দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ্য,প্রথমটি ঘটে ২২ শে জুলাই ২০২১,উত্তরপ্রদেশের দেবারিয়া জেলার ১৭ বছরের এক গ্রাম্য যুবতিকে পিটিয়ে থেতলে খুন করা হয় প্রকাশ্যে জিন্স এবং টি শার্ট পরিধান করার অপরাধে।অভিযুক্ত যুবতীর দাদু এবং কাকা।পারিবারিক হিন্দু স্বত্তিকতায় আঘাত করার অপরাধে এই শাস্তি।
আমাদের স্বাধীনতা আছে।উপলব্ধি নেই…!
শাম্ব্য
newscopes.in 15th august
“প্রবলপক্ষেরা সর্বদাই স্বাধীনতার অপব্যাবহার লইয়া খোঁটা দিয়া স্বাধীনতাকে খর্ব করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে,কিন্তু স্বাধীনতার অপব্যয় করিবার যদি অধিকার না থাকে তবে তাহাকে স্বাধীনতাই বলা যায় না।অপব্যায়ের দ্বারাই সদব্যেয়ের যে-শিক্ষা হয় তাহাই খাঁটি শিক্ষা”
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে আজকের ভারতবর্ষ।কিন্তু স্বাধীনতা শব্দটির আসল আধার এই মুহুর্তের ভারত থেকে বিচ্ছন্ন করে কেবলই প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার মডেলের আড়ালে ব্যাক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব দৃষ্টির অগোচরে বিলীয়মান।
একটু তলিয়ে দেখতে গেলে এই বিকৃতির মূল আকর কিন্তু ব্যাক্তিজীবনের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত,এবং ধীর স্রোতের সঙ্গে তা পরিবাহিত হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাতাসের মধ্যে।আজও যখন শৃঙ্খলতা ও স্বাধীনতাকে একই থালায় পরিবেশন করা হয় তখন সেই স্বাধীনতার আদেও কোনো মানে থাকে কী?
যেখানে ব্যাক্তি সমষ্টি সমাজ গঠনের মূল কাঠাম, তাদের মতামতের পারস্পরিক বোঝাপড়ার বদলে যখন সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুরর মতামতের বৈষম্যের মাঝে ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতাই মূল হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতার যে আপেক্ষিক মর্মার্থ তা ক্রমাগত একক ধারনার দ্বারাই পরিচালিত করার চেষ্টা হয় তখনই আসে বিকৃতি।
এক স্বাধীন ব্যাক্তিজীবনের ওপরে আরেক স্বাধীন ব্যাক্তিজীবনের ধারনা,বিশ্বাস,মত প্রতিষ্ঠার যে উদগ্র প্রচেষ্টা স্বাধীনতার বিকৃতির সূত্রপাত ঠিক সেই অঞ্চল থেকেই।
প্রকাশ্য রাজসভায় দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে পণ রাখলেন নেষাগ্রস্থ রাজা যুদ্ধিষ্ঠির।ঠিক এই জায়গাতেই এক ব্যাক্তিজীবনের ওপরে আরেক ব্যাক্তিজীবনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কেবল লিঙ্গের বৈষম্যেকে পাথেয় করে।
সুতরাং আদি ভারতবর্ষের গোড়াতেই সৃষ্ট স্বাধীনতার বৈষম্যের এই আধার।যার ধারবাহিকতা প্রবাহিত হতে হতে আজকের ভারতবর্ষে একটা পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একজন স্বামী মনে করেন স্ত্রী তার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি।তিনি ঠিক যতোটুকু স্বাধীনতা তার জন্যে বরাদ্ধ করবেন সেই টুকুই যথেষ্ট।আবার তাদের পুত্র সন্তান ঠিক একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন নিজের স্ত্রীর ক্ষেত্রে।আবার তাদের কন্যা সন্তানও একই পদ্ধতির অংশ হয়ে উঠছেন তার স্বামীর প্রণীত স্বাধীনতার সীমা রেখায়। ঠিক এইখান থেকেই পুরুষ তান্ত্রিক ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতার একটা পদ্ধতির ধারাবাহিকতা।বংশানুক্রমিক ভাবে স্ত্রী পুরুষ উভয়েই এই পদ্ধতির একটা অংশ হয়ে উঠছেন জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে।
এই ধরনাই যখন চক্রাকার পদ্ধতিতে একধিক ব্যাক্তির মাধ্যমে সমাজব্যাবস্থায় প্রবাহিত হচ্ছে তখন স্বাধীনতার একটা অন্য আধারের পাশাপাশি পদ্ধতিও সৃষ্ট হচ্ছে এবং একটা গোটা জনগোষ্ঠি এই পদ্ধতির অংশ হয়ে উঠছেন।
স্বাধীনতা একদল প্রদান করেন,আরেক দল সেটা গ্রহন করেন।
দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা উল্লেখ্য,প্রথমটি ঘটে ২২ শে জুলাই ২০২১,উত্তরপ্রদেশের দেবারিয়া জেলার ১৭ বছরের এক গ্রাম্য যুবতিকে পিটিয়ে থেতলে খুন করা হয় প্রকাশ্যে জিন্স এবং টি শার্ট পরিধান করার অপরাধে।অভিযুক্ত যুবতীর দাদু এবং কাকা।পারিবারিক হিন্দু স্বত্তিকতায় আঘাত করার অপরাধে এই শাস্তি।
দ্বিতীয়টি,ইন্ডিয়ান মুসলিম পার্সোনাল 'ল বোর্ডের সাম্প্রতিক ফতোয়া, “অমুসলিম কাউকে বিয়ে করা মানে সেই বিয়ে অবৈধ্য তো বটেই,দূর্ভাগ্যজনকও।এই বিবাহ শরিয়ৎ বিরোধী”
এর পাশাপাশি বোর্ড এই ঘোষনাও করেন যে,মেয়েদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো।কোনো রকম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর প্রয়োজনই নেই।
সুতরাং ভারতীয় সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে ব্যাক্তিগত দৃষ্টি ভঙ্গির সামাজিক আস্ফালন একটা পদ্ধতিতে পরিনত করা।ব্যাক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পারিবারিক স্তরে এবং তা থেকে ধর্মীর ও সামাজিক মন্ডলীতে ধাপে ধাপে পরিবাহিত হচ্ছে।এই দৃষ্টিভঙ্গি যখন সমাজের বুকে চুড়ান্ত প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখনই তা রাজনৈতিক এবং প্রশানিক পরিকাঠামের একটি অংশ হয়ে ওঠে।
যেভাবে মনুসংহিতা অনুসারে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নির্মান এই মূহুর্তের ভারত সরকারের একটি অলিখিত প্রকল্প।
জাতী,ধর্ম,বর্ন,লিঙ্গের ভিত্তিতে স্বাধীনতার যে বৈষম্য ভারতবর্ষের শরীরে ক্যানসারারে মতোন ছড়িয়ে পড়েছে তা একদিনে সম্ভব হয়নি।প্রাচীন কাল থেকে ধারাবাহিক ভাবে এর বিস্তার ঘটেছে আজকের ভারতবর্ষে।যা এখন একটা অভ্যাস পরিনত হয়েছে।
শক্তিশালী ব্যাক্তিরা সমস্ত স্বাধীনতার অধিকারী।পার্যায়ক্রমিক ভাবে তা পরিবাহিত হবে অপেক্ষাকৃত দূর্বল স্তর পর্যন্ত।প্রত্যেক ব্যাক্তির মূল চাহিদাই হলো ক্ষমতা(অর্থিক,প্রশাসনিক,জাতীগত প্রভৃতি)।আর ক্ষমতা চায় প্রশ্নহীন আনুগত্য।যা স্বাধীনতার অধিকারের পরিপূরক।
মনিবের চাহিদা তার অধীনস্থ গৃহ-পরিচারিকা।মাহাজনের চাহিদা অধীস্থ শ্রমীক।সরকারের চাহিদা অধীনস্থ জনগন।
ফলত দেশের অর্থনিতীর বেসরকারিকরণ,স্বাস্থ ও শিক্ষার মতোন মৌলিক পরিষেবা গুলিকে ব্যাক্তিগত মালিকানার হাতে তুলে দেওয়া,সার্বজনীন প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং উচ্ছেদ অভিযান,ইউ পি এ-অ্যাক্ট ব্যাবহার করে প্রগতিশীল নাগরিকদের কন্ঠরোধ,পেগাসাস সাইবার অ্যাপের মাধ্যমে ব্যাক্তিগত জীবনের ওপরে সরকারী হানাদারদের খবদারি,ভারতবর্ষের চিরাচরিত ঐক্যের ভিত্তিকে নস্যাৎ করে একক ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠা—সবটাই একটা পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেবল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের প্রশাসনিক শাসন ক্ষমতার হস্তান্তরের মধ্যে দিয়েই যে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এসেছে এই ধারনার আড়ালেই থেকে গিয়েছে ব্যাক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মূল আধার।
তাই আজও ছাত্র ছাত্রীর মেধার থেকে তাদের ধর্মীয় পরিচয় প্রাধান্য পায় বেশি।একলব্যের বৃদ্ধাঙ্গুলি গুরুদক্ষিণা হিসেবে ছিনিয়ে নেওয়ার পেছনে যে জাতীগত বিদ্বেষ এবং জাতীগত অধীনতা প্রতিষ্ঠর উদ্দেশ্য ছিলো সেই আকর থেকেই সৃষ্টি আজকের ধারনার।
হেগেলের মতানুসারে ,”নিজেকে যদি কেউ যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে চায়,তবে তার একমাত্র মাধ্যম হলো স্বাধীনতা।কেউ যদি নিজেকে উপলব্ধি করতে না পারে,নিজের অবস্থা যাচাই করতে না পারে,তবে তাকে স্বাধীন বলা যাবেনা।“
ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ আজও কি পেরেছেন নিজেদের ব্যাক্তি স্বাধীনতার আধার কে উপলব্ধি করতে?যদি পেরে থাকতেন তবে কি নির্দাধায় এক বৈষম্য গত পদ্ধতির মধ্যে প্রবেশ করতেন?
তাই “স্ত্রী কে পণ রাখবার অধিকার কে দিলো স্বামীকে” এ বাক্য কেবলই একটি পঙ্কতি হয়েই থেকে যায়।“লাঙল যার জমি তার” এই গর্জনকে উপেক্ষা করেই ঔপনিবেশিক কৃষি আইনের প্রতিষ্ঠা করা হয়।এন আর সি র মাধ্যমে স্বাধীন দেশের পরাধীন প্রজায় আমাদের নির্বাসিত করতে চাইলেও নিজেদের ব্যাক্তি অধিকারের স্বার্থে আমরা কিন্তু তাকে ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত করতে অক্ষমই থেকে গেছি।
কারন,আজও প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতার আড়ালেই রয়ে গিয়েছে ব্যাক্তি স্বাধীনতার উপলব্ধি মূল আধার।
We hate spam as much as you do