যাকে দেখবেন তার মাথাই জুড়ে দেবেন মৃত পার্বতী পুত্রের দেহে। শেষে তার নজরে পড়ে এক হস্তী। সঙ্গে সঙ্গে সেই হাতির মাথা কেটে এনে তিনি গনেশের ঘাড়ে জুড়ে দেন এবং গণেশকে বাঁচিয়ে তোলেন। এখন ওই হাতিকে বধ করতে গিয়ে তার একটি দাঁত ভেঙ্গে যায়। তাই গণেশের দেহে ওই একদাঁত ভাঙ্গা মাথাটিই জুড়তে হয়। সেইকারনেই গণেশের আর এক নাম একদন্ত। অন্য একটি পুরাণ কথা অনুযায়ী গনেশের জন্ম নাকি শিবের অট্টহাস্য থেকে। ব্রম্ভান্ড পুরাণ অনুযায়ী আবার গণেশের নাম লম্বোদর হওয়ার কারন হ'ল তার দেহে তিনি নাকি একই সঙ্গে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কে ধারন করেছেন।ফলে উদর তো কিছুটা বড়সর হবেই।

 

তামিলনাডুতে গণেশ হলেন পিল্লাই বা পিল্লাইয়ার। তামিল ভাষায় পিল্লে মানে আদুরে শিশু। গাল পাড়ার সময় হিন্দিতেও মনুষ্যেতর প্রাণীর বাচ্চা বোঝাতে ওই প্রাণীটির সঙ্গে তামিল পিল্লে শব্দটি জুড়ে দিতে আমরা দেখেছি - যেমন কুত্তে কি পিল্লে। আবার পালি ভাষায় পিল্লাকা মানে হস্তীশাবক। তামিল পিল্লু মানেও বাচ্চা হাতি কিম্বা হাতির দাঁত। তাহলে কি হাতির মুখওয়ালা গনেশ আদতে আর্য্য দেবতাই নয়! জনপ্রিয় কোনো দেশজ দেবতা বা টোটেমকে ব্রাম্ভণ্যধর্মে আত্মীকরণ করার উদ্দেশ্যেই কি তবে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতক ও তার পরবর্তী সময়ে লিখিত পুরাণগুলিতে গণেশ নিয়ে এত চর্চা; এত লেখালিখি! 

 

মহাভার্গব সূত্রে বিনায়ক হ'ল অশুভ শক্তি। আবার গনেশকেই বলা হয় বিনায়ক - যার অর্থ তখন বিঘ্ননাশক বা বিঘ্নেশ। দক্ষিণ ভারতে অষ্টবিনায়কের মন্দিরও আছে। এ থেকেও এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারন থাকে যে অব্রাম্ভণ কোনো দেবতাকে ব্রাম্ভণ্য ধর্মে অঙ্গীভূত করার একটা প্রয়াস ছিলই। আবার মহাভারতে আমরা দেখেছি শর্ত সাপেক্ষে ব্যসদেবের মুখনিঃসৃত কাব্যটি লেখার দায়িত্ব নিচ্ছেন গণেশ আর সেই শর্ত পালন করতে গিয়ে কি ভাবে নেস্তনাবুদ হতে হচ্ছে কথক ব্যাসকে, গনেশকে যাতে থামতে না হয় সেজন্য রচনা করতে হচ্ছে দীর্ঘ ও জটিল সব শ্লোক। তবে মহাভারতের প্রাচীনতম যে ৫৯ টি পান্ডুলিপি পাওয়া গেছে তার ৩৭ টিতে লেখক গণেশের কথা আছে, ২২ টিতে কিন্তু নেই। ইতিহাসবিদদের ধারনা সম্ভবত খ্রীষ্টীয় নবম শতকে এই ব্যাসদেব-গণেশ অংশটি মহাভারতে সংযোজিত হয়ে থাকবে। 

 

গণেশের নানা নাম - সিদ্ধিদাতা, একদন্ত, হেরম্ব, বিনায়ক, বিঘ্নেশ, বিঘ্নবিনাশক, দ্বয়ীমাতুর, শ্রী,লম্বোদর, পিল্লাই এবং আরও বহু। আনুমানিক ৪০০ খ্রীষ্টাব্দে রচিত অমরকোষে গণেশের সহস্র নাম আছে। মোটামুটি পঞ্চম শতক পরবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে চিন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও জাপানে  পৌঁছে যায় গণেশ। মায়ানমারে গণেশের নাম মহাপেইনি (পালি ভাষায় মহাবিনায়ক থেকেই হয়তো এই নাম), থাইল্যান্ডে ফ্রা-ফ্রিকানেট, জাপানে গনেশের নাম কাঙ্গিতেন। চিনের উত্তর অংশে খুঁজে পাওয়া সে দেশের প্রাচীনতম প্রস্তর নির্মিত গণেশমূর্তিটি ৫৩১ খ্রীষ্টাব্দের। ব্রাম্ভন্য ধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে বৌদ্ধ তান্ত্রিক ও জৈন ধর্মেও গণেশ একসময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি ইসলাম প্রধান ইন্দোনেশিয়ার কারেন্সি নোটে আজও দেখা যায় গণেশের ছবি।

 

গণেশের স্ত্রীর প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের বাঙালিদের চোখে একবাক্যে লালপাড় সাদা শাড়ি ও ঘোমটায় নুয়ে পড়া কলা-বৌয়ের ছবিটাই ভেসে ওঠে। উত্তর ভারতে কিন্তু গণেশের তিন তিনজন স্ত্রী - বুদ্ধি, সিদ্ধি ও ঋদ্ধি। এদের সন্তান হল শুভ ও লাভ। আমরা তো সরস্বতীকে গণেশের বোন বলেই জানি। কিন্তু পশ্চিম ভারতে, বিশেষ করে মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে সারদা বা সরস্বতী হল গনেশের স্ত্রী। সারদা ও গণেশের কন্যাই হল সন্তোষী মাতা। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতে গণেশ আবার পুরোদস্তুর অবিবাহিত ব্রম্ভচারী। বোঝো কান্ড। 
একইভাবে উত্তর ভারতে কার্তিক বা স্কন্দ হল বড় ভাই। দক্ষিণে গনেশই জ্যেষ্ঠভ্রাতা।

প্রথম দিকে গণেশের হাত ছিল দুটি। পরের দিকের মূর্তিতে চতুর্বাহুর আবির্ভাব হয়। আবার নবম দশম শতকে  ১৪ থেকে ২০ বাহু বিশিষ্ট গণেশও দেখা গেছে। 


একই ভাবে একেবারে গোড়ায় পদ্মাসনা গণেশের কোনো বাহন ছিল না। গণেশ পুরাণে বাসুকি নাগকে তাঁর গলায় উপবীতের মত জড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। সপ্তম শতাব্দীতে গণেশের বাহন হিসাবে মূষিক বা ইঁদুরের আবির্ভাব। পরবর্তী কালে মুদ্গল পুরাণে বর্ণিত আট ধরনের গনেশের মধ্যে পাঁচ প্রকারের বাহন হিসাবে ওই ইঁদুরকেই দেখা গেলেও বক্রতুন্ড রূপী গণেশের বেলায় সিংহ, বিকত গণেশের বাহন হিসাবে ময়ূর এবং বিঘ্নরাজ গনেশের ক্ষেত্রে শেষ নাগকে বাহন হিসাবে বর্ননা করা হয়েছে। পাশাপাশি গণেশ পুরাণ অনুযায়ী মহোৎকট গণেশের বাহন সিংহ, ময়ূরেশ্বরের বাহন ময়ূর, ধুম্রকেতু রূপী গণেশের বাহন ঘোড়া ও গজাননের বাহন মূষিক। অন্যদিকে জৈনদের গনেশের আবার ইঁদুর ছাড়াও হাতি, ময়ূর, ভেড়া বা কচ্ছপের মত বিচিত্র সব বাহন দেখা যায়। 

 

সে যাই হোক খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে দেবতা হিসাবে গণেশের এহেন ক্রমঃউত্থান দেখে এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারন থেকেই যায় যে আসলত কোনো জনপ্রিয় অব্রাম্ভন উপজাতীয় দেবতাই ছিলেন গণেশ, যাকে পরে ব্রাম্ভন্য ধর্মে অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়। হয়তো সেই কারনেই এই সেদিন ১৮৯৩ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক ব্রাম্ভন-অব্রাম্ভন পার্থক্য ঘুচিয়ে এক ধরনের নরম হিন্দু জাতীয়তাবাদে পরাধীন ভারতের জনগনকে উদ্বুদ্ধ করতে সার্বজনীন গণেশ পূজার আয়োজন করেছিলেন। তার আগে এমনকি মহারাষ্ট্রেও এত বড় করে গনেশ পূজার চল ছিল না। আজকের মহারাষ্ট্র ও অন্যত্র গণেশ চতুর্থীকে ঘিরে আম আদমির এহেন উন্মাদনার সূচনাটা কিন্তু করে দিয়ে গেছিলেন লোকমান্য তিলকই।

Your Opinion

We hate spam as much as you do