গান্ধীর মন্দির এবং প্রার্থনা হলের ধারণা------ বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সেখানে হিন্দু ধর্মের নামে ব্যাপক জনসমাবেশের ফলে একটি মন্দির নির্মাণের আইনি অনুমোদন শুনলে মহাত্মা গান্ধী ভেঙে পড়তেন। গান্ধী গভীরভাবে আধ্যাত্মিক ছিলেন এবং প্রায়ই গণপ্রার্থনা এবং অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রামকে স্মরণ করতেন।
গান্ধী ১৯২১ এ অযোধ্যায় যে রামমন্দির দর্শণ করেছিলেন..
এস এন সাধু
10 Jan 2024
বেশিরভাগ মানুষের কাছে শুনতে আশ্চর্য লাগবে যে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে মহাত্মা গান্ধী উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় ভগবান রামকে দর্শন করতে গিয়েছিলেন
১৯২১ সালে অর্থাৎ তার খুন হওয়ার ২৭ বছর আগে গিয়েছিলেন যা ২০শে মার্চ ওই বছরই তার 'নবজীবন' নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
গান্ধী লিখেছিলেন যখন আমি অযোধ্যায় পৌঁছলাম একটা ছোট্ট মন্দিরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো,যে মন্দিরটা ভেতরেই ভগবান রামচন্দ্র জন্মেছিলেন বলে মানুষ বিশ্বাস করেন।
২০২৪ সালে একটা মন্দির তৈরি হচ্ছে দেখা যাচ্ছে যেখানে একসময় বাবরি মসজিদ ছিল এবং সেই সেই ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এক অসম্ভব প্রচার এবং ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করছে যা অনুভৃত এবং খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ তৈরীর সহায়ক। এইসব ঘটনা গান্ধীজীর সমস্ত আধ্যাত্মিক আত্মচেতনার বিরোধী যে যা গান্ধীর মধ্যে আজীবন ছিল
৩০ শে জানুয়ারি ১৯৪৮ এ হিন্দু নামধারী সন্ত্রাসবাদী যখন গান্ধীর শরীরের তিনটি বুলেট ঢুকিয়ে দেয় তখন তিনি মৃত্যুর শেষ দিনে শেষ মুহূর্তে বলেন " হে রাম" এই কথা আমাদের মনে করতে হবে।
গান্ধী দেবতার জন্য স্বদেশীদের কথা বলেছিলেন।
গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে একটি বিশেষ দিক ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সমস্ত বিদেশী দ্রব্য এবং ব্রিটিশ জিনিসপত্র বয়কট করে খাদি এবং তাঁতের ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া। সেই সময় গান্ধী রাম সীতার মূর্তি দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে বলেছিলেন " মূর্তির পোশাক কুৎসিত মসলিন এবং ব্রেকেটের।
গান্ধী লিখেছিলেন "অসহযোগীদের মধ্যে যারা ধর্মপ্রাণ ছিলেন তারা মন্দিরের পুরোহিতকে অনুরোধ করেছিলেন প্রতিমার পোশাক হিসেবে খাদি ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু আমি এই পরামর্শ দেওয়ার পরও মন্দিরের পুরোহিতরা খুব একটা গ্রাহ্য করেনি।"
গান্ধী ১৫ শতকের কবি-সন্ত গোস্বামী তুলসীদাসের সাথে যুক্ত জনপ্রিয় কিংবদন্তিও স্মরণ করেছিলেন, কীভাবে তিনি একটি কৃষ্ণ মন্দিরে দেবতার সামনে প্রণাম করার শপথ করেছিলেন যখন ভগবান কৃষ্ণ ধনুক এবং তীর নিয়ে রামের রূপে তাঁর সামনে উপস্থিত হন। গান্ধী এই বিবরণটি উল্লেখ করেছিলেন যে তুলসীদাসের ব্রত এত শক্তিশালীভাবে ভক্তিপূর্ণ ছিল যে ভগবান রাম সত্যই তাঁর সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তিনি লিখেছেন যে তার যদি তুলসীদাসের ভক্তির শক্তি থাকত, তাহলে তিনি দেবতাদের সামনে প্রণাম না করার জন্য জোর দিতেন। যতক্ষণ না পুরোহিতরা তাদের খাদি পরিয়ে দিত।
গান্ধী লিখেছিলেন "আমার ইচ্ছা যে একজন মুসলিম যেভাবে তাদের পবিত্র কাজ খাদি পরে শুরু করেন সেই ভাবেই হিন্দুদের উচিত মন্দিরে এবং অন্যান্য পবিত্র জায়গায় খাদি ব্যবহার করা।"
রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি মিথ্যা ভাষ্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে -----
এখন আমরা বলতে চাই ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর যে জায়গায় বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে রাম মন্দির তৈরির জন্য মানুষ জড়ো হয়েছিল এবং ধ্বংস করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও তৎকালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং এর উপস্থিতিতে সেই বিষয়ে,সুপ্রিম কোর্ট এই ধ্বংসের বিষয়ে নিশ্চিত করেছিল যেটা একটা ভয়ংকর ভাবে বেআইনি। কারণ এরকম কোন প্রমাণই নেই বাবরি মসজিদে জায়গায় রামের জন্মভূমি ছিল।
হাস্যকরভাবে, সুপ্রিম কোর্ট এই গুরুতর বেআইনিতা স্বীকার করেছে এবং এখনও স্থির করেছে যে যেখানে মসজিদ ভেঙে ফেলার অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। আবার অনুমতি দেয় সেখানে একটি রাম মন্দির তৈরি করা হবে। ঠিক এটাই আজ করা হচ্ছে, এবং আংশিকভাবে নির্মিত মন্দিরের উদ্বোধন ২২ জানুয়ারী নির্ধারিত হয়েছে৷
গান্ধীর মন্দির এবং প্রার্থনা হলের ধারণা------
বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সেখানে হিন্দু ধর্মের নামে ব্যাপক জনসমাবেশের ফলে একটি মন্দির নির্মাণের আইনি অনুমোদন শুনলে মহাত্মা গান্ধী ভেঙে পড়তেন। গান্ধী গভীরভাবে আধ্যাত্মিক ছিলেন এবং প্রায়ই গণপ্রার্থনা এবং অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রামকে স্মরণ করতেন।
তিনি ধ্বংসের ঘটনা এবং পবিত্র একটি জায়গাকে ধ্বংস করার বিষয়ে নিশ্চিত ভাবেই বিরোধিতা করতেন।
তিনি এই মন্দিরের পবিত্রকরণের সাথে ভারতের শাসকদের উন্মাদনার দৃশ্য এবং মহিমা দেখে হতাশ হতেন। মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি আজকের ভারতে যে বিদ্বেষ প্রকাশ করা হচ্ছে তা তিনি কখনই অনুমোদন করতেন না।
১৯৩০ সালের কথা মনে করা যেতে পারে, গান্ধী সবরমতী আশ্রমের বাসিন্দাদের প্রার্থনা করার জন্য একটি মন্দির এবং একটি মূর্তি স্থাপনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
গান্ধীর যুক্তি ছিল আশ্রমে একটি খোলা জায়গায় প্রার্থনা কক্ষ হিসেবে দেওয়া আছে সুতরাং নিজের বিশ্বাসকে দেখাবার জন্য বদ্ধ ঘরের প্রয়োজন নেই। তিনি বলতেন এই প্রার্থনা স্থলের সাধ হচ্ছে আকাশ পর্যন্ত এবং এর চারটি দিকে এ চারটি পাঁচিল একটি উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম । তিনি বলতেন এই সীমাহীন প্রার্থনা সভায় ধর্ম,জাতীয়তাবোধ এই সব কিছু সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে ওঠার কথাই বলছে।
গান্ধীর ইচ্ছে ছিল দাবির কোন সীমা থাকবে না। ঈশ্বর অনন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। অথচ এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন ভগবান রামকে নাকি মন্দিরের রূপে অযোধ্যায় একটা পাকা বাড়ি তৈরি করে দেয়া গেছে। যেখানে একটা মসজিদ ছিল
১৯৪৬ সালের ৪ঠা এপ্রিল দিল্লির একটি প্রার্থনা সভায় গান্ধীর বক্তব্য থেকে ভগবান রাম সম্পর্কে তার যে বিস্তৃত ধারণা ছিল তাও উল্লেখ করা যেতে পারে,
"আমার রাম আমাদের প্রার্থনা, ইতিহাসের রাম নন। দশরথের সন্তান নন। তিনি অযোধ্যার রাজা নন। তিনি শাশ্বত। জন্ম মৃত্যু নেই। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। এই কথা বলতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে মুসলিমদেরও তার নাম উচ্চারণ করতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি পরিষ্কার করে জানিয়েছেন একজন ইসলামী বিশ্বাসী মানুষ তাকে জোর করা উচিত না রাম নামের জন্য ।"
গান্ধীর প্রার্থনা এবং বিশ্বাসের বোঝাপড়া ছিল মূলত সহ্য শক্তি এবং গ্রহণ করার ইচ্ছা। তিনি ভারতে বর্তমানের ঘটনাগুলির সাথে একেবারেই একমত হতেন না, কারণ তারা গান্ধীর লালিত আদর্শ, ইতিহাস প্রদর্শনের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু এটি সেই আদর্শ যার জন্য তিনি তার শেষ কথা "হে রাম" দিয়ে তার ঘাতকের ঘৃণার বুলেট থামিয়েছিলেন।
(Newsclick এ প্রকাশিতর বাংলা অনুবাদ )
The author served as an Officer on Special Duty to the President of India, KR Narayanan. The views are personal.
We hate spam as much as you do